বদরখালী সমবায় কৃষি উপনিবেশ সমিতি
চকরিয়া (কক্সবাজার) : দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বৃহত্তম সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বদরখালী সমিতি ভবন -সংবাদ
১৯২৯ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাস্তুহারা ২৬২টি পরিবারকে মাথাগোঁজার ঠাঁই হিসেবে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকা বদরখালীতে ৩ হাজার ৭৭৭ একর ম্যানগ্রোভ ভূমি বরাদ্দ দেয় ব্রিটিশ সরকার।
পরের বছর ১৯৩০ বদরখালীর ম্যানগ্রোভ বনে ঠাঁই হওয়া এসব আশ্রয়হীন মানুষদের আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বদরখালী সমবায় কৃষি উপনিবেশ সমিতি’।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, ১৯২৭ সালে অবিভক্ত বাংলার সমবায় বিভাগের তৎকালীন রেজিস্ট্রার কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার ভূমিহীন মানুষদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠনের প্রস্তাব করেন।
বদরখালীর ভূমি বণ্টন এবং সেখানে সমবায় সমিতির গঠনের উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল তৎকালীন রেজিস্ট্রারের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের এই অনন্য উদ্যোগে বদরখালী জনপদের হাজারো ভূমিহীন পরিবার আশার আলো দেখেছিল। সমবায় সমিতি গঠনের পর আজ বদরখালীতে বেড়েছে লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। সমিতির ২৬২ শেয়ার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০০ সদস্য। তাদের পরিবার তথা পোষ্য সংখ্যা ছাড়িয়ে ৪০ হাজারের বেশি। ৯৩ বছরে বদলে গেছে বদরখালী উপকূলীয় অঞ্চলের আর্থসমাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপট। ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে যোগাযোগ মাধ্যমে। তৈরি হয়েছে জীবন জীবিকার নতুন নতুন রুটিরুজির উপায়।
এভাবেই বদরখালী ইউনিয়নের মানুষ বিগত ৯৩ বছর ধরে সমবায় সমিতির সদস্য হয়ে নিজের জমি চাষাবাদ করেন তারা। তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত হয়েছে এই সমবায় সমিতির মাধ্যমেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গেল নয় দশকে বদরখালী সমিতি একটি সম্প্রদায়ে রূপ নিয়েছে, বদরখালী ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে এর মাধ্যমেই। স্থাবর সম্পত্তির মালিকানার বিবেচনায় এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর সমবায় সমিতি হিসেবে সরকারি তরফে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছে। সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোছাইন বলেন, আমাদের এখন প্রায় ১,৫০০ সদস্য আছে, তাদের প্রত্যেকের ১১.৬০ একর জমি রয়েছে। বদরখালী ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ বর্তমানে সমিতির মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন। সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন।
সমিতির সদস্য চট্টগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা গালিব বলেন, সমিতির মূল উদ্দেশ্য ছিল গৃহহীন মানুষদের আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করা এবং জীবনমান উন্নত করা। এখানে সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষের জন্য আলাদা পাড়া তৈরি করা হয়েছে। নিজেরা জমি চাষ করবে এ শর্তে এখানে মানুষকে সমিতির বরাদ্দ থেকে জমি দেওয়া হয়েছে। এখানকার জনগণের প্রধান কৃষি পণ্য ধান, লবণ, মাছ ও চিংড়ি। স্থানীয়রা জানান, এখানে উৎপাদিত লবণ ও চিংড়ি চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার শাহনাজ ফেরদৌসী বলেন, কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বদরখালী ইউনিয়নে কোনো ভূমিহীন কৃষক নেই। সকলেরই সমান আবাসন, কৃষি ও বাণিজ্যিক জমি রয়েছে। এমনকি সমিতির বরাদ্দ হয়নি এমন জমি থেকে উপার্জিত অর্থও সদস্যদের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, যেকোনো পরিস্থিতি কিংবা সংকটকালে বদরখালী ইউনিয়নের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমিতির রয়েছে ৫ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল। সমিতির সদস্যরা বলছেন, ধর্মগোলা নামে একটি পুরানো ঐতিহ্য থেকে এ চল শুরু করেন তারা, প্রথমদিকের বছরগুলোতে সবাই যৌথ খাদ্য ব্যাংকের জন্য খাদ্যশস্য দিত।
বদরখালী সমিতির সিনিয়র সদস্য কক্সবাজারের সিনিয়র জিএম আশেক উল্লাহ বলেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় ধর্মগোলা এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেছিল। তখন এই এলাকায় কেউ অনাহারে মারা যায়নি, কারণ সেসময় সমিতির প্রবীণ সদস্যরা আপতকালিন তহবিল হিসেবে প্রায় ১২০০ মণ চাল মজুদ করে রেখেছিলেন। যা সেসময় জনগণের মাঝে বিতরণ করা হয়।
সমিতির রেকর্ডপত্র বলছে, ১৯৩০ সালে মুসলিম শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সমিতি কয়েকটি মক্তব, ধর্মীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৫ সালে বদরখালী বহুমুখী (সরকারি) প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৯৪৫ সালে বদরখালী কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৫৪ সালে বদরখালী ফাজিল মাদ্রাসা এবং ১৯৯৩ সালে বদরখালী ডিগ্রি কলেজ স্থাপিত হয়।
এছাড়াও বর্তমানে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়, দুটি কলেজ এবং বেশ কয়েকটি মাদ্রাসাসহ এই এলাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় খরচাদির মধ্যে একটি বিশাল অংশ সমিতি থেকে দেওয়া হয়।
সমিতির সাবেক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, বদরখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সমিতির অর্থায়নে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন।
সরকার কর্তৃক এধরনের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার আগে সমিতি এই অঞ্চলের কোমলমতি শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করেছে। এলাকায় স্থাপিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুরো খরচ বহন করত সমিতি। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৮০% ভাগের বেশি। বদরখালীর বাসিন্দাদের জন্য সুদবিহীন শিক্ষা ঋণও দেন সমিতি। এছাড়া গরীব ও হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেও সহায়তা দেন বদরখালী সমিতি।
বদরখালী ইউনিয়নে বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, ১৯৭৭ সালে হাইস্কুলে পড়ার সময় ২০০০ টাকা এবং ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় ৫০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম আমি। পরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার পর কোনো সুদ ছাড়াই ঋণ পরিশোধ করেছিলাম।
যে সব পরিবার তাদের সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেছিল তাদের জন্য জমি বরাদ্দ দিত সমিতি এমনও সময় ছিল।
সরেজমিনে জানা গেছে, বদরখালী ইউনিয়নের স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। তবে প্রথমদিকে সমিতির অফিসে প্যারামেডিক ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো।
বর্তমানে বদরখালী ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড এলাকায় ৪৫টি মসজিদ, একটি মন্দির, ১৪টি মক্তব, ২০টি কবরস্থান এবং একটি শ্মশান আছে, সমিতির নিজস্ব খরচে এসব পরিচালিত হয়।
সমিতির সম্পাদক মঈন উদ্দিন বলেন, আমাদের এই সমিতি গেল ৯৩ বছরে ইউনিয়নের একটি মিনি সেক্রেটারিয়েটে পরিণত হয়েছে। এটি এখানকার অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও ধর্মীয় সকল অবকাঠামো নিয়ে কাজ করার কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সমিতির বর্তমান বার্ষিক ব্যয় হয় প্রায় ৮ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা। চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ১৯২৯ সালে বাস্তুহারা কিছু মানুষ এই সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যত জীবন নিয়ে আশার আলো দেখেছিলো। ৯৩ বছরে এসে আজ এই সমবায় সমিতি পুরো দেশের সমবায়ের জন্য একটি অনন্য মডেল প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডানা মেলেছে।
বদরখালীর লক্ষাধিক মানুষ আজ সত্যিকার অর্থে এই সমিতির বদৌলতে তাদের সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে।
বদরখালী সমবায় কৃষি উপনিবেশ সমিতি
চকরিয়া (কক্সবাজার) : দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বৃহত্তম সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বদরখালী সমিতি ভবন -সংবাদ
মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
১৯২৯ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাস্তুহারা ২৬২টি পরিবারকে মাথাগোঁজার ঠাঁই হিসেবে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকা বদরখালীতে ৩ হাজার ৭৭৭ একর ম্যানগ্রোভ ভূমি বরাদ্দ দেয় ব্রিটিশ সরকার।
পরের বছর ১৯৩০ বদরখালীর ম্যানগ্রোভ বনে ঠাঁই হওয়া এসব আশ্রয়হীন মানুষদের আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বদরখালী সমবায় কৃষি উপনিবেশ সমিতি’।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, ১৯২৭ সালে অবিভক্ত বাংলার সমবায় বিভাগের তৎকালীন রেজিস্ট্রার কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার ভূমিহীন মানুষদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠনের প্রস্তাব করেন।
বদরখালীর ভূমি বণ্টন এবং সেখানে সমবায় সমিতির গঠনের উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল তৎকালীন রেজিস্ট্রারের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের এই অনন্য উদ্যোগে বদরখালী জনপদের হাজারো ভূমিহীন পরিবার আশার আলো দেখেছিল। সমবায় সমিতি গঠনের পর আজ বদরখালীতে বেড়েছে লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। সমিতির ২৬২ শেয়ার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০০ সদস্য। তাদের পরিবার তথা পোষ্য সংখ্যা ছাড়িয়ে ৪০ হাজারের বেশি। ৯৩ বছরে বদলে গেছে বদরখালী উপকূলীয় অঞ্চলের আর্থসমাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপট। ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে যোগাযোগ মাধ্যমে। তৈরি হয়েছে জীবন জীবিকার নতুন নতুন রুটিরুজির উপায়।
এভাবেই বদরখালী ইউনিয়নের মানুষ বিগত ৯৩ বছর ধরে সমবায় সমিতির সদস্য হয়ে নিজের জমি চাষাবাদ করেন তারা। তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত হয়েছে এই সমবায় সমিতির মাধ্যমেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গেল নয় দশকে বদরখালী সমিতি একটি সম্প্রদায়ে রূপ নিয়েছে, বদরখালী ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে এর মাধ্যমেই। স্থাবর সম্পত্তির মালিকানার বিবেচনায় এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর সমবায় সমিতি হিসেবে সরকারি তরফে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছে। সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোছাইন বলেন, আমাদের এখন প্রায় ১,৫০০ সদস্য আছে, তাদের প্রত্যেকের ১১.৬০ একর জমি রয়েছে। বদরখালী ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ বর্তমানে সমিতির মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন। সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন।
সমিতির সদস্য চট্টগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা গালিব বলেন, সমিতির মূল উদ্দেশ্য ছিল গৃহহীন মানুষদের আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করা এবং জীবনমান উন্নত করা। এখানে সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষের জন্য আলাদা পাড়া তৈরি করা হয়েছে। নিজেরা জমি চাষ করবে এ শর্তে এখানে মানুষকে সমিতির বরাদ্দ থেকে জমি দেওয়া হয়েছে। এখানকার জনগণের প্রধান কৃষি পণ্য ধান, লবণ, মাছ ও চিংড়ি। স্থানীয়রা জানান, এখানে উৎপাদিত লবণ ও চিংড়ি চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার শাহনাজ ফেরদৌসী বলেন, কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বদরখালী ইউনিয়নে কোনো ভূমিহীন কৃষক নেই। সকলেরই সমান আবাসন, কৃষি ও বাণিজ্যিক জমি রয়েছে। এমনকি সমিতির বরাদ্দ হয়নি এমন জমি থেকে উপার্জিত অর্থও সদস্যদের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, যেকোনো পরিস্থিতি কিংবা সংকটকালে বদরখালী ইউনিয়নের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমিতির রয়েছে ৫ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল। সমিতির সদস্যরা বলছেন, ধর্মগোলা নামে একটি পুরানো ঐতিহ্য থেকে এ চল শুরু করেন তারা, প্রথমদিকের বছরগুলোতে সবাই যৌথ খাদ্য ব্যাংকের জন্য খাদ্যশস্য দিত।
বদরখালী সমিতির সিনিয়র সদস্য কক্সবাজারের সিনিয়র জিএম আশেক উল্লাহ বলেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় ধর্মগোলা এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেছিল। তখন এই এলাকায় কেউ অনাহারে মারা যায়নি, কারণ সেসময় সমিতির প্রবীণ সদস্যরা আপতকালিন তহবিল হিসেবে প্রায় ১২০০ মণ চাল মজুদ করে রেখেছিলেন। যা সেসময় জনগণের মাঝে বিতরণ করা হয়।
সমিতির রেকর্ডপত্র বলছে, ১৯৩০ সালে মুসলিম শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সমিতি কয়েকটি মক্তব, ধর্মীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৫ সালে বদরখালী বহুমুখী (সরকারি) প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৯৪৫ সালে বদরখালী কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৫৪ সালে বদরখালী ফাজিল মাদ্রাসা এবং ১৯৯৩ সালে বদরখালী ডিগ্রি কলেজ স্থাপিত হয়।
এছাড়াও বর্তমানে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়, দুটি কলেজ এবং বেশ কয়েকটি মাদ্রাসাসহ এই এলাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় খরচাদির মধ্যে একটি বিশাল অংশ সমিতি থেকে দেওয়া হয়।
সমিতির সাবেক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, বদরখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সমিতির অর্থায়নে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন।
সরকার কর্তৃক এধরনের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার আগে সমিতি এই অঞ্চলের কোমলমতি শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করেছে। এলাকায় স্থাপিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুরো খরচ বহন করত সমিতি। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৮০% ভাগের বেশি। বদরখালীর বাসিন্দাদের জন্য সুদবিহীন শিক্ষা ঋণও দেন সমিতি। এছাড়া গরীব ও হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেও সহায়তা দেন বদরখালী সমিতি।
বদরখালী ইউনিয়নে বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, ১৯৭৭ সালে হাইস্কুলে পড়ার সময় ২০০০ টাকা এবং ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় ৫০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম আমি। পরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার পর কোনো সুদ ছাড়াই ঋণ পরিশোধ করেছিলাম।
যে সব পরিবার তাদের সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেছিল তাদের জন্য জমি বরাদ্দ দিত সমিতি এমনও সময় ছিল।
সরেজমিনে জানা গেছে, বদরখালী ইউনিয়নের স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। তবে প্রথমদিকে সমিতির অফিসে প্যারামেডিক ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো।
বর্তমানে বদরখালী ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড এলাকায় ৪৫টি মসজিদ, একটি মন্দির, ১৪টি মক্তব, ২০টি কবরস্থান এবং একটি শ্মশান আছে, সমিতির নিজস্ব খরচে এসব পরিচালিত হয়।
সমিতির সম্পাদক মঈন উদ্দিন বলেন, আমাদের এই সমিতি গেল ৯৩ বছরে ইউনিয়নের একটি মিনি সেক্রেটারিয়েটে পরিণত হয়েছে। এটি এখানকার অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও ধর্মীয় সকল অবকাঠামো নিয়ে কাজ করার কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সমিতির বর্তমান বার্ষিক ব্যয় হয় প্রায় ৮ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা। চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ১৯২৯ সালে বাস্তুহারা কিছু মানুষ এই সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যত জীবন নিয়ে আশার আলো দেখেছিলো। ৯৩ বছরে এসে আজ এই সমবায় সমিতি পুরো দেশের সমবায়ের জন্য একটি অনন্য মডেল প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডানা মেলেছে।
বদরখালীর লক্ষাধিক মানুষ আজ সত্যিকার অর্থে এই সমিতির বদৌলতে তাদের সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে।