টেকনাফ উপকূল এলাকায় ভাঙন -সংবাদ
বঙ্গোপসাগরের অব্যাহত ভাঙনে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূল প্রায় বিধ্বস্ত।
বিলীন হয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের নাফ-নদী, বেড়িবাঁধ, মেরিন ড্রাইভ সড়ক ও দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী বলে বার্তা দিচ্ছেন গবেষকরা।
কৃষি ও মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততায় জমি হারাচ্ছেন কৃষক
তাদের ভাষায়, সাগর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নেমে আসছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যার প্রভাবে প্রতি বছরই নেমে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এসব দুর্যোগে ভুগতে হচ্ছে উপকূলবাসীদের। তাদের জনজীবনে পড়ছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব।
জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি, মৎস ও বনভূমিতে।
ছয় ঋতু দেশ হলেও বর্তমানে গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল ও শীতকাল- তিন ঋতু দিয়ে বছর শেষ হচ্ছে। পাশাপাশি নাব্যতা হারিয়ে সাগর ও নদীর পানির গতিপথ পাল্টাচ্ছে।
বিপর্যস্ত কৃষি খাত
টেকনাফ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরেই লবণাক্ত পানির কারণে ২৩ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে এবং ২০২৪ সালে আরও ২০ হেক্টর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবছরই টানা বৃষ্টি ও সমুদ্রের উপকূলে অমাবস্যা ও নিম্নচাপের প্রভাবে নদ-নদীর পানি উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে লোকালয়ে লবণাক্ত পানি ঢুকে ফসলী জমি নষ্ট হয়। দিন দিন মাটিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, যার কারণে চাষাবাদ কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির শিকার ইউনিয়নগুলো হচ্ছে- সেন্টমার্টিন, সাবরাং, টেকনাফ সদর, বাহারছড়া।
উপজেলার বাহারছড়ার বাসিন্দা আজিজ উল্লাহ বলেন, আমরা যেহেতু বঙ্গোপসাগরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় চাষ করি, প্রতিবছরই বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সরাসরি ধান ক্ষেতে এসে পড়ে। এতে ধানের চারা জলেই ভেস্তে যায়।
লবণাক্ত বাতাস ও অতিবৃষ্টির কারণে মেরিন ড্রাইভের কালভার্ট দিয়ে পানি ঢুকে বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির সংবাদকে বলেন, প্রতিবছরই সমুদ্রের উপকূলে আমাবস্যা ও সাগরের সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয় প্লাবিত হয় লবণাক্ত পানিতে। এতে কৃষি জমিগুলো লবণ মাটিতে পরিণত হচ্ছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এলাকাগুলোতে লবণ সহিষ্ণু জাতের ধান কৃষকের হাতে পৌঁছে দিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা কৃষকদের লবণাক্ত সহনশীল ধানের জাত- বিআর-২৩, ব্রিধান-৪০, ৪১, ৫৩, ৫৪, ৭৩ ও ৭৮ এবং সবজি চাষে উৎসাহিত করছি। এবং কৃষকরা এ জাতের ধান চাষ করে লাভবানও হচ্ছে। উপকূলবর্তী অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের লবণাক্ততা থেকে পরিত্রাণে লবণসহিষ্ণু জাতের ধান, শাকসবজির বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে বলেও জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
মৎসখাতে ব্যাপক ক্ষতি
টেকনাফ উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমেই হুমকিতে পড়ছে চিংড়ি চাষ। নাফ নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। দূষিত হচ্ছে নাফ নদীর পানি। ফলে বাগদা চিংড়ি মাছের রেনু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরে যাচ্ছে। এ ছাড়া জোয়ারের স্বাভাবিক গতি কমছে। স্লুইসগেট দিয়ে পানি প্রবেশ ও বের করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় পানিতে লবণের মাত্রা কম দেখা যাচ্ছে। ফলে চিংড়ির মৃত্যু হার বাড়ছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পুকুর ভরাট হয়ে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে, এবং মৎস্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়ছেন জেলে ও মৎস্য খামারীরা।
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং বন্যায় পুকুরের পাড় ভেঙে গিয়ে, পুকুরের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পুকুরের পানি শুকিয়ে মৎস্য উৎপাদন হ্রাস হচ্ছে। বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পুকুরে বর্জ্য এবং দূষিত পদার্থ ঢুকে পড়ায় ঝুঁকিতে মাছের স্বাস্থ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাছের আবাসস্থল এবং প্রজনন ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, কিছু মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় মৎস্য উৎপাদনকারীরা।
সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও সাগরের সৃষ্ট নিম্নচাপে প্লাবিত হয়ে বিলীন হয়েগেছে শতশত চিংড়ি ঘের। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে চিংড়ি প্রজেক্টে প্রায় ১ দশমিক ২০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার মধ্যে টেকনাফ উপজেলায় ৮০০ হেক্টর জমিতে ২২০টি চিংড়ি ঘেরে ১ দশমিক ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে অতিবৃষ্টি ও আমাবস্যার জোয়ারে উপকূলীয় অঞ্চলের বৃষ্টিতে পুকুর প্লাবিত হয়ে ০ দশমিক ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
হোয়াইক্যাং চিংড়ি উৎপাদনকারীর সমবায় সমিতির সভাপতি শফিকুর রহমান বলেন, ২৫ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করে আসছি। আমার নিজের প্রজেক্টসহ পার্টনার ঘেরে চাষ করি প্রায় ৬ দশমিক ০৭ হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা আসার পরবর্তী সময় থেকে এ ব্যবসায় ক্ষতির মুখ দেখে আসছি। কারণ বর্ষার মৌসুমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ময়লা আবর্জনাগুলোসহ পানি নদীতে এসে পড়ে দূষিত হচ্ছে। ওই পানিগুলো চিংড়ি প্রজেক্টে ঢুকলে চিংড়ি মাছের রেনু ভাইরাসে আক্রান্ত হয় ও মরে যায়।
এ বছরে একক ও অংশীদারী ভিত্তিতে গড়া চিংড়ি খাতে আমার ৬০ লাখ টাকার অধিক লোকসান হতে পারে।
টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, টেকনাফ উপজেলা উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি বোঝা যাচ্ছে। আমাদের ঋতু ছিল ছয়টি, বর্তমানে হারিয়ে এখন আছে তিনটি, গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল ও শীতকাল। বাকী তিন ঋতু দিয়ে চাষিরা হুমকির মুখে।
তিনি আরো বলেন, ঘেরের পানির তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে চাষকৃত মাছ মারা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তীব্র তাপদাহে তাপমাত্রা ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে। আবার গরমের মধ্যেই বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা হঠাৎ করেই ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়। তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি ঘেরের মাছের ওপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
### হুমকিতে উপকূল :
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরে পানির উচ্চতা আগের তুলনায় বহুগুণে বেড়েছে। এ কারণে জোয়ারের পানি নিয়মিত আঘাত হানছে উপকূলের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ মেরিনড্রাইভসহ বিভিন্ন এলাকায়। জোয়ারের আঘাতে গত এক যুগে এসব উপকূলীয় এলাকার ন্যুনতম দুই হাজার একর এলাকা সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। এতে কয়েক হাজার পরিবারকে উদ্ধাস্তু হতে হয়।
সাগর উপকূলবর্তী এলাকায় জোয়ারের পানিতে অব্যাহত ভাঙনের কারণে এসব এলাকার টিকে থাকাই অনেকটা ঝুঁকিতে পড়েছে। বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করছেন।
## সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভাঙন :
সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ছে, প্রবালগুলো নষ্ট হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন এবং সাগরের আগ্রাসনে কিছু অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রতিবছরই সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে লবণাক্ত পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। সেন্টমার্টিনকে সাগরের অব্যাহত ভাঙন থেকে রক্ষা করতে সরকারের তেমন কোন উদ্যোগও চোখে পড়ছে না বলে জানান স্থানীয়রা।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, একসময় সেন্টমার্টিনে জোয়ারের পানি ঢুকতো না। কিন্তু গত কয়েক বছরে সাগরে পানির উচ্চতা বেড়ে জোয়ারের আঘাতে দ্বীপের বেশকিছু অংশে বড় ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড এ দ্বীপের চারিদিকে বেড়িবাঁধ দেয়ার চিন্তা করলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের বাঁধায় সেটিও হয়নি। চারিদিকে সাগর বেষ্টিত দ্বীপটি এখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত রয়েছে।
টেকনাফ উপকূল এলাকায় ভাঙন -সংবাদ
মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বঙ্গোপসাগরের অব্যাহত ভাঙনে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূল প্রায় বিধ্বস্ত।
বিলীন হয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের নাফ-নদী, বেড়িবাঁধ, মেরিন ড্রাইভ সড়ক ও দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী বলে বার্তা দিচ্ছেন গবেষকরা।
কৃষি ও মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততায় জমি হারাচ্ছেন কৃষক
তাদের ভাষায়, সাগর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নেমে আসছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যার প্রভাবে প্রতি বছরই নেমে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এসব দুর্যোগে ভুগতে হচ্ছে উপকূলবাসীদের। তাদের জনজীবনে পড়ছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব।
জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি, মৎস ও বনভূমিতে।
ছয় ঋতু দেশ হলেও বর্তমানে গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল ও শীতকাল- তিন ঋতু দিয়ে বছর শেষ হচ্ছে। পাশাপাশি নাব্যতা হারিয়ে সাগর ও নদীর পানির গতিপথ পাল্টাচ্ছে।
বিপর্যস্ত কৃষি খাত
টেকনাফ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরেই লবণাক্ত পানির কারণে ২৩ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে এবং ২০২৪ সালে আরও ২০ হেক্টর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবছরই টানা বৃষ্টি ও সমুদ্রের উপকূলে অমাবস্যা ও নিম্নচাপের প্রভাবে নদ-নদীর পানি উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে লোকালয়ে লবণাক্ত পানি ঢুকে ফসলী জমি নষ্ট হয়। দিন দিন মাটিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, যার কারণে চাষাবাদ কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির শিকার ইউনিয়নগুলো হচ্ছে- সেন্টমার্টিন, সাবরাং, টেকনাফ সদর, বাহারছড়া।
উপজেলার বাহারছড়ার বাসিন্দা আজিজ উল্লাহ বলেন, আমরা যেহেতু বঙ্গোপসাগরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় চাষ করি, প্রতিবছরই বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সরাসরি ধান ক্ষেতে এসে পড়ে। এতে ধানের চারা জলেই ভেস্তে যায়।
লবণাক্ত বাতাস ও অতিবৃষ্টির কারণে মেরিন ড্রাইভের কালভার্ট দিয়ে পানি ঢুকে বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির সংবাদকে বলেন, প্রতিবছরই সমুদ্রের উপকূলে আমাবস্যা ও সাগরের সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয় প্লাবিত হয় লবণাক্ত পানিতে। এতে কৃষি জমিগুলো লবণ মাটিতে পরিণত হচ্ছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এলাকাগুলোতে লবণ সহিষ্ণু জাতের ধান কৃষকের হাতে পৌঁছে দিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা কৃষকদের লবণাক্ত সহনশীল ধানের জাত- বিআর-২৩, ব্রিধান-৪০, ৪১, ৫৩, ৫৪, ৭৩ ও ৭৮ এবং সবজি চাষে উৎসাহিত করছি। এবং কৃষকরা এ জাতের ধান চাষ করে লাভবানও হচ্ছে। উপকূলবর্তী অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের লবণাক্ততা থেকে পরিত্রাণে লবণসহিষ্ণু জাতের ধান, শাকসবজির বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে বলেও জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
মৎসখাতে ব্যাপক ক্ষতি
টেকনাফ উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমেই হুমকিতে পড়ছে চিংড়ি চাষ। নাফ নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। দূষিত হচ্ছে নাফ নদীর পানি। ফলে বাগদা চিংড়ি মাছের রেনু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরে যাচ্ছে। এ ছাড়া জোয়ারের স্বাভাবিক গতি কমছে। স্লুইসগেট দিয়ে পানি প্রবেশ ও বের করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় পানিতে লবণের মাত্রা কম দেখা যাচ্ছে। ফলে চিংড়ির মৃত্যু হার বাড়ছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পুকুর ভরাট হয়ে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে, এবং মৎস্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়ছেন জেলে ও মৎস্য খামারীরা।
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং বন্যায় পুকুরের পাড় ভেঙে গিয়ে, পুকুরের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পুকুরের পানি শুকিয়ে মৎস্য উৎপাদন হ্রাস হচ্ছে। বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পুকুরে বর্জ্য এবং দূষিত পদার্থ ঢুকে পড়ায় ঝুঁকিতে মাছের স্বাস্থ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাছের আবাসস্থল এবং প্রজনন ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, কিছু মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় মৎস্য উৎপাদনকারীরা।
সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও সাগরের সৃষ্ট নিম্নচাপে প্লাবিত হয়ে বিলীন হয়েগেছে শতশত চিংড়ি ঘের। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে চিংড়ি প্রজেক্টে প্রায় ১ দশমিক ২০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার মধ্যে টেকনাফ উপজেলায় ৮০০ হেক্টর জমিতে ২২০টি চিংড়ি ঘেরে ১ দশমিক ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে অতিবৃষ্টি ও আমাবস্যার জোয়ারে উপকূলীয় অঞ্চলের বৃষ্টিতে পুকুর প্লাবিত হয়ে ০ দশমিক ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
হোয়াইক্যাং চিংড়ি উৎপাদনকারীর সমবায় সমিতির সভাপতি শফিকুর রহমান বলেন, ২৫ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করে আসছি। আমার নিজের প্রজেক্টসহ পার্টনার ঘেরে চাষ করি প্রায় ৬ দশমিক ০৭ হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা আসার পরবর্তী সময় থেকে এ ব্যবসায় ক্ষতির মুখ দেখে আসছি। কারণ বর্ষার মৌসুমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ময়লা আবর্জনাগুলোসহ পানি নদীতে এসে পড়ে দূষিত হচ্ছে। ওই পানিগুলো চিংড়ি প্রজেক্টে ঢুকলে চিংড়ি মাছের রেনু ভাইরাসে আক্রান্ত হয় ও মরে যায়।
এ বছরে একক ও অংশীদারী ভিত্তিতে গড়া চিংড়ি খাতে আমার ৬০ লাখ টাকার অধিক লোকসান হতে পারে।
টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, টেকনাফ উপজেলা উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি বোঝা যাচ্ছে। আমাদের ঋতু ছিল ছয়টি, বর্তমানে হারিয়ে এখন আছে তিনটি, গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল ও শীতকাল। বাকী তিন ঋতু দিয়ে চাষিরা হুমকির মুখে।
তিনি আরো বলেন, ঘেরের পানির তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে চাষকৃত মাছ মারা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তীব্র তাপদাহে তাপমাত্রা ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে। আবার গরমের মধ্যেই বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা হঠাৎ করেই ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়। তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি ঘেরের মাছের ওপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
### হুমকিতে উপকূল :
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরে পানির উচ্চতা আগের তুলনায় বহুগুণে বেড়েছে। এ কারণে জোয়ারের পানি নিয়মিত আঘাত হানছে উপকূলের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ মেরিনড্রাইভসহ বিভিন্ন এলাকায়। জোয়ারের আঘাতে গত এক যুগে এসব উপকূলীয় এলাকার ন্যুনতম দুই হাজার একর এলাকা সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। এতে কয়েক হাজার পরিবারকে উদ্ধাস্তু হতে হয়।
সাগর উপকূলবর্তী এলাকায় জোয়ারের পানিতে অব্যাহত ভাঙনের কারণে এসব এলাকার টিকে থাকাই অনেকটা ঝুঁকিতে পড়েছে। বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করছেন।
## সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভাঙন :
সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ছে, প্রবালগুলো নষ্ট হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন এবং সাগরের আগ্রাসনে কিছু অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রতিবছরই সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে লবণাক্ত পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। সেন্টমার্টিনকে সাগরের অব্যাহত ভাঙন থেকে রক্ষা করতে সরকারের তেমন কোন উদ্যোগও চোখে পড়ছে না বলে জানান স্থানীয়রা।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, একসময় সেন্টমার্টিনে জোয়ারের পানি ঢুকতো না। কিন্তু গত কয়েক বছরে সাগরে পানির উচ্চতা বেড়ে জোয়ারের আঘাতে দ্বীপের বেশকিছু অংশে বড় ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড এ দ্বীপের চারিদিকে বেড়িবাঁধ দেয়ার চিন্তা করলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের বাঁধায় সেটিও হয়নি। চারিদিকে সাগর বেষ্টিত দ্বীপটি এখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত রয়েছে।