ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বাংলাদেশের কৃষির অতীত ও ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মারক শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর। দেশের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগত কৃষি জাদুঘর এটি, প্রতিষ্ঠাতা রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ। মাটির টানে গড়ে তোলা এক স্বপ্ন আমার শৈশব কেটেছে ধানের গোলার পাশে, নাঙল আর জোয়ালের সঙ্গেই বড় হয়েছি, বললেন জাহাঙ্গীর আলম শাহ। তিনি যোগ করেন, “আজকের প্রজন্ম জানে না কীভাবে কৃষি আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল। আমি চেয়েছি সেই ইতিহাসটুকু বাঁচিয়ে রাখতে। ২০০৮ সালে শখের বশে কৃষিবিষয়ক বই সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। পরে নিজের পৈতৃক তিন একর জমিতে গড়ে তোলেন পাঠাগার, তারপর ধীরে ধীরে কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি, ও কৃষকের ব্যবহার্য সামগ্রী জড়ো করে তোলেন কৃষি জাদুঘরটি। জাদুঘরে প্রবেশ করলেই মনে হয়, যেন সময় থমকে আছে। ছাদের সাথে ঝুলছে মাথাল, নাঙল, জোয়াল, গরুর গাড়ির ছই, সেচের যন্ত্র, ঢেঁকি, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, মাছ ধরার চাঁই-পলই, ফসল মাড়াইয়ের গাদন কাঠি সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন কৃষিপণ্য। নয়টি ঘরে সাজানো এসব সামগ্রী দেখলে মনে হয়, এটি শুধু সংগ্রহ নয়, এক জীবন্ত পাঠশালা। দেয়ালজুড়ে ‘শাহ কৃষি পঞ্জিকা’ যেখানে বারো মাসের কৃষিকাজ, বীজ নির্বাচন, রোগবালাই দমন, আবহাওয়ার নির্দেশনা সব একসাথে লেখা। শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার-এ রয়েছে শত শত কৃষিবিষয়ক বই, ম্যাগাজিন, পুস্তক ও গবেষণাপত্র। এখানে প্রতিদিন স্থানীয় কৃষক, কৃষি শিক্ষার্থী ও গবেষকরা এসে সময় কাটান। বিকেলে বসে শিশুদের পাঠশালা যেখানে দরিদ্র শিশুরা বিনা খরচে বই পড়ে ও গল্প শোনে। স্থানীয় কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, আমার ধানে পোকা ধরেছিল। এখানকার বই পড়ে বুঝেছি কীভাবে ওষুধ দিতে হয়। আমাদের গ্রামের জন্য এই জায়গাটা এখন আশীর্বাদ। একই উপজেলার সতীহাট জিএস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেনির কৃষি শিক্ষার্থী ফারিহা হোসেন কৃপা বলেন, আমরা কৃষি প্রযুক্তি পড়ি, কিন্তু অনেক পুরনো যন্ত্র দেখি না।
এখানে এসে সেই ইতিহাস দেখা যায়, মনে হয় বইয়ের বিষয়গুলো চোখের সামনে জীবন্ত। কালীগ্রামের প্রবেশপথেই দেখা মেলে দৃষ্টিনন্দন এক বোর্ডে লেখা শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর। ফুলে ঘেরা প্রাঙ্গণ, পাখির কলরব আর খোলা মাঠের হাওয়া দর্শনার্থীদের মনে অন্যরকম প্রশান্তি এনে দেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী ইরিন জামান কথা বলেন, শুধু কৃষি নয়, এটি বাংলার ইতিহাস দেখায়। আমি প্রথমবার এসে বুঝলাম, আমাদের কৃষি কত বৈচিত্র্যময় ছিল।
স্থানীয় পর্যটক মো. রফিকুল ইসলাম সরদার বলেন, শুধু বইয়ে নয়, হাতে-কলমে কৃষির ইতিহাস শেখার জায়গা এটি। আমি আমার সন্তানদের এখানে এনেছি যেন তারা জানে তাদের শিকড় কোথায়।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেক্স স্টার করপোরেশনের পরিচালক ও কিডনি বিশেষজ্ঞ ড. স্টিভেন গেস্ট এই জাদুঘর পরিদর্শনে এসে বলেন, এটি বাংলাদেশের মাটির গন্ধমাখা ইতিহাস যা যেকোনো দেশের জন্য অনুপ্রেরণার। পরের বছর জাপানের চিকিৎসক ড. কাতাসু হিরো ইয়ামাশিতা ও তাঁর স্ত্রী সেইকো ইয়ামাশিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মল্লিকা ব্যানার্জি এখানে ঘুরে গিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।
জাদুঘরের কেয়ারটেকার হজরত আলী জানান, দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে। কেউ বই দেয়, কেউ পুরনো কৃষিযন্ত্র দান করে যান। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি সবার জন্য খোলা থাকে।
শুধু যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী নয়, এই জাদুঘর এখন এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় কৃষি উৎসব, যেখানে কৃষকেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী উপকরণ ও বীজ প্রদর্শন করেন। জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, আমি চাই, কৃষক যেন নিজের কাজের গর্ব অনুভব করে। এই জাদুঘর তাদেরই গল্প বলে যারা ঘাম ঝরিয়ে আমাদের আহার জোগায়। স্থানীয় শিক্ষক কালীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রতন প্রসাদ ফনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রায়ই এখানে আসি। এটি ইতিহাস শেখায়, শ্রদ্ধা শেখায়, মাটির প্রতি ভালোবাসা শেখায়। আজ শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর শুধু একটি সংগ্রহশালা নয় এটি একটি চেতনার কেন্দ্র। কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতার সেতুবন্ধন ঘটিয়েছে এই স্থাপনা।
রাজশাহীর এই শিক্ষক নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন এমন এক নিদর্শন, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও একাগ্রতা, জ্ঞান ও ভালোবাসা দিয়ে কীভাবে ইতিহাস সংরক্ষণ করা যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ হুমায়রা মণ্ডল বলেন, আমাদের কৃষি শুধু উৎপাদনের গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি সংস্কৃতি। কালীগ্রামের এই ‘শাহ কৃষি জাদুঘর’ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ের। এখানে যেমন কৃষি ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে, তেমনি নতুন প্রজন্মের শেখার জন্য এটি এক জীবন্ত পাঠাগার। জাহাঙ্গীর আলম শাহের এই প্রয়াস আমাদের কৃষিকে নতুনভাবে দেখার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
নওগাঁর কালীগ্রামের এই জাদুঘর এখন বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্যের মুকুটমণি। এটি যেমন অতীতের দলিল, তেমনি ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা। এখানে প্রতিটি প্রদর্শনী বস্তু যেন বলে কৃষি শুধু পেশা নয়, এটি জীবন, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ভালোবাসার এক চিরন্তন গান।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশের কৃষির অতীত ও ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মারক শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর। দেশের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগত কৃষি জাদুঘর এটি, প্রতিষ্ঠাতা রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ। মাটির টানে গড়ে তোলা এক স্বপ্ন আমার শৈশব কেটেছে ধানের গোলার পাশে, নাঙল আর জোয়ালের সঙ্গেই বড় হয়েছি, বললেন জাহাঙ্গীর আলম শাহ। তিনি যোগ করেন, “আজকের প্রজন্ম জানে না কীভাবে কৃষি আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল। আমি চেয়েছি সেই ইতিহাসটুকু বাঁচিয়ে রাখতে। ২০০৮ সালে শখের বশে কৃষিবিষয়ক বই সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। পরে নিজের পৈতৃক তিন একর জমিতে গড়ে তোলেন পাঠাগার, তারপর ধীরে ধীরে কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি, ও কৃষকের ব্যবহার্য সামগ্রী জড়ো করে তোলেন কৃষি জাদুঘরটি। জাদুঘরে প্রবেশ করলেই মনে হয়, যেন সময় থমকে আছে। ছাদের সাথে ঝুলছে মাথাল, নাঙল, জোয়াল, গরুর গাড়ির ছই, সেচের যন্ত্র, ঢেঁকি, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, মাছ ধরার চাঁই-পলই, ফসল মাড়াইয়ের গাদন কাঠি সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন কৃষিপণ্য। নয়টি ঘরে সাজানো এসব সামগ্রী দেখলে মনে হয়, এটি শুধু সংগ্রহ নয়, এক জীবন্ত পাঠশালা। দেয়ালজুড়ে ‘শাহ কৃষি পঞ্জিকা’ যেখানে বারো মাসের কৃষিকাজ, বীজ নির্বাচন, রোগবালাই দমন, আবহাওয়ার নির্দেশনা সব একসাথে লেখা। শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার-এ রয়েছে শত শত কৃষিবিষয়ক বই, ম্যাগাজিন, পুস্তক ও গবেষণাপত্র। এখানে প্রতিদিন স্থানীয় কৃষক, কৃষি শিক্ষার্থী ও গবেষকরা এসে সময় কাটান। বিকেলে বসে শিশুদের পাঠশালা যেখানে দরিদ্র শিশুরা বিনা খরচে বই পড়ে ও গল্প শোনে। স্থানীয় কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, আমার ধানে পোকা ধরেছিল। এখানকার বই পড়ে বুঝেছি কীভাবে ওষুধ দিতে হয়। আমাদের গ্রামের জন্য এই জায়গাটা এখন আশীর্বাদ। একই উপজেলার সতীহাট জিএস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেনির কৃষি শিক্ষার্থী ফারিহা হোসেন কৃপা বলেন, আমরা কৃষি প্রযুক্তি পড়ি, কিন্তু অনেক পুরনো যন্ত্র দেখি না।
এখানে এসে সেই ইতিহাস দেখা যায়, মনে হয় বইয়ের বিষয়গুলো চোখের সামনে জীবন্ত। কালীগ্রামের প্রবেশপথেই দেখা মেলে দৃষ্টিনন্দন এক বোর্ডে লেখা শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর। ফুলে ঘেরা প্রাঙ্গণ, পাখির কলরব আর খোলা মাঠের হাওয়া দর্শনার্থীদের মনে অন্যরকম প্রশান্তি এনে দেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী ইরিন জামান কথা বলেন, শুধু কৃষি নয়, এটি বাংলার ইতিহাস দেখায়। আমি প্রথমবার এসে বুঝলাম, আমাদের কৃষি কত বৈচিত্র্যময় ছিল।
স্থানীয় পর্যটক মো. রফিকুল ইসলাম সরদার বলেন, শুধু বইয়ে নয়, হাতে-কলমে কৃষির ইতিহাস শেখার জায়গা এটি। আমি আমার সন্তানদের এখানে এনেছি যেন তারা জানে তাদের শিকড় কোথায়।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেক্স স্টার করপোরেশনের পরিচালক ও কিডনি বিশেষজ্ঞ ড. স্টিভেন গেস্ট এই জাদুঘর পরিদর্শনে এসে বলেন, এটি বাংলাদেশের মাটির গন্ধমাখা ইতিহাস যা যেকোনো দেশের জন্য অনুপ্রেরণার। পরের বছর জাপানের চিকিৎসক ড. কাতাসু হিরো ইয়ামাশিতা ও তাঁর স্ত্রী সেইকো ইয়ামাশিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মল্লিকা ব্যানার্জি এখানে ঘুরে গিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।
জাদুঘরের কেয়ারটেকার হজরত আলী জানান, দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে। কেউ বই দেয়, কেউ পুরনো কৃষিযন্ত্র দান করে যান। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি সবার জন্য খোলা থাকে।
শুধু যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী নয়, এই জাদুঘর এখন এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় কৃষি উৎসব, যেখানে কৃষকেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী উপকরণ ও বীজ প্রদর্শন করেন। জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, আমি চাই, কৃষক যেন নিজের কাজের গর্ব অনুভব করে। এই জাদুঘর তাদেরই গল্প বলে যারা ঘাম ঝরিয়ে আমাদের আহার জোগায়। স্থানীয় শিক্ষক কালীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রতন প্রসাদ ফনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রায়ই এখানে আসি। এটি ইতিহাস শেখায়, শ্রদ্ধা শেখায়, মাটির প্রতি ভালোবাসা শেখায়। আজ শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর শুধু একটি সংগ্রহশালা নয় এটি একটি চেতনার কেন্দ্র। কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতার সেতুবন্ধন ঘটিয়েছে এই স্থাপনা।
রাজশাহীর এই শিক্ষক নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন এমন এক নিদর্শন, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও একাগ্রতা, জ্ঞান ও ভালোবাসা দিয়ে কীভাবে ইতিহাস সংরক্ষণ করা যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ হুমায়রা মণ্ডল বলেন, আমাদের কৃষি শুধু উৎপাদনের গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি সংস্কৃতি। কালীগ্রামের এই ‘শাহ কৃষি জাদুঘর’ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ের। এখানে যেমন কৃষি ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে, তেমনি নতুন প্রজন্মের শেখার জন্য এটি এক জীবন্ত পাঠাগার। জাহাঙ্গীর আলম শাহের এই প্রয়াস আমাদের কৃষিকে নতুনভাবে দেখার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
নওগাঁর কালীগ্রামের এই জাদুঘর এখন বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্যের মুকুটমণি। এটি যেমন অতীতের দলিল, তেমনি ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা। এখানে প্রতিটি প্রদর্শনী বস্তু যেন বলে কৃষি শুধু পেশা নয়, এটি জীবন, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ভালোবাসার এক চিরন্তন গান।