alt

অবাধে বালু উত্তোলন: ভাঙনের ঝুঁকিতে সুন্দরবন ও উপকূলীয় বাঁধ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, খুলনা : রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অবৈধ বালু তুলে এ ধরনের জলযানে করেই টেনে নেয়া হয়। দিনে এগুলো ভাসতে থাকে নদীতে

খুলনা সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ এলাকা উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে এরই মধ্যে সুন্দরবন পরিবেশগত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বনের আশপাশের নদ-নদীতে বালু উত্তোলনে সরকারিভাবে কোনো অনুমোদন নেই। তবু পশ্চিম সুন্দরবনের কয়েকটি এলাকার নদ-নদীতে খনন যন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সুন্দরবন ও নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙনের ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি বিলীন হচ্ছে উপকূলীয় নদীপাড়ের বনের অংশ ও লোকালয়। এতে সুন্দরবন এলাকা ও উপকূলীয় বাঁধ আরও ঝুঁকিতে পড়ছে।

সুন্দরবন ও নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে অব্যাহতভাবে বালি উত্তোলনে ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ছে

বিলীন হচ্ছে উপকূলীয় নদী পাড়ের বনের অংশ ও লোকালয়

বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে সুন্দরবন এলাকা ও উপকূলীয় বাঁধ

সংশ্লিষ্ট উপজেলার এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানিয়েছে পাউবো

কয়রা ও দাকোপ উপজেলার কোনো নদ-নদী থেকে বালি তোলার অনুমতি নেই: জেলা প্রশাসক

স্থানীয়রা বলছেন, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের প্রভাবে সৃষ্ট ভাঙন রোধে প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বিপুল অর্থ খরচ দেখিয়ে সংস্কার করা হচ্ছে নদীতীর রক্ষা বাঁধ, যা সংস্কারের অল্প দিনেই ফের ধসে পড়ছে। বছর না ঘুরতেই ওই স্থানে আবারো নেয়া হচ্ছে প্রকল্প। এরইমধ্যে পশ্চিম সুন্দরবন ঘেঁষা কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদ, শাকবাড়িয়া নদীসহ কয়েকটি এলাকার গাছপালা ভেঙে নদ-নদীতে পড়তে শুরু করেছে। কয়েকটি স্থানে ভাঙনের পরিধিও বেড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এ অবৈধ বালু ব্যবসায় জড়িত। কয়রার মদিনাবাদ এবং দাকোপের বটবুনিয়া এলাকার দুই ব্যক্তির নিজস্ব কয়েকটি খনন যন্ত্রসহ বালু উত্তোলনের বড় ব্যবসা রয়েছে।

এ ব্যাপারে পাউবো খুলনা-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে সেখানে বড় ধরনের গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। সেই গর্তে বেড়িবাঁধ ধসে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন, যার ৬৬ শতাংশ বাংলাদেশে; বাকিটা ভারতে। জলবায়ু সংকট প্রকট হয়ে ওঠার সঙ্গে বনাঞ্চলের ঝুঁকিও ক্রমে বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অল্প কয়েক ফুট ওপরে এ বনভূমি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতটাই সর্বব্যাপী যে প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের ওপর সেই চাপ অসহনীয় মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘জীববৈচিত্র্যের অসামান্য সম্ভার সুন্দরবনের পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৭ সালে একে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। কিন্তু অপরিকল্পিত ও পরিবেশের তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে একে নানাভাবে সংকটে ফেলছি আমরা।’

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশন’-এর নির্বাহী পরিচালক শুভ্র শচীন বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় পরিকল্পিত ও স্থায়ী টেকসই বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতি বছরই ভাঙন দেখা দেয়। অথচ এ এলাকার ভাঙনকবলিত এলাকার নদ-নদী থেকে সারা বছরই বালু তুলছে কয়েকটি চক্র। এতে সেই স্থানে বাঁধ ধসে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে।’

খুলনা জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, রূপসা ব্রিজের দক্ষিণ থেকে দাকোপের চালনা এলাকার পূর্ব পাশ পর্যন্ত খুলনা জেলা প্রশাসনের আওতাধীন একমাত্র সরকারি বালুমহাল। এর বাইরে জেলার কোনো এলাকায় বালু উত্তোলনের অনুমতি নেই। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা আবাসিক এলাকা থেকে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু তোলা যাবে না। আইন অমান্যকারীর দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

এ ব্যাপারে পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এজেডএম হাছানুর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনের পাশের নদ-নদী থেকে বালু তোলা বনের জন্য হুমকি। এ বিষয়ে আগে কয়েকবার খনন যন্ত্রের মালিকদের নিষেধ করা হয়েছে। তবে তারা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।’

কয়রা উপজেলার বাসিন্দা ইউনুছ আলী বলেন, ‘পশ্চিম সুন্দরবনের নদ-নদী থেকে বালু তোলার পেছনে কয়েকটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। দীর্ঘদিন স্থানীয় প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এ কাজ করছে তারা। পাউবোর ঠিকাদাররাও এ চক্রের সঙ্গে চুক্তি করে বালু তোলে।’

কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি স্পটে বালু উত্তোলনের ফলে নদীভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রশাসন মাঝে মধ্যে দুই-একজনকে জরিমানা করলেও বালু উঠানো বন্ধ হয়নি। ’

কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধের কাজ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমিন অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিনিধি আমিনুর ইসলাম জানান, তাদের বস্তা ডাম্পিং, জিও ব্যাগ ভর্তি ও বেঁড়িবাধের কাজে বালুর প্রয়োজন হয়। এজন্য তারা হারুন নামে একজনের কাছ থেকে ৬ টাকা ঘনফুট চুক্তিতে আট লাখ ঘনফুট বালু নিয়েছেন। তবে বালু কোথা থেকে আসছে তিনি এ বিষয়ে জানেন না।

সরজমিনে কয়রার কপোতাক্ষ নদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদের হরিণখোলা চর দখল করে দুটি ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, আগে এ বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক যুবলীগ নেতা আব্দুর রহমান বাবু। গত বছরের ৫ আগস্টের পর শ্যামনগর উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব যুবদল নেতা আনোয়ারুল ইসলাম আঙ্গুর তার সহযোগী হিসেবে এ কাজে যুক্ত হয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে যুবলীগ নেতা আব্দুর রহমান বাবুর সঙ্গে ফোনে করা হলে তিনি প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে কপোতাক্ষ নদের চর ইজারা নিয়েছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন বন্ধ করে রাখেন।

যুবদল নেতা আনোয়ারুল ইসলাম আঙ্গুর দাবি করেন, ‘অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে আমি ও আমার কোনো লোক জড়িত নয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বালু তোলার কাজে নিয়োজিত এক শ্রমিক বলেন, সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত বালু তোলা হয়। একেকটি বাল্কহেডে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার ঘনফুট বালু বোঝাই করা হয়। একেকটি ড্রেজার দিয়ে প্রতি রাতে ১ লাখ থেকে ২ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হয়। প্রতি ঘনফুট বালু ৫-১০ টাকায় বিক্রি হয়।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল বাকী বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ বেঁড়িবাধের কারণে নদ-নদী থেকে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষেধ। তার পরও যদি কেউ নদী থেকে বালু তোলে তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অন্য উপজেলা দাকোপের চালনা বাজারের অদুরে মেরিন মাছ কোম্পানির সামনে ভাঙনকবলিত এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে বার্জে করে নদীতে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ কাজের বালুসংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় নদী থেকেই নিচ্ছে। আর এ কাজেই প্রকল্পের বরাদ্দের অর্থ লোপাট করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রতিনিধি এবং কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কর্মকর্তাকে ওই স্থানে পাওয়া যায়নি।

দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসমত হোসেন বলেন, ‘নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। তবে নদীতে বালুর বস্তা ডাম্পিং-এ নদীর বালু কাটা হচ্ছে কিনা আমার জানা নেই- খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’

খুলনার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘কয়রা ও দাকোপ উপজেলার কোনো নদ-নদী থেকে বালু তোলার অনুমতি নেই। কারণ উপকূলীয় ওইসব এলাকা নদীভাঙন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ছবি

জুলাই আন্দোলনে চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হই, ঢাকায় মামলার কিছু জানি না: সংবাদ সম্মেলনে সাইফুদ্দীন

ছবি

খুলনার ছয় আসনে ভোটার ও কেন্দ্র বেড়েছে, কমেছে বুথের সংখ্যা

ছবি

শুধু আইন দিয়ে শিশু সহিংসতা ও শোষণ রোধ করা সম্ভব নয়: আলোচনা সভায় বক্তারা

ছবি

অবৈধ বালু ভাগাভাগি, জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের লিখিত সমঝোতা চুক্তি

ছবি

পাখিপ্রেমীদের মমতায় ইট-পাথরের নগরই এখন চড়ুইয়ের গ্রাম

ছবি

কবরে নামানোর আগমুহূর্তে জেগে উঠলো শিশু!

ছবি

ডেঙ্গু: একদিনে সর্বোচ্চ ৬৮৫ জন হাসপাতালে ভর্তি, মৃত্যু ৩

ছবি

ঐকমত্য কমিশনে ‘নারী’ সিদ্ধান্তে পরিবর্তন দাবি অধিকারকর্মীদের

ছবি

সুন্দরবনের ডিমের চরে নিখোঁজ কিশোর পর্যটকের মরদেহ ৩০ ঘন্টা পর উদ্ধার

ছবি

উলিপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভেঙে জায়গা দখলের পায়তারা

ছবি

চান্দিনায় খাল খনন ও রিটার্নিং ওয়াল প্রকল্পের লাখ লাখ টাকা লুট

ছবি

ডিমলায় অনুমোদনহীন ঝুঁকিপূর্ণ পেট্রোল পাম্পের ছড়াছড়ি

ছবি

গারো-কোচ নারীদের হাতে তৈরি বাঁশের শৌখিন পণ্য যাচ্ছে বিভিন্ন জেলায়

ছবি

মহেশপুর সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠক

ছবি

কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ

ছবি

বনভূমি উদ্ধার করে বৃক্ষরোপণ

ছবি

বেতাগীতে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমে দায়সারাভাব!

ছবি

পীর বলুহ দেওয়ানের মেলা থেকে ৫ মাদকসেবী ও জুয়াড়ি আটক

ছবি

বেগমগঞ্জে বিলুপ্ত প্রায় ৪২৫ কচ্ছপ উদ্ধার

ছবি

ঝালকাঠিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আমড়া চাষ

ছবি

কুমিল্লায় চাকুরির প্রলোভনে নেয়া ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করতে হত্যা করা হয় আমিনুলকে

ছবি

পূর্বধলায় ট্রেনে কাটা পড়ে বৃদ্ধের মৃত্যু

ছবি

সুন্দরবনে ভ্রমণে এসে সাগরে কিশোর নিখোঁজ

ছবি

দেশকে সোনার খনিতে রূপান্তর সম্ভব : বাণিজ্য উপদেষ্টা

ছবি

১২০ টাকায় কনস্টেবলে চাকরি পেলেন ১৭ তরুণ-তরুণীর

ছবি

চার বিভাগে ভারী বৃষ্টি হতে পারে

ছবি

ডেঙ্গু: আক্রান্ত ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে

ছবি

মুলাদিতে জমি নিয়ে বিরোধে এক কৃষককে হত্যা, আহত দু’জন

ছবি

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে ছাড়পত্র পেল আরও এক শিক্ষার্থী

ছবি

চার দফা দাবিতে ময়মনসিংহে সরকারি কলেজের বেসরকারি কর্মচারীদের মানববন্ধন

ছবি

‘আমার নাম ভাঙিয়ে মামলা–বাণিজ্য চলছে’: সাইফুদ্দীনের অভিযোগ

ছবি

প্রধান বিচারপতি ব্রাজিলে, আলোচনায় দু’দেশের বিচার ব্যবস্থা

ছবি

সৈয়দপুরে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা

ছবি

সাংবাদিক শফিকুর রহমানের জানাজা সম্পন্ন

ছবি

অটোচালক হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে মানববন্ধন

ছবি

নোয়াখালীতে সাম্যবাদী আন্দোলনের মানববন্ধন

tab

news » bangladesh

অবাধে বালু উত্তোলন: ভাঙনের ঝুঁকিতে সুন্দরবন ও উপকূলীয় বাঁধ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, খুলনা

অবৈধ বালু তুলে এ ধরনের জলযানে করেই টেনে নেয়া হয়। দিনে এগুলো ভাসতে থাকে নদীতে

রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

খুলনা সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ এলাকা উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে এরই মধ্যে সুন্দরবন পরিবেশগত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বনের আশপাশের নদ-নদীতে বালু উত্তোলনে সরকারিভাবে কোনো অনুমোদন নেই। তবু পশ্চিম সুন্দরবনের কয়েকটি এলাকার নদ-নদীতে খনন যন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সুন্দরবন ও নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙনের ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি বিলীন হচ্ছে উপকূলীয় নদীপাড়ের বনের অংশ ও লোকালয়। এতে সুন্দরবন এলাকা ও উপকূলীয় বাঁধ আরও ঝুঁকিতে পড়ছে।

সুন্দরবন ও নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে অব্যাহতভাবে বালি উত্তোলনে ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ছে

বিলীন হচ্ছে উপকূলীয় নদী পাড়ের বনের অংশ ও লোকালয়

বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে সুন্দরবন এলাকা ও উপকূলীয় বাঁধ

সংশ্লিষ্ট উপজেলার এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানিয়েছে পাউবো

কয়রা ও দাকোপ উপজেলার কোনো নদ-নদী থেকে বালি তোলার অনুমতি নেই: জেলা প্রশাসক

স্থানীয়রা বলছেন, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের প্রভাবে সৃষ্ট ভাঙন রোধে প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বিপুল অর্থ খরচ দেখিয়ে সংস্কার করা হচ্ছে নদীতীর রক্ষা বাঁধ, যা সংস্কারের অল্প দিনেই ফের ধসে পড়ছে। বছর না ঘুরতেই ওই স্থানে আবারো নেয়া হচ্ছে প্রকল্প। এরইমধ্যে পশ্চিম সুন্দরবন ঘেঁষা কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদ, শাকবাড়িয়া নদীসহ কয়েকটি এলাকার গাছপালা ভেঙে নদ-নদীতে পড়তে শুরু করেছে। কয়েকটি স্থানে ভাঙনের পরিধিও বেড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এ অবৈধ বালু ব্যবসায় জড়িত। কয়রার মদিনাবাদ এবং দাকোপের বটবুনিয়া এলাকার দুই ব্যক্তির নিজস্ব কয়েকটি খনন যন্ত্রসহ বালু উত্তোলনের বড় ব্যবসা রয়েছে।

এ ব্যাপারে পাউবো খুলনা-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে সেখানে বড় ধরনের গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। সেই গর্তে বেড়িবাঁধ ধসে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন, যার ৬৬ শতাংশ বাংলাদেশে; বাকিটা ভারতে। জলবায়ু সংকট প্রকট হয়ে ওঠার সঙ্গে বনাঞ্চলের ঝুঁকিও ক্রমে বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অল্প কয়েক ফুট ওপরে এ বনভূমি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতটাই সর্বব্যাপী যে প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের ওপর সেই চাপ অসহনীয় মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘জীববৈচিত্র্যের অসামান্য সম্ভার সুন্দরবনের পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৭ সালে একে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। কিন্তু অপরিকল্পিত ও পরিবেশের তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে একে নানাভাবে সংকটে ফেলছি আমরা।’

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশন’-এর নির্বাহী পরিচালক শুভ্র শচীন বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় পরিকল্পিত ও স্থায়ী টেকসই বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতি বছরই ভাঙন দেখা দেয়। অথচ এ এলাকার ভাঙনকবলিত এলাকার নদ-নদী থেকে সারা বছরই বালু তুলছে কয়েকটি চক্র। এতে সেই স্থানে বাঁধ ধসে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে।’

খুলনা জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, রূপসা ব্রিজের দক্ষিণ থেকে দাকোপের চালনা এলাকার পূর্ব পাশ পর্যন্ত খুলনা জেলা প্রশাসনের আওতাধীন একমাত্র সরকারি বালুমহাল। এর বাইরে জেলার কোনো এলাকায় বালু উত্তোলনের অনুমতি নেই। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা আবাসিক এলাকা থেকে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু তোলা যাবে না। আইন অমান্যকারীর দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

এ ব্যাপারে পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এজেডএম হাছানুর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনের পাশের নদ-নদী থেকে বালু তোলা বনের জন্য হুমকি। এ বিষয়ে আগে কয়েকবার খনন যন্ত্রের মালিকদের নিষেধ করা হয়েছে। তবে তারা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।’

কয়রা উপজেলার বাসিন্দা ইউনুছ আলী বলেন, ‘পশ্চিম সুন্দরবনের নদ-নদী থেকে বালু তোলার পেছনে কয়েকটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। দীর্ঘদিন স্থানীয় প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এ কাজ করছে তারা। পাউবোর ঠিকাদাররাও এ চক্রের সঙ্গে চুক্তি করে বালু তোলে।’

কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি স্পটে বালু উত্তোলনের ফলে নদীভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রশাসন মাঝে মধ্যে দুই-একজনকে জরিমানা করলেও বালু উঠানো বন্ধ হয়নি। ’

কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধের কাজ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমিন অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিনিধি আমিনুর ইসলাম জানান, তাদের বস্তা ডাম্পিং, জিও ব্যাগ ভর্তি ও বেঁড়িবাধের কাজে বালুর প্রয়োজন হয়। এজন্য তারা হারুন নামে একজনের কাছ থেকে ৬ টাকা ঘনফুট চুক্তিতে আট লাখ ঘনফুট বালু নিয়েছেন। তবে বালু কোথা থেকে আসছে তিনি এ বিষয়ে জানেন না।

সরজমিনে কয়রার কপোতাক্ষ নদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদের হরিণখোলা চর দখল করে দুটি ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, আগে এ বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক যুবলীগ নেতা আব্দুর রহমান বাবু। গত বছরের ৫ আগস্টের পর শ্যামনগর উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব যুবদল নেতা আনোয়ারুল ইসলাম আঙ্গুর তার সহযোগী হিসেবে এ কাজে যুক্ত হয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে যুবলীগ নেতা আব্দুর রহমান বাবুর সঙ্গে ফোনে করা হলে তিনি প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে কপোতাক্ষ নদের চর ইজারা নিয়েছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন বন্ধ করে রাখেন।

যুবদল নেতা আনোয়ারুল ইসলাম আঙ্গুর দাবি করেন, ‘অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে আমি ও আমার কোনো লোক জড়িত নয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বালু তোলার কাজে নিয়োজিত এক শ্রমিক বলেন, সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত বালু তোলা হয়। একেকটি বাল্কহেডে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার ঘনফুট বালু বোঝাই করা হয়। একেকটি ড্রেজার দিয়ে প্রতি রাতে ১ লাখ থেকে ২ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হয়। প্রতি ঘনফুট বালু ৫-১০ টাকায় বিক্রি হয়।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল বাকী বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ বেঁড়িবাধের কারণে নদ-নদী থেকে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষেধ। তার পরও যদি কেউ নদী থেকে বালু তোলে তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অন্য উপজেলা দাকোপের চালনা বাজারের অদুরে মেরিন মাছ কোম্পানির সামনে ভাঙনকবলিত এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে বার্জে করে নদীতে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ কাজের বালুসংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় নদী থেকেই নিচ্ছে। আর এ কাজেই প্রকল্পের বরাদ্দের অর্থ লোপাট করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রতিনিধি এবং কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কর্মকর্তাকে ওই স্থানে পাওয়া যায়নি।

দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসমত হোসেন বলেন, ‘নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। তবে নদীতে বালুর বস্তা ডাম্পিং-এ নদীর বালু কাটা হচ্ছে কিনা আমার জানা নেই- খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’

খুলনার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘কয়রা ও দাকোপ উপজেলার কোনো নদ-নদী থেকে বালু তোলার অনুমতি নেই। কারণ উপকূলীয় ওইসব এলাকা নদীভাঙন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

back to top