ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার টিলা বেয়ে এগোলে চোখে পড়বে একটানা সবুজ সমুদ্রের মতো বিস্তৃত চা বাগান। এই পাহাড়ি টিলার সৌন্দর্য যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে দীর্ঘ ইতিহাস। ইতিহাসটি হলো ফিনলে চা কোম্পানি বা আনুষ্ঠানিক নাম দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড-এর, যেটি এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের চা শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঔপনিবেশিক সূচনা : ফিনলের যাত্রা শুরু ১৮৮২ সালে, যখন যুক্তরাজ্যে গঠিত হয় নর্থ সিলেট টি কোম্পানি লিমিটেড ও সাউথ সিলেট টি কোম্পানি লিমিটেড। মাত্র চার বছরের মধ্যে এই দুই প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১৫ হাজার একরেরও বেশি জমি চা চাষের আওতায় আসে। কলকাতার ফিনলে মুইর অ্যান্ড কোম্পানি শুরু থেকেই এ বাগানের তত্ত্বাবধান করত।
১৮৯৬ সালে, দুই কোম্পানি একীভূত হয়ে গড়ে ওঠে দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেড (কনসোল)। একই সময়ে কোম্পানি তাদের কার্যক্রম বিস্তার করে আসাম, দার্জিলিং, দুয়ারস, ত্রাভাঙ্কোর ও সিলন পর্যন্ত। অল্পদিনের মধ্যেই এটি গ্লাসগো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়, আর ফিনলে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শেয়ার ধরে রেখে ব্যবস্থাপনা ও এজেন্টের ভূমিকা চালিয়ে যায়।
সময়ের সাথে পাল্টে যাওয়া: ১৯৪৯ সালে কনসোলের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৩৫,৩৮১ একর জমি, যেখানে চায়ের পাশাপাশি রাবার, নারিকেল ও টাং চাষ হতো। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান আমলে সিলেটের সম্পত্তি স্থানান্তরিত হয় দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি (পাকিস্তান) লিমিটেড-এর কাছে।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কোম্পানি তার বর্তমান নাম গ্রহণ করে। ১৯৭৬ সালে জেমস ফিনলে পুনর্গঠন করে ভারতের বাগান বিক্রি করে দেয়, আর শ্রীলঙ্কার বাগান ইতোমধ্যেই জাতীয়করণ হয়ে যায়। ২০০৬ সালে দীর্ঘদিন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকার পর ব্যবস্থাপনা চলে আসে বাংলাদেশভিত্তিক মালিকানায়।
ভাড়াউড়া গল্প : ফিনলে’র পাশাপাশি আরেকটি নাম বারবার উঠে আসে—ভাড়াউড়া (সিলেট) টি কোম্পানি লিমিটেড। ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি প্রথম দিকে হার্ট পরিবার পরিচালনা করলেও পরবর্তী সময়ে জেমস ফিনলে শেয়ার কিনে প্রভাব বিস্তার করে। অবশেষে ১৯৮৩ সালে, ফিনলে সম্পূর্ণ মালিকানা অর্জন করে এবং কনসোলের সঙ্গে সমান্তরালভাবে পরিচালনা করতে থাকে।
ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট : ফিনলে’র চা বাগানগুলো মূলত মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। এগুলো ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা সংলগ্ন। ঢাকার উত্তর-পূর্বে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরে এবং শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে এর অবস্থান।
উচ্চতা: সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ মিটার।
জলবায়ু: উষ্ণম-লীয় ও উপ-উষ্ণম-লীয় মৌসুমি।
তাপমাত্রা: শীতে সর্বনিম্ন ১০.৯২ক্কসে থেকে গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ ৩১.৯৪ক্কসে।
বৃষ্টিপাত: গড়ে ১৮০–২০০ মিমি/বছর।
আর্দ্রতা: মৌসুমভেদে ৫৫%–৯১%। এই সবুজ টিলা ও অনুকূল জলবায়ুই চা উৎপাদনের মূল প্রাণশক্তি।
অবদান ও উত্তরাধিকার : ফিনলে শুধু একটি কোম্পানির নাম নয়, এটি বাংলাদেশের চা শিল্পের ইতিহাসের অংশ। চাষাবাদের বিস্তার: হাজার হাজার একর জমিকে চা বাগানে পরিণত করেছে। অর্থনৈতিক অবদান: রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে ও শ্রমিক কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রেখেছে।
কৃষির বহুমুখীকরণ: রাবার, নারিকেল, টাং ইত্যাদি নতুন ফসলের চাষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
সামাজিক প্রভাব: চা শ্রমিক সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে নতুন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জনপদ সৃষ্টি করেছে। আজ যখন আমরা সিলেটের টিলাভূমির দিকে তাকাই, তখন শুধু চায়ের গাছ দেখি না, দেখি শতবর্ষের ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের নাম ফিনলে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের চা শিল্পের শীর্ষ অবস্থান পর্যন্ত—ফিনলে’র অবদান সবসময় দৃশ্যমান। প্রতিটি চুমুকে তাই শুধু চায়ের স্বাদ নয়, ইতিহাসের স্বাদও মিশে থাকে।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার টিলা বেয়ে এগোলে চোখে পড়বে একটানা সবুজ সমুদ্রের মতো বিস্তৃত চা বাগান। এই পাহাড়ি টিলার সৌন্দর্য যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে দীর্ঘ ইতিহাস। ইতিহাসটি হলো ফিনলে চা কোম্পানি বা আনুষ্ঠানিক নাম দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড-এর, যেটি এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের চা শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঔপনিবেশিক সূচনা : ফিনলের যাত্রা শুরু ১৮৮২ সালে, যখন যুক্তরাজ্যে গঠিত হয় নর্থ সিলেট টি কোম্পানি লিমিটেড ও সাউথ সিলেট টি কোম্পানি লিমিটেড। মাত্র চার বছরের মধ্যে এই দুই প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১৫ হাজার একরেরও বেশি জমি চা চাষের আওতায় আসে। কলকাতার ফিনলে মুইর অ্যান্ড কোম্পানি শুরু থেকেই এ বাগানের তত্ত্বাবধান করত।
১৮৯৬ সালে, দুই কোম্পানি একীভূত হয়ে গড়ে ওঠে দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেড (কনসোল)। একই সময়ে কোম্পানি তাদের কার্যক্রম বিস্তার করে আসাম, দার্জিলিং, দুয়ারস, ত্রাভাঙ্কোর ও সিলন পর্যন্ত। অল্পদিনের মধ্যেই এটি গ্লাসগো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়, আর ফিনলে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শেয়ার ধরে রেখে ব্যবস্থাপনা ও এজেন্টের ভূমিকা চালিয়ে যায়।
সময়ের সাথে পাল্টে যাওয়া: ১৯৪৯ সালে কনসোলের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৩৫,৩৮১ একর জমি, যেখানে চায়ের পাশাপাশি রাবার, নারিকেল ও টাং চাষ হতো। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান আমলে সিলেটের সম্পত্তি স্থানান্তরিত হয় দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি (পাকিস্তান) লিমিটেড-এর কাছে।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কোম্পানি তার বর্তমান নাম গ্রহণ করে। ১৯৭৬ সালে জেমস ফিনলে পুনর্গঠন করে ভারতের বাগান বিক্রি করে দেয়, আর শ্রীলঙ্কার বাগান ইতোমধ্যেই জাতীয়করণ হয়ে যায়। ২০০৬ সালে দীর্ঘদিন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকার পর ব্যবস্থাপনা চলে আসে বাংলাদেশভিত্তিক মালিকানায়।
ভাড়াউড়া গল্প : ফিনলে’র পাশাপাশি আরেকটি নাম বারবার উঠে আসে—ভাড়াউড়া (সিলেট) টি কোম্পানি লিমিটেড। ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি প্রথম দিকে হার্ট পরিবার পরিচালনা করলেও পরবর্তী সময়ে জেমস ফিনলে শেয়ার কিনে প্রভাব বিস্তার করে। অবশেষে ১৯৮৩ সালে, ফিনলে সম্পূর্ণ মালিকানা অর্জন করে এবং কনসোলের সঙ্গে সমান্তরালভাবে পরিচালনা করতে থাকে।
ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট : ফিনলে’র চা বাগানগুলো মূলত মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। এগুলো ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা সংলগ্ন। ঢাকার উত্তর-পূর্বে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরে এবং শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে এর অবস্থান।
উচ্চতা: সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ মিটার।
জলবায়ু: উষ্ণম-লীয় ও উপ-উষ্ণম-লীয় মৌসুমি।
তাপমাত্রা: শীতে সর্বনিম্ন ১০.৯২ক্কসে থেকে গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ ৩১.৯৪ক্কসে।
বৃষ্টিপাত: গড়ে ১৮০–২০০ মিমি/বছর।
আর্দ্রতা: মৌসুমভেদে ৫৫%–৯১%। এই সবুজ টিলা ও অনুকূল জলবায়ুই চা উৎপাদনের মূল প্রাণশক্তি।
অবদান ও উত্তরাধিকার : ফিনলে শুধু একটি কোম্পানির নাম নয়, এটি বাংলাদেশের চা শিল্পের ইতিহাসের অংশ। চাষাবাদের বিস্তার: হাজার হাজার একর জমিকে চা বাগানে পরিণত করেছে। অর্থনৈতিক অবদান: রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে ও শ্রমিক কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রেখেছে।
কৃষির বহুমুখীকরণ: রাবার, নারিকেল, টাং ইত্যাদি নতুন ফসলের চাষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
সামাজিক প্রভাব: চা শ্রমিক সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে নতুন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জনপদ সৃষ্টি করেছে। আজ যখন আমরা সিলেটের টিলাভূমির দিকে তাকাই, তখন শুধু চায়ের গাছ দেখি না, দেখি শতবর্ষের ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের নাম ফিনলে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের চা শিল্পের শীর্ষ অবস্থান পর্যন্ত—ফিনলে’র অবদান সবসময় দৃশ্যমান। প্রতিটি চুমুকে তাই শুধু চায়ের স্বাদ নয়, ইতিহাসের স্বাদও মিশে থাকে।