নদীর বুক চিরে ভোরের কুয়াশা পেরিয়ে ছোট ছোট ডিঙি ভেসে চলে কত স্বপ্নের বোঝা নিয়ে। এ ডিঙিতে নেই কোনো মাঝি, নেই কোনো নিরাপত্তা, তবু প্রতিদিন সেই পথেই ছুটে চলে গ্রামের শিশুরা। চোখে স্বপ্ন, বুকভরা সাহস, হাতে শুধু বইখাতা। স্কুলে পৌঁছানোর তাগিদ যেন ভয়কেও হার মানায়। প্রতিদিন সকাল হলেই মায়ের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নদীর ওপার পর্যন্ত ছুটে শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রতিদিনের স্কুলযাত্রা যেমন বইখাতা নিয়ে স্কুলে যায়, তেমনি তাদের হৃদয়ে গাঁথা থাকে কতটা আশা, কতটা স্বপ্ন। এই ছোট্ট জীবনযাত্রা যেন এক মাঝিবিহীন ডিঙির মতো, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান, মনোভাব এবং আবেগের রাতে নিয়ে এক অজানা পথে চলতে থাকে।
তাদের চোখে থাকে হাজারও স্বপ্ন, প্রতিটি মুহূর্তে তারা নতুন কিছু শিখতে চায়, এগিয়ে যেতে চায়। মাঝিবিহীন সেই ডিঙি নৌকা যেন তাদের জীবনের প্রথম যাত্রা, যেখানে প্রতিটি তরীভাঙা ঢেউ, প্রতিটি ঝড়, প্রতিটি পাথর তাদের আরও দৃঢ় করে তোলে।
রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া শিবনদীর পাড়ে ১২০ বছর আগে কেশরহাট পৌর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নিজ গ্রামে কোনো বিদ্যালয় নেই বলে এভাবেই নদী পার হয়ে বিদ্যালয়ে আসে পার্শ্ববর্তী মালিদহ ও গোপইল গ্রামের শিক্ষার্থীরা। ১০ কিলোমিটারের মধ্যে নেই বিকল্প কোনো সড়ক পথ। এভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হয়। এতে করে প্রতিনয়ত আতঙ্কে থাকেন তাদের অভিভাবক।
জনপ্রতিনিধি বদলালেও আজো বদলায়নি এসব গ্রামের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের চিত্র। কেটেছে ১০টি যুগ, তবুও শিক্ষার্থীদের স্কুলের ঝুঁকিপথ নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যদিও নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর।
গত বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের অপর প্রান্তে একে একে জড়ো হচ্ছিল ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। নদীর মাঝখানে রয়েছে একটি মাত্র ডিঙি নৌকা। নেই কোনো মাঝি। নৌকার দুপাশে শেকলের সঙ্গে দুই পাশে বাধা লম্বা নাইলনের রশি। রশির দুই মাথা ১০০ গজ প্রস্থের নদী পাড়ের দুই গাছের সঙ্গে বাধা। অভিভাবক ছাড়াই শিশু শিক্ষার্থীরা নৌকায় চেপে রশি টেনে বিদ্যালয় প্রান্তে আসছিল। নদী পারের সময় তোমাদের কি ভয় হয়? শিক্ষার্থীরা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলছিল- ‘হ্যাঁ আমাদের খুব ভয় লাগে। আগে এখানে বাঁশের ব্রিজ ছিল এখন তাও নাই। কেউ কেউ নৌকা থেকে পড়ে যায়, তখন আরো ভয় লাগে।’ সর্বশেষ ১৭ সেপ্টম্বর তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্র নৌকা থেকে নদীতে পড়ে যায়। তখন আমরা তার হাত ধরে চিৎকার করছিলাম- পরে মানুষ এসে তাকে উপরে তোলে। সে এখান থেকে স্কুলে না গিয়ে বাড়ি চলে যায়।
নৌকাতে নদী পারাপারের সময় কথা হয় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাললের ছাত্র ফারুকের সঙ্গে। সেসহ আরও ছয়জন উঠেছেন ওই নৌকায়। সঙ্গে ছিলে তাদের বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরীন আক্তার।
স্কুল ছাত্র ফারুক বলে- একা একা নৌকায় উঠে নদী পার হতে ভয় লাগে। মাঝে গিয়ে রাতে নৌকায় পূর্বদিকে চলে যায়। তখন রশি টেনে পাড়ে আসতে কষ্ট হয়। সকালে প্রাইভেটের জন্য বাবা নদী পার করে দেয়। প্রাইভেট শেষে নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অনেক সময় মা আসে। বেশির ভাগ সময় এলাকার মানুষদের দেখা পেলে ডাকলেও তারা নদী পার করে দেন। গত বুধবারেই আমাদের ক্লাসের এক ছাত্র রশিতে প্যাচ লেগে নৌকা থেকে নদীতে পাড়ে যায়।
শিক্ষার্থী সম্পা খাতুন বলেন, এই নদীতে সময় পানি থাকে। সবসময় নৌকায় পাড় হতে হয়। বৃষ্টির সময় পাড় থেকে নদীতে নামতে গিয়ে পড়ে যাই। অনেকে নৌকা থেকেও পড়ে যায়। বই-খাতা ভিজে যায়। তখন আমাদের পড়াশোনা করতে কষ্ট হয়। নদীতে তেমন রাতে না থাকলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পারাপারে ঝুকির কথা উলেখ করে স্কুলের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার। তিনি বলেন, এখন রাতে নেই। তবে কিছুদিন আগে ভালো রাতে ছিল। সেই সময় ডিঙি নৌকায় পারাপার কষ্টকর হয়। আমরা বড় মানুষ নৌকা নিয়ে নদী পার হতে ভয় পাই। ছোট মানুষ তো আরও ভয় পাবে। এখানে বাঁশের সাঁকো ছিল। সেটি ভেঙে গেছে। অনাকাক্ষিত দুর্ঘটনা ছাড়ায় চলাচলের সুবিধার জন্য এখানে ব্রিজ হলে শিক্ষার্থীসহ হাজারও মানুষের ভোগান্তি কমবে।
জানা গেছে, ১০০ গজ দৈর্ঘ্যের শিব নদী পরাপারের জন্য একসম ছিল বাঁশের সাঁকো। দীর্ঘদিনের সাঁকো ভেঙে যাওয়ায় পারাপারে মাত্র ভরসা ডিঙি নৌকা। তাতে দিনভর শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার মানুষ পারাপার হয়। নদী পাড়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা ছাড়াও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ডিঙি নৌকা থেকে পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয় বলছেন- শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও এলাকার মানুষ।
শিব নদীর দক্ষিণ পাড়ে মালিদহ ও গোপইল গ্রাম। আর উত্তর পাড়ে নওগাঁ গ্রাম। পাশাপাশি দুই গ্রামের জন্য রয়েছে শুধু নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একারণে তিন গ্রামের শিক্ষার্থী নিয়মিত পড়ে এ বিদ্যালয়ে। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কয়েক বছরের ব্যবধানে কমে গেছে। ২০০জন শিক্ষার্থী কমে দাঁড়িয়েছে ১১৮ জনে। তাদের মধ্যে ৬২ জন ছেলে ও ৫৬ জন মেয়ে। ফলে শিশুকালেই বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ছে অনেকেই।
বিদ্যালয়টির শিক্ষক নাসিমা খাতুন বলছেন, বাঁশের সাঁকো থাকা অবস্থাতেও স্কুলে ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু বাঁশের সাঁকোটা ভেঙে যাওয়ার পরে নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে স্কুলে শিক্ষার্থী পাঠায় না অভিভাবকরা। অভিবাকরা শিক্ষকদের জানায়- নদী পার হতে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা পানিতে পড়ে যায়। প্রাণহানীর ঝুঁকি থাকায় তারা দূরের স্কুলে ভর্তি করেছে ছেলে-মেয়েকে।
শিক্ষার্থীর অভিভাবক নূরেসা বেগম বলেন, স্কুলের শিক্ষক, পিয়ন নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা নৌকায় বাধা রশি টেনে ছাত্র-ছাত্রীদের পার করে নেয়। বুধবার চতুর্থ শ্রেণির একছাত্র নদীতে পড়ে যায়। তখন অন্য সহপাঠীরা তাকে পানিতে ধরে ফেলে। পরে মানুষ গিয়ে তাকে পাড়ে নিয়ে আসে। আমাদের সবসময় মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা নিয়ে থাকতে হয় ছেলে-মেয়ের স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে আসা নিয়ে।
অভিভাবক শহিদুল ইসলাম বলেন, সকালে সঙ্গে করে নিয়ে এসে নদী পার করে দিতে হয়। আবার দুপুরে টিফিনের সময় বাড়ির কাজ ফেলে এসে নদীপাড়ে বসে থাকতে হয়। একইভাবে বিকেলে ছুটির সময় নদীপাড়ে অপেক্ষায় থাকি। ছেলে-মেয়ে আসলে তাদের নদী পার করে নিই। অনেক সময় স্কুলের শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের নদীপার করে দেন। স্কুলে যেতে এই নদী পারাপারের কারণে অনেকেই অন্য স্কুলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছেন। এই স্কুলটা কাছে হয়। আর পড়াশোনা ভালো। তাই এখানেই রেখেছি মেয়েকে। আমাদের দাবি- এখানে একটা ব্রিজ হলে চার-পাঁচ গ্রামের মানুষের উপকার হবে। কেশরহাটের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হবে। ফলে ছেলে-মেয়েরা ৭/৮ কিলোমিটার পথ না ঘুরে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তফা হোসেন জানান, , প্রতিদিন প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী নৌকায় চড়ে আসে। তারা সবাই ছোট মানুষ। দুর্ঘটনার ভয় সব সময়ই থাকে। এ কারণে অভিভাবকেরা সন্তানদের অন্য স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। আগে শিক্ষার্থী ছিল দুই শতাধিক, এখন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। ইতোপুর্বে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছি। এলজিইডি অফিস একাধিকবার পরিদর্শন শেষে মেপেও গেছেন। জরুরি ভাবে ব্রিজটি না হলে স্কুল ছেড়ে চলে যাচ্ছে অনেকেই। এদের মধ্যে অনেকেই লেখাপড়া একেবারেই বাদ দিয়েছে।
শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নদীর বুক চিরে ভোরের কুয়াশা পেরিয়ে ছোট ছোট ডিঙি ভেসে চলে কত স্বপ্নের বোঝা নিয়ে। এ ডিঙিতে নেই কোনো মাঝি, নেই কোনো নিরাপত্তা, তবু প্রতিদিন সেই পথেই ছুটে চলে গ্রামের শিশুরা। চোখে স্বপ্ন, বুকভরা সাহস, হাতে শুধু বইখাতা। স্কুলে পৌঁছানোর তাগিদ যেন ভয়কেও হার মানায়। প্রতিদিন সকাল হলেই মায়ের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নদীর ওপার পর্যন্ত ছুটে শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রতিদিনের স্কুলযাত্রা যেমন বইখাতা নিয়ে স্কুলে যায়, তেমনি তাদের হৃদয়ে গাঁথা থাকে কতটা আশা, কতটা স্বপ্ন। এই ছোট্ট জীবনযাত্রা যেন এক মাঝিবিহীন ডিঙির মতো, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান, মনোভাব এবং আবেগের রাতে নিয়ে এক অজানা পথে চলতে থাকে।
তাদের চোখে থাকে হাজারও স্বপ্ন, প্রতিটি মুহূর্তে তারা নতুন কিছু শিখতে চায়, এগিয়ে যেতে চায়। মাঝিবিহীন সেই ডিঙি নৌকা যেন তাদের জীবনের প্রথম যাত্রা, যেখানে প্রতিটি তরীভাঙা ঢেউ, প্রতিটি ঝড়, প্রতিটি পাথর তাদের আরও দৃঢ় করে তোলে।
রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া শিবনদীর পাড়ে ১২০ বছর আগে কেশরহাট পৌর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নিজ গ্রামে কোনো বিদ্যালয় নেই বলে এভাবেই নদী পার হয়ে বিদ্যালয়ে আসে পার্শ্ববর্তী মালিদহ ও গোপইল গ্রামের শিক্ষার্থীরা। ১০ কিলোমিটারের মধ্যে নেই বিকল্প কোনো সড়ক পথ। এভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হয়। এতে করে প্রতিনয়ত আতঙ্কে থাকেন তাদের অভিভাবক।
জনপ্রতিনিধি বদলালেও আজো বদলায়নি এসব গ্রামের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের চিত্র। কেটেছে ১০টি যুগ, তবুও শিক্ষার্থীদের স্কুলের ঝুঁকিপথ নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যদিও নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর।
গত বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের অপর প্রান্তে একে একে জড়ো হচ্ছিল ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। নদীর মাঝখানে রয়েছে একটি মাত্র ডিঙি নৌকা। নেই কোনো মাঝি। নৌকার দুপাশে শেকলের সঙ্গে দুই পাশে বাধা লম্বা নাইলনের রশি। রশির দুই মাথা ১০০ গজ প্রস্থের নদী পাড়ের দুই গাছের সঙ্গে বাধা। অভিভাবক ছাড়াই শিশু শিক্ষার্থীরা নৌকায় চেপে রশি টেনে বিদ্যালয় প্রান্তে আসছিল। নদী পারের সময় তোমাদের কি ভয় হয়? শিক্ষার্থীরা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলছিল- ‘হ্যাঁ আমাদের খুব ভয় লাগে। আগে এখানে বাঁশের ব্রিজ ছিল এখন তাও নাই। কেউ কেউ নৌকা থেকে পড়ে যায়, তখন আরো ভয় লাগে।’ সর্বশেষ ১৭ সেপ্টম্বর তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্র নৌকা থেকে নদীতে পড়ে যায়। তখন আমরা তার হাত ধরে চিৎকার করছিলাম- পরে মানুষ এসে তাকে উপরে তোলে। সে এখান থেকে স্কুলে না গিয়ে বাড়ি চলে যায়।
নৌকাতে নদী পারাপারের সময় কথা হয় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাললের ছাত্র ফারুকের সঙ্গে। সেসহ আরও ছয়জন উঠেছেন ওই নৌকায়। সঙ্গে ছিলে তাদের বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরীন আক্তার।
স্কুল ছাত্র ফারুক বলে- একা একা নৌকায় উঠে নদী পার হতে ভয় লাগে। মাঝে গিয়ে রাতে নৌকায় পূর্বদিকে চলে যায়। তখন রশি টেনে পাড়ে আসতে কষ্ট হয়। সকালে প্রাইভেটের জন্য বাবা নদী পার করে দেয়। প্রাইভেট শেষে নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অনেক সময় মা আসে। বেশির ভাগ সময় এলাকার মানুষদের দেখা পেলে ডাকলেও তারা নদী পার করে দেন। গত বুধবারেই আমাদের ক্লাসের এক ছাত্র রশিতে প্যাচ লেগে নৌকা থেকে নদীতে পাড়ে যায়।
শিক্ষার্থী সম্পা খাতুন বলেন, এই নদীতে সময় পানি থাকে। সবসময় নৌকায় পাড় হতে হয়। বৃষ্টির সময় পাড় থেকে নদীতে নামতে গিয়ে পড়ে যাই। অনেকে নৌকা থেকেও পড়ে যায়। বই-খাতা ভিজে যায়। তখন আমাদের পড়াশোনা করতে কষ্ট হয়। নদীতে তেমন রাতে না থাকলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পারাপারে ঝুকির কথা উলেখ করে স্কুলের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার। তিনি বলেন, এখন রাতে নেই। তবে কিছুদিন আগে ভালো রাতে ছিল। সেই সময় ডিঙি নৌকায় পারাপার কষ্টকর হয়। আমরা বড় মানুষ নৌকা নিয়ে নদী পার হতে ভয় পাই। ছোট মানুষ তো আরও ভয় পাবে। এখানে বাঁশের সাঁকো ছিল। সেটি ভেঙে গেছে। অনাকাক্ষিত দুর্ঘটনা ছাড়ায় চলাচলের সুবিধার জন্য এখানে ব্রিজ হলে শিক্ষার্থীসহ হাজারও মানুষের ভোগান্তি কমবে।
জানা গেছে, ১০০ গজ দৈর্ঘ্যের শিব নদী পরাপারের জন্য একসম ছিল বাঁশের সাঁকো। দীর্ঘদিনের সাঁকো ভেঙে যাওয়ায় পারাপারে মাত্র ভরসা ডিঙি নৌকা। তাতে দিনভর শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার মানুষ পারাপার হয়। নদী পাড়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা ছাড়াও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ডিঙি নৌকা থেকে পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয় বলছেন- শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও এলাকার মানুষ।
শিব নদীর দক্ষিণ পাড়ে মালিদহ ও গোপইল গ্রাম। আর উত্তর পাড়ে নওগাঁ গ্রাম। পাশাপাশি দুই গ্রামের জন্য রয়েছে শুধু নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একারণে তিন গ্রামের শিক্ষার্থী নিয়মিত পড়ে এ বিদ্যালয়ে। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কয়েক বছরের ব্যবধানে কমে গেছে। ২০০জন শিক্ষার্থী কমে দাঁড়িয়েছে ১১৮ জনে। তাদের মধ্যে ৬২ জন ছেলে ও ৫৬ জন মেয়ে। ফলে শিশুকালেই বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ছে অনেকেই।
বিদ্যালয়টির শিক্ষক নাসিমা খাতুন বলছেন, বাঁশের সাঁকো থাকা অবস্থাতেও স্কুলে ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু বাঁশের সাঁকোটা ভেঙে যাওয়ার পরে নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে স্কুলে শিক্ষার্থী পাঠায় না অভিভাবকরা। অভিবাকরা শিক্ষকদের জানায়- নদী পার হতে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা পানিতে পড়ে যায়। প্রাণহানীর ঝুঁকি থাকায় তারা দূরের স্কুলে ভর্তি করেছে ছেলে-মেয়েকে।
শিক্ষার্থীর অভিভাবক নূরেসা বেগম বলেন, স্কুলের শিক্ষক, পিয়ন নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা নৌকায় বাধা রশি টেনে ছাত্র-ছাত্রীদের পার করে নেয়। বুধবার চতুর্থ শ্রেণির একছাত্র নদীতে পড়ে যায়। তখন অন্য সহপাঠীরা তাকে পানিতে ধরে ফেলে। পরে মানুষ গিয়ে তাকে পাড়ে নিয়ে আসে। আমাদের সবসময় মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা নিয়ে থাকতে হয় ছেলে-মেয়ের স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে আসা নিয়ে।
অভিভাবক শহিদুল ইসলাম বলেন, সকালে সঙ্গে করে নিয়ে এসে নদী পার করে দিতে হয়। আবার দুপুরে টিফিনের সময় বাড়ির কাজ ফেলে এসে নদীপাড়ে বসে থাকতে হয়। একইভাবে বিকেলে ছুটির সময় নদীপাড়ে অপেক্ষায় থাকি। ছেলে-মেয়ে আসলে তাদের নদী পার করে নিই। অনেক সময় স্কুলের শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের নদীপার করে দেন। স্কুলে যেতে এই নদী পারাপারের কারণে অনেকেই অন্য স্কুলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছেন। এই স্কুলটা কাছে হয়। আর পড়াশোনা ভালো। তাই এখানেই রেখেছি মেয়েকে। আমাদের দাবি- এখানে একটা ব্রিজ হলে চার-পাঁচ গ্রামের মানুষের উপকার হবে। কেশরহাটের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হবে। ফলে ছেলে-মেয়েরা ৭/৮ কিলোমিটার পথ না ঘুরে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তফা হোসেন জানান, , প্রতিদিন প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী নৌকায় চড়ে আসে। তারা সবাই ছোট মানুষ। দুর্ঘটনার ভয় সব সময়ই থাকে। এ কারণে অভিভাবকেরা সন্তানদের অন্য স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। আগে শিক্ষার্থী ছিল দুই শতাধিক, এখন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। ইতোপুর্বে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছি। এলজিইডি অফিস একাধিকবার পরিদর্শন শেষে মেপেও গেছেন। জরুরি ভাবে ব্রিজটি না হলে স্কুল ছেড়ে চলে যাচ্ছে অনেকেই। এদের মধ্যে অনেকেই লেখাপড়া একেবারেই বাদ দিয়েছে।