জয়পুরহাট : কারখানায় স্তূপ করে রাখা শিলপাটা -সংবাদ
জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে অভাবের তাড়নায় নিশ্চিত মরণ জেনেও শিলপাটা তৈরির পেশায় জড়িয়ে পড়েছিলেন কয়েকশ হতদরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে দীর্ঘ সময় এ কাজ করে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় এ পেশা বন্ধ হলেও মৃত্যুর প্রহর গুনছেন বিগত সময়ে কাজ করা অনেক শ্রমিক। পাথরের ধুলা ও কণা গিয়ে ফুসফুস নষ্টসহ তাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। অনেকেই কাজকর্ম ও চিকিৎসা করাতে না পেরে পরিবার নিয়ে চরম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন। তাই এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন অসুস্থ ও মারা যাওয়া শ্রমিকদের পরিবারগুলো।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে আক্কেলপুর পৌর এলাকার চক্রপাড়াসহ উপজেলার কয়েকটি গ্রামে স্থানীয় কিছু মহাজন ভারত থেকে পাথর আমদানি করে হাতুড়ি ও ছেনি দিয়ে শিলপাটা তৈরি শুরু করেন, যা সারা দেশে ট্রাকযোগে সরবরাহ করা হতো। আর বেশি টাকার আশায় এ কাজে যুক্ত হন হতদরিদ্র শত শত মানুষ।
অসুস্থ শ্রমিক ও তাদের পরিবার জানায়, হাতুড়ি ও ছেনি দিয়ে পাথর খোদাই করার সময় নাক, মুখ ও লোমকূপ দিয়ে পাথরের কণা এবং ধুলা শরীরে প্রবেশ করে। এর কয়েক মাস পর থেকে ফুসফুসের সমস্যাসহ শরীরে বাসা বাঁধে নানা রোগ। শুধু চক্রপাড়া গ্রামেই এ কাজ করে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। আর উপজেলা জুড়ে এই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছেন শতাধিক মানুষ। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এ কাজ বন্ধ হয়েছে। তবে নানা রোগ নিয়ে এখনো মৃত্যুর প্রহর গুনছেন অনেকেই। অনেকেই কাজকর্ম ও চিকিৎসা করাতে না পেরে পরিবার নিয়ে চরম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন। তাই চিকিৎসাসহ সরকারের সহযোগিতা চান তারা।
চক্রপাড়া এলাকার সালাউদ্দিন বলেন, তিন-চার বছর হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে শিলপাটার কাজ করেছিলাম। শিলপাটার ধুলা নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে আমার ফুসফুস নষ্ট হয়ে গেছে, কিডনির সমস্যা হয়েছে। এখন পেট ফুলে উঠেছে। ২০০৯ সাল থেকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় আছি। উঠতে পারি না। ৪ বছর ধরে টাকার অভাবে কোনো চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আমাকে ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে। একই এলাকার মোস্তাফিজুর বলেন, আমি ১২ বছর শিলপাটার কাজ করেছি, বর্তমানে আমি অসুস্থ হয়েছি। আমাদের এলাকার শিলপাটা তৈরির কারিগররা বেশিরভাগ মারা গেছেন। অন্যান্য কারিগরদের মত আমারও ফুসফুস নষ্ট হয়ে গেছে। কাজকর্ম ও চলাফেরা কিছুই করতে পারি না। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না।’
ওই এলাকার বাসিন্দা আছমা বেগম বলেন, আমার দুই ছেলে শিলপাটার কাজ করে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। ছেলেদের শোকে আমার স্বামীও অসুস্থ হয়ে কিছুদিন পর মারা যায়। সংসারে উপার্জনের কেউ না থাকায় আমি এখন একা জীবনযাপন করছি। সরকারের সহযোগিতা চাই।
আক্কেলপুর পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র আবুল কালাম আজাদ বলেন, আক্কেলপুরে শিলপাটার কাজ করে বিভিন্ন রোগে অসুস্থ হয়ে শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। আমার নিজের বাড়ি চক্রপাড়া গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষ মারা গেছেন। বর্তমান প্রশাসনের তৎপরতায় ও আমাদের স্থানীয় মানুষদের সচেতনতার মাধ্যমে এই পেশা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে যারা বিগত সময়ে যারা এ কাজ করেছিলেন, তারা আজ অসুস্থ। তাদের পরিবারও চিকিৎসা করাতে পারছে না। সরকারের কাছে অনুরোধ করব এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
জয়পুরহাটের সিভিল সার্জন আল মামুন বলেন, শীলপাটা শ্রমিকদের নাক, মুখ ও শরীরের লোমকুপ দিয়ে পাথরের ধূলিকণা ঢুকে সর্দি, কাশি, হাঁসি, জ্বর হয়ে ধীরে ধীরে ফুসফুস অকার্যকর হয়ে মারা যাবে। আক্কেলপুর উপজেলায় শিলপাটার কাজ করে যেসব রোগী অসুস্থ আছেন তারা যাতে আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেন সে ব্যাপারে সহযোগিতা করব।
আক্কেলপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম বলেন, উপজেলায় একসময় অনেক পরিবার শিলপাটা তৈরির কাজ করতেন। এ কাজে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় ও পরিবেশ দূষণ হওয়ায় আমি শ্রমিকদের অনেক বুঝিয়ে এই কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। তাদের কৃষি প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করে আসছি। যারা অসুস্থ হয়ে আছেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আর ভবিষ্যতে যদি কেউ এমন কাজ করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জয়পুরহাট : কারখানায় স্তূপ করে রাখা শিলপাটা -সংবাদ
বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে অভাবের তাড়নায় নিশ্চিত মরণ জেনেও শিলপাটা তৈরির পেশায় জড়িয়ে পড়েছিলেন কয়েকশ হতদরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে দীর্ঘ সময় এ কাজ করে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় এ পেশা বন্ধ হলেও মৃত্যুর প্রহর গুনছেন বিগত সময়ে কাজ করা অনেক শ্রমিক। পাথরের ধুলা ও কণা গিয়ে ফুসফুস নষ্টসহ তাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। অনেকেই কাজকর্ম ও চিকিৎসা করাতে না পেরে পরিবার নিয়ে চরম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন। তাই এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন অসুস্থ ও মারা যাওয়া শ্রমিকদের পরিবারগুলো।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে আক্কেলপুর পৌর এলাকার চক্রপাড়াসহ উপজেলার কয়েকটি গ্রামে স্থানীয় কিছু মহাজন ভারত থেকে পাথর আমদানি করে হাতুড়ি ও ছেনি দিয়ে শিলপাটা তৈরি শুরু করেন, যা সারা দেশে ট্রাকযোগে সরবরাহ করা হতো। আর বেশি টাকার আশায় এ কাজে যুক্ত হন হতদরিদ্র শত শত মানুষ।
অসুস্থ শ্রমিক ও তাদের পরিবার জানায়, হাতুড়ি ও ছেনি দিয়ে পাথর খোদাই করার সময় নাক, মুখ ও লোমকূপ দিয়ে পাথরের কণা এবং ধুলা শরীরে প্রবেশ করে। এর কয়েক মাস পর থেকে ফুসফুসের সমস্যাসহ শরীরে বাসা বাঁধে নানা রোগ। শুধু চক্রপাড়া গ্রামেই এ কাজ করে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। আর উপজেলা জুড়ে এই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছেন শতাধিক মানুষ। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এ কাজ বন্ধ হয়েছে। তবে নানা রোগ নিয়ে এখনো মৃত্যুর প্রহর গুনছেন অনেকেই। অনেকেই কাজকর্ম ও চিকিৎসা করাতে না পেরে পরিবার নিয়ে চরম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন। তাই চিকিৎসাসহ সরকারের সহযোগিতা চান তারা।
চক্রপাড়া এলাকার সালাউদ্দিন বলেন, তিন-চার বছর হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে শিলপাটার কাজ করেছিলাম। শিলপাটার ধুলা নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে আমার ফুসফুস নষ্ট হয়ে গেছে, কিডনির সমস্যা হয়েছে। এখন পেট ফুলে উঠেছে। ২০০৯ সাল থেকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় আছি। উঠতে পারি না। ৪ বছর ধরে টাকার অভাবে কোনো চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আমাকে ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে। একই এলাকার মোস্তাফিজুর বলেন, আমি ১২ বছর শিলপাটার কাজ করেছি, বর্তমানে আমি অসুস্থ হয়েছি। আমাদের এলাকার শিলপাটা তৈরির কারিগররা বেশিরভাগ মারা গেছেন। অন্যান্য কারিগরদের মত আমারও ফুসফুস নষ্ট হয়ে গেছে। কাজকর্ম ও চলাফেরা কিছুই করতে পারি না। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না।’
ওই এলাকার বাসিন্দা আছমা বেগম বলেন, আমার দুই ছেলে শিলপাটার কাজ করে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। ছেলেদের শোকে আমার স্বামীও অসুস্থ হয়ে কিছুদিন পর মারা যায়। সংসারে উপার্জনের কেউ না থাকায় আমি এখন একা জীবনযাপন করছি। সরকারের সহযোগিতা চাই।
আক্কেলপুর পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র আবুল কালাম আজাদ বলেন, আক্কেলপুরে শিলপাটার কাজ করে বিভিন্ন রোগে অসুস্থ হয়ে শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। আমার নিজের বাড়ি চক্রপাড়া গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষ মারা গেছেন। বর্তমান প্রশাসনের তৎপরতায় ও আমাদের স্থানীয় মানুষদের সচেতনতার মাধ্যমে এই পেশা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে যারা বিগত সময়ে যারা এ কাজ করেছিলেন, তারা আজ অসুস্থ। তাদের পরিবারও চিকিৎসা করাতে পারছে না। সরকারের কাছে অনুরোধ করব এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
জয়পুরহাটের সিভিল সার্জন আল মামুন বলেন, শীলপাটা শ্রমিকদের নাক, মুখ ও শরীরের লোমকুপ দিয়ে পাথরের ধূলিকণা ঢুকে সর্দি, কাশি, হাঁসি, জ্বর হয়ে ধীরে ধীরে ফুসফুস অকার্যকর হয়ে মারা যাবে। আক্কেলপুর উপজেলায় শিলপাটার কাজ করে যেসব রোগী অসুস্থ আছেন তারা যাতে আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেন সে ব্যাপারে সহযোগিতা করব।
আক্কেলপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম বলেন, উপজেলায় একসময় অনেক পরিবার শিলপাটা তৈরির কাজ করতেন। এ কাজে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় ও পরিবেশ দূষণ হওয়ায় আমি শ্রমিকদের অনেক বুঝিয়ে এই কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। তাদের কৃষি প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করে আসছি। যারা অসুস্থ হয়ে আছেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আর ভবিষ্যতে যদি কেউ এমন কাজ করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।