বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা-বাগান ও পাহাড়ি এলাকায় একটি ক্ষুদ্র, প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠী খারিয়া আজ অস্তিত্ব সংকটে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে আনা এ জনগোষ্ঠী এখন মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার বিভিন্ন চা-বাগানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
খারিয়া ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ভাষা। কিন্তু এখন এ ভাষা এবং তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি জাতীয় জীবনের মূলস্রোতে মিশে গিয়ে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে।
খারিয়া জনগোষ্ঠী মূলত পূর্ব-মধ্য ভারতের একটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। তারা তিনটি উপ-গোষ্ঠীতে বিভক্ত- দুধ খারিয়া, ঢেলকি খারিয়া ও পাহাড়ি খারিয়া। এদের মধ্যে দুধ খারিয়ারা শিক্ষাগতভাবে এগিয়ে।
ভাষাবিজ্ঞানী পল সিডওয়েলের মতে, প্রায় ৪০০০ বছর আগে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ভারতের ওড়িশা উপকূলে এসে পৌঁছায় এবং পরে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে যায়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫০০ সালের মধ্যে ঝাড়খ-, ছত্তিশগড়, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের আদিম বন-অঞ্চলে খারিয়া ভাষার বিকাশ ঘটে। পরবর্তীতে ভাষাভাষীরা বিস্তৃতভাবে পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে ভারতের ঝাড়খ- রাজ্যে খারিয়া ভাষা প্রচলিত, পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার কিছু অংশেও এ ভাষায় কথা বলা হয়। ২০১১ সালের ভারতীয় জন গণনা অনুযায়ী, প্রায় ৪,২০,০০০ মানুষ খারিয়া ভাষায় কথা বলতেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক ৫,৭০০ খারিয়া জনগণ বাস করেন, ছড়িয়ে আছেন সিলেট অঞ্চলের ৪১টি পল্লীতে। তবে এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলার সংখ্যা চরমভাবে কমে গেছে।
বর্তমানে দেশে খারিয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র দুইজনÑ মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্মাছড়া চা বাগানের দুই বোন, ক্রিস্টিনা কেরকেট্টা (৭৫) ও ভেরোনিকা কেরকেট্টা (৮০)। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে খারিয়া ভাষার ব্যবহার একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
খারিয়ার নতুন প্রজন্ম মূলত সাদ্রি, বাংলা, হিন্দি ও স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। খারিয়া ভাষায় কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা, পাঠ্যবই বা সরকারি স্বীকৃতি নেই। শিশুরা বাংলায় পড়াশোনা করে, ফলে মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
দারিদ্র্য, অশিক্ষা, চাকরি বা উচ্চশিক্ষায় ভাষার অপ্রয়োগ এসব বাস্তবতা তাদের ভাষা চর্চার সুযোগ ও আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। অনেক অভিভাবক সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাংলা ও ইংরেজি শেখাতে উৎসাহিত করছেন।
সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও ভাটা পড়েছে। লোকসংগীত, পালা-পার্বণ, গল্প বলাÑ এসব ক্ষেত্র থেকে খারিয়া ভাষা সরে গেছে। অনেক তরুণ-তরুণী নিজেদের খারিয়া পরিচয় গোপন রাখেন মূলধারার সমাজে বৈষম্যের আশঙ্কায়।
বাংলাদেশে খারিয়া ভাষার কোনো নির্দিষ্ট বর্ণমালা বা লিখিত রূপ নেই। ভারতে দেবনাগরী, ওড়িয়া বা ল্যাটিন লিপিতে খারিয়া ভাষা লেখা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে এ ভাষার লিখিত সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগই নেই।
এ বাস্তবতা খারিয়া ভাষার দ্রুত বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা-বাগান ও পাহাড়ি এলাকায় একটি ক্ষুদ্র, প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠী খারিয়া আজ অস্তিত্ব সংকটে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে আনা এ জনগোষ্ঠী এখন মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার বিভিন্ন চা-বাগানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
খারিয়া ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ভাষা। কিন্তু এখন এ ভাষা এবং তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি জাতীয় জীবনের মূলস্রোতে মিশে গিয়ে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে।
খারিয়া জনগোষ্ঠী মূলত পূর্ব-মধ্য ভারতের একটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। তারা তিনটি উপ-গোষ্ঠীতে বিভক্ত- দুধ খারিয়া, ঢেলকি খারিয়া ও পাহাড়ি খারিয়া। এদের মধ্যে দুধ খারিয়ারা শিক্ষাগতভাবে এগিয়ে।
ভাষাবিজ্ঞানী পল সিডওয়েলের মতে, প্রায় ৪০০০ বছর আগে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ভারতের ওড়িশা উপকূলে এসে পৌঁছায় এবং পরে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে যায়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫০০ সালের মধ্যে ঝাড়খ-, ছত্তিশগড়, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের আদিম বন-অঞ্চলে খারিয়া ভাষার বিকাশ ঘটে। পরবর্তীতে ভাষাভাষীরা বিস্তৃতভাবে পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে ভারতের ঝাড়খ- রাজ্যে খারিয়া ভাষা প্রচলিত, পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার কিছু অংশেও এ ভাষায় কথা বলা হয়। ২০১১ সালের ভারতীয় জন গণনা অনুযায়ী, প্রায় ৪,২০,০০০ মানুষ খারিয়া ভাষায় কথা বলতেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক ৫,৭০০ খারিয়া জনগণ বাস করেন, ছড়িয়ে আছেন সিলেট অঞ্চলের ৪১টি পল্লীতে। তবে এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলার সংখ্যা চরমভাবে কমে গেছে।
বর্তমানে দেশে খারিয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র দুইজনÑ মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্মাছড়া চা বাগানের দুই বোন, ক্রিস্টিনা কেরকেট্টা (৭৫) ও ভেরোনিকা কেরকেট্টা (৮০)। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে খারিয়া ভাষার ব্যবহার একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
খারিয়ার নতুন প্রজন্ম মূলত সাদ্রি, বাংলা, হিন্দি ও স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। খারিয়া ভাষায় কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা, পাঠ্যবই বা সরকারি স্বীকৃতি নেই। শিশুরা বাংলায় পড়াশোনা করে, ফলে মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
দারিদ্র্য, অশিক্ষা, চাকরি বা উচ্চশিক্ষায় ভাষার অপ্রয়োগ এসব বাস্তবতা তাদের ভাষা চর্চার সুযোগ ও আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। অনেক অভিভাবক সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাংলা ও ইংরেজি শেখাতে উৎসাহিত করছেন।
সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও ভাটা পড়েছে। লোকসংগীত, পালা-পার্বণ, গল্প বলাÑ এসব ক্ষেত্র থেকে খারিয়া ভাষা সরে গেছে। অনেক তরুণ-তরুণী নিজেদের খারিয়া পরিচয় গোপন রাখেন মূলধারার সমাজে বৈষম্যের আশঙ্কায়।
বাংলাদেশে খারিয়া ভাষার কোনো নির্দিষ্ট বর্ণমালা বা লিখিত রূপ নেই। ভারতে দেবনাগরী, ওড়িয়া বা ল্যাটিন লিপিতে খারিয়া ভাষা লেখা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে এ ভাষার লিখিত সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগই নেই।
এ বাস্তবতা খারিয়া ভাষার দ্রুত বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।