এভাবেই কন্যার ছবি বুকে জড়িয়ে মায়ের আর্তনাদ -সংবাদ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়- সেই আন্দোলনে মারা যাওয়া কনিষ্ঠ শহীদ ছয় বছরের ছোট্ট শিশু রিয়া গোপ। একবছর পার হলেও তাদের বাড়িটাই যেনো বেদনায় নীল। অথচ চারপাশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আনন্দ। নতুন পোশাক, সজ্জা, সাজসজ্জার বাহার আর আলোকসজ্জা, কাসর ঘণ্টা এবং ঢোলের তালে চারপাশ ঝলমল করছে। কিন্তু সবকিছুই ম্লান রিয়া গোপের বাড়িতে। সব আনন্দই বিষাদ শিশু রিয়ার মা-বাবার কাছে।
ওরে রাইখা কোথাও যাইতাম না। আজকে আমার মেয়ে আমারে রাইখা কই রইলো? কান্নায় ভেঙে পড়েন রিয়ার মা
নিস্তব্ধতায় তাদের ঘর শুধুই ইট-পাথরের কোটা, যেনো নেই কোনো প্রাণ। অন্য সবার ঘরে পূজার উচ্ছ্বাস থাকলেও গোপ পরিবারে এখনও শোকের ছায়া। বার বারই জেগে উঠে তাদের হৃদয়ের শূন্যতা।
রিয়া শহরের নয়ামাটি এলাকার দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষ দম্পতির একমাত্র সন্তান। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন নিজ বাড়ির ছাদে খেলা করার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শিশুটি। শহরের ব্যস্ততম এলাকার একটি চার তলা ভবনে থাকেন রিয়ার পরিবার। বাবা দীপক কুমার গোপ বাসায় ছিলেন না। একটি কক্ষে বসে ছিলেন রিয়ার ঠাকুমা। একটু পরে আসলেন মা বিউটি ঘোষ।
বাড়ির একপাশে একটি মন্দির ও অন্যপাশে নয়ামাটি পূজামণ্ডপ। পূজা উপলক্ষে আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে পুরো এলাকা। কিন্তু এ উৎসবের কোনো রেশ নেই রিয়ার পরিবারের সদস্যদের। তাদের বাড়িতে এখনও শোকের নীরবতা। সময় যেন থমকে গেছে তাদের।
কন্যার কথা উঠতেই কেঁদে ওঠেন বিউটি। বিগত বছরগুলোতে রিয়াকে ঘিরেই ছিল তাদের সব আয়োজন। নানা আবদার পূরণেই ব্যস্ত থাকতে হতো দীপক-বিউটি দম্পতির।
বিউটি বলেন, ‘আমরা কেউই ভালো নেই। শরীর-মন কোনো কিছুই ভালো নাই। অনেক কষ্টে দিন কাটাইতাসি। কিছুই ভালো লাগে না। আমি আমার মেয়ের মায়া ছাড়তে পারছি না। ওর ডাক ছাড়তে পারছি না। ওর আদুরে আদুরে কথা আমি ভুলতে পারছি না, কিচ্ছু ভুলতে পারছি না।’
কথার মধ্যেই ‘সোনা মারে, সোনা মা, তুই কই গেলি সোনা মা’ বলে আহাজার শুরু করেন সন্তানহারা এ নারী।
বাড়ির পাশেই মণ্ডপে উৎসবের আমেজ কিন্তু তাতে কোনো আগ্রহ নেই পরিবারটির। ‘আমার কোনো পূজা নাই। কেনাকাটা করি নাই। কার জন্য কেনাকাটা করবো, কারে পরামু নতুন জমা। রোববার,(২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) পূজার দিনে ঘরটা কত কলকল করতো। আমারে কেউ কয় না, মা আমার চুড়ি লাগবো। মা আমারে এইটা দাও, ওইটা দাও। আমারে কেউ মা কইয়াও ডাকে না।’
চোখের পানি মুছতে মুছতে বিউটি বলেন, ‘বছর ধইরা আমি ঘোরের মধ্যে আছি। আমি তো ওরে ভুলতে পারি না। সবাই কাঁদতে মানা করে কিন্তু আমি ওরে ভুলি কেমনে! অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু আমি তো ওরে ভুলতে তো পারি না। আমার দেহের মধ্যে আত্মা নাই, খালি খাঁচাটা আছে।’
‘আমি বাঁইচা নাই। আমার ভিতরটা শুধু কাঁদে। আমি কোথাও বের হই না। ভালোই লাগে না। আমি আমার মেয়ের সঙ্গে সব সময় বের হইতাম। ওরে রাইখা কোথাও যাইতাম না। আজকে আমার মেয়ে আমারে রাইখা কই রইল?’ ফের কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
আর্তনাদ করে বিউটি বলেন, ‘পূজা আসছে, আমার ভিতরটা জ্বইলা যাইতাসে। খালি কইতো, মাম্মাম (মা) তুমি আমারে জামা কিন্না দিও, জামার সঙ্গে মিলাইয়া জুতা, চুড়ি কিন্না দিও। আমার একটা জামায় হইবো না মা, দুইটা লাগবো।’
বিবাহিত জীবনে দীর্ঘ অপেক্ষার পর তাদের কোলজুড়ে আসে ছোট রিয়া। সেই সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা মা বলেন, ‘অনেক কষ্ট, অনেক চিকিৎসা কইরা রিয়া হইছিল। আমি সেই কষ্টের ধন ধইরা রাখতে পারলাম না। আমি পারলাম না।’
রিয়ার ঠাকুমা জানালেন, গত বছরও পূজা দেখতে যাননি তারা। এ বছরও তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই।
গত বছরের জুলাইতে কোটা সংস্কারের দাবি চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়- রিয়া এ আন্দোলনে মারা যাওয়া একজন কনিষ্ঠ শহীদ। ওই বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে বাড়ির ছাদে খেলার সময় শিশু রিয়া গুলিবিদ্ধ হয়। পাঁচদিন পর ২৪ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শিশুটি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ওইদিন শহরে আন্দোলনকারীদের দমাতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সড়কে নেমে আসেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান। অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে মুহুর্মুহু গুলিও ছুড়তে দেখা যায়।
রিয়ার মৃত্যুর ১১ মাস পর গত ১ জুলাই আওয়ামী লীগের অজ্ঞাত পরিচয়ের ২০০ নেতাকর্মীকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ।
এভাবেই কন্যার ছবি বুকে জড়িয়ে মায়ের আর্তনাদ -সংবাদ
রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়- সেই আন্দোলনে মারা যাওয়া কনিষ্ঠ শহীদ ছয় বছরের ছোট্ট শিশু রিয়া গোপ। একবছর পার হলেও তাদের বাড়িটাই যেনো বেদনায় নীল। অথচ চারপাশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আনন্দ। নতুন পোশাক, সজ্জা, সাজসজ্জার বাহার আর আলোকসজ্জা, কাসর ঘণ্টা এবং ঢোলের তালে চারপাশ ঝলমল করছে। কিন্তু সবকিছুই ম্লান রিয়া গোপের বাড়িতে। সব আনন্দই বিষাদ শিশু রিয়ার মা-বাবার কাছে।
ওরে রাইখা কোথাও যাইতাম না। আজকে আমার মেয়ে আমারে রাইখা কই রইলো? কান্নায় ভেঙে পড়েন রিয়ার মা
নিস্তব্ধতায় তাদের ঘর শুধুই ইট-পাথরের কোটা, যেনো নেই কোনো প্রাণ। অন্য সবার ঘরে পূজার উচ্ছ্বাস থাকলেও গোপ পরিবারে এখনও শোকের ছায়া। বার বারই জেগে উঠে তাদের হৃদয়ের শূন্যতা।
রিয়া শহরের নয়ামাটি এলাকার দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষ দম্পতির একমাত্র সন্তান। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন নিজ বাড়ির ছাদে খেলা করার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শিশুটি। শহরের ব্যস্ততম এলাকার একটি চার তলা ভবনে থাকেন রিয়ার পরিবার। বাবা দীপক কুমার গোপ বাসায় ছিলেন না। একটি কক্ষে বসে ছিলেন রিয়ার ঠাকুমা। একটু পরে আসলেন মা বিউটি ঘোষ।
বাড়ির একপাশে একটি মন্দির ও অন্যপাশে নয়ামাটি পূজামণ্ডপ। পূজা উপলক্ষে আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে পুরো এলাকা। কিন্তু এ উৎসবের কোনো রেশ নেই রিয়ার পরিবারের সদস্যদের। তাদের বাড়িতে এখনও শোকের নীরবতা। সময় যেন থমকে গেছে তাদের।
কন্যার কথা উঠতেই কেঁদে ওঠেন বিউটি। বিগত বছরগুলোতে রিয়াকে ঘিরেই ছিল তাদের সব আয়োজন। নানা আবদার পূরণেই ব্যস্ত থাকতে হতো দীপক-বিউটি দম্পতির।
বিউটি বলেন, ‘আমরা কেউই ভালো নেই। শরীর-মন কোনো কিছুই ভালো নাই। অনেক কষ্টে দিন কাটাইতাসি। কিছুই ভালো লাগে না। আমি আমার মেয়ের মায়া ছাড়তে পারছি না। ওর ডাক ছাড়তে পারছি না। ওর আদুরে আদুরে কথা আমি ভুলতে পারছি না, কিচ্ছু ভুলতে পারছি না।’
কথার মধ্যেই ‘সোনা মারে, সোনা মা, তুই কই গেলি সোনা মা’ বলে আহাজার শুরু করেন সন্তানহারা এ নারী।
বাড়ির পাশেই মণ্ডপে উৎসবের আমেজ কিন্তু তাতে কোনো আগ্রহ নেই পরিবারটির। ‘আমার কোনো পূজা নাই। কেনাকাটা করি নাই। কার জন্য কেনাকাটা করবো, কারে পরামু নতুন জমা। রোববার,(২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) পূজার দিনে ঘরটা কত কলকল করতো। আমারে কেউ কয় না, মা আমার চুড়ি লাগবো। মা আমারে এইটা দাও, ওইটা দাও। আমারে কেউ মা কইয়াও ডাকে না।’
চোখের পানি মুছতে মুছতে বিউটি বলেন, ‘বছর ধইরা আমি ঘোরের মধ্যে আছি। আমি তো ওরে ভুলতে পারি না। সবাই কাঁদতে মানা করে কিন্তু আমি ওরে ভুলি কেমনে! অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু আমি তো ওরে ভুলতে তো পারি না। আমার দেহের মধ্যে আত্মা নাই, খালি খাঁচাটা আছে।’
‘আমি বাঁইচা নাই। আমার ভিতরটা শুধু কাঁদে। আমি কোথাও বের হই না। ভালোই লাগে না। আমি আমার মেয়ের সঙ্গে সব সময় বের হইতাম। ওরে রাইখা কোথাও যাইতাম না। আজকে আমার মেয়ে আমারে রাইখা কই রইল?’ ফের কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
আর্তনাদ করে বিউটি বলেন, ‘পূজা আসছে, আমার ভিতরটা জ্বইলা যাইতাসে। খালি কইতো, মাম্মাম (মা) তুমি আমারে জামা কিন্না দিও, জামার সঙ্গে মিলাইয়া জুতা, চুড়ি কিন্না দিও। আমার একটা জামায় হইবো না মা, দুইটা লাগবো।’
বিবাহিত জীবনে দীর্ঘ অপেক্ষার পর তাদের কোলজুড়ে আসে ছোট রিয়া। সেই সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা মা বলেন, ‘অনেক কষ্ট, অনেক চিকিৎসা কইরা রিয়া হইছিল। আমি সেই কষ্টের ধন ধইরা রাখতে পারলাম না। আমি পারলাম না।’
রিয়ার ঠাকুমা জানালেন, গত বছরও পূজা দেখতে যাননি তারা। এ বছরও তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই।
গত বছরের জুলাইতে কোটা সংস্কারের দাবি চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়- রিয়া এ আন্দোলনে মারা যাওয়া একজন কনিষ্ঠ শহীদ। ওই বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে বাড়ির ছাদে খেলার সময় শিশু রিয়া গুলিবিদ্ধ হয়। পাঁচদিন পর ২৪ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শিশুটি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ওইদিন শহরে আন্দোলনকারীদের দমাতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সড়কে নেমে আসেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান। অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে মুহুর্মুহু গুলিও ছুড়তে দেখা যায়।
রিয়ার মৃত্যুর ১১ মাস পর গত ১ জুলাই আওয়ামী লীগের অজ্ঞাত পরিচয়ের ২০০ নেতাকর্মীকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ।