রাজশাহীর পদ্মা নদী যেন আবার ফিরে পাচ্ছে নিজের পুরনো রূপ, এক সময় যে নদীর বুক ছিল প্রাণের ভরপুর, সেই পদ্মার নদীতে আবার দেখা মিলছে জীবনের চিহ্নকোথাও কুমিরের মসৃণ গা সূর্যের আলোয় চকচক করছে, আবার কোথাও বিরল পাখির ডানায় ভেসে আসছে ভোরের সঙ্গীত। নদীতে ভেসে বেড়ানো কুমিরের মাথা আর আকাশ ছোঁয়া ডানার মৃদু শব্দ যেন মিলেমিশে লিখছে প্রকৃতির নতুন কবিতা।
দীর্ঘদিন ধরে মানবিক কর্মকান্ড, নদীভাঙন আর দূষণে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল এই নদীর বুকে প্রাণের ছোঁয়া। কিন্তু এবার পদ্মা যেন নিজেই নিজের পুনর্জন্মের আয়োজন করেছে। ভোরের শিশিরে ভেজা ঘাসের গন্ধে, তীরে বসে থাকা জেলে বা পথচলার মাঝখানে থেমে যাওয়া মানুষদের চোখে ফুটে উঠছে বিস্ময়“এ যে আবার সেই পুরনো পদ্মা, যাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম!”
প্রকৃতির এই পুনর্জাগরণ কেবল পরিবেশগত দিক থেকেই নয়, এটি এক অনবদ্য কবিতার মতো ছুঁয়ে যায় মানুষের মনকেও। কুমিরের ধীর পদচারণা আর পাখির নরম ডানার ছোঁয়া যেন মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতি কখনো হারায় না, শুধু অপেক্ষা করে ফিরে আসার সময়ের। রাজশাহীর পদ্মা তাই আজ শুধু একটি নদী নয়; সে যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে জল, বায়ু আর প্রাণ একত্রে আঁকছে জীবনের নতুন রঙিন চিত্র। রাজশাহীর বুক চিরে বয়ে চলা পদ্মা নদী শুধু একটি জলধারা নয়, এটি প্রকৃতির বিশাল এক জীবন্ত গ্যালারি। এই নদীতে দেখা মিলেছে বিরল প্রজাতির পাখি ‘কমন মার্গেন্জার’ এবং একটি কুমিরের, যা নদীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্যের ইতিবাচক বার্তা বহন করে। পরিবেশবিদদের মতে, এ ধরনের প্রাণীর উপস্থিতি প্রমাণ করে পদ্মা এখনও প্রাণে ভরপুর এবং জীববৈচিত্র্যের একটি সম্ভাবনাময় আশ্রয়স্থল।
এই বিরল প্রজাতিগুলোর উপস্থিতি শুধুই আকর্ষণীয় নয়, বরং নদী রক্ষায় নতুন করে ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে।
পাখিদের কলতানে এখন মুখর রাজশাহীর পদ্মা। বাংলাদেশে দেখা যায় না বললেই চলে এমন ‘কমন মার্গেঞ্জার’ দুর্লভ পাখির দেখা মিলেছে পদ্মার চরে। পদ্মার চরাঞ্চলে গিয়ে হাঁস প্রজাতির যে দুর্লভ পাখির দেখা মিলেছে, সেগুলোর চোখ, পা ও পায়ের পাতা লাল এবং উজ্জ্বল। মূলত এই পাখিগুলো লাল-কমলা রঙের, দেখতে অনেকটাই হাঁসের মতো। এর পাখির বৈজ্ঞানিক নাম ‘মার্গার মার্গেঞ্জার’। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে একে ‘পাতি মার্গেঞ্জার’ হিসেবে উল্যেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে- পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর এ হাঁসকে রাজশাহীর পদ্মায় প্রথমবারের মতো দেখা গেছে। ওই শুমারিতে বিরল প্রজাতির ‘বৈকাল তিলিহাঁস’ পাখিরও দেখা মিলেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) সম্প্রতি রাজশাহীর পদ্মা নদীর ৩৯ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ পাখিশুমারি করে। আইইউসিএন বাংলাদেশের ওয়াইন্ড বার্ড মনিটরিং প্রোগ্রামের আওতায় করা এ শুমারিতে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, রাজশাহী বার্ড ক্লাব এবং বন অধিদপ্তর। ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী দুর্লভ পাখির যেসব তথ্য প্রকাশ করে সেখানে রাজশাহীর পদ্মাপাড়ের এ পাখিশুমারির তথ্যচিত্র পাঠানো হবে। আইইউসিএন বাংলাদেশের তথ্য মতে, শুমারিতে পদ্মার পাড়জুড়ে ৩৭ প্রজাতির মোট ৪ হাজার ২৫টি পাখি গণনা করা হয়। এর মধ্যে ২৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০০টি পাওয়া গেছে পিয়ং হাঁস। সৈকত পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে টেমিংয়ের চা পাখি। সবচেয়ে বিরল পাখির মধ্যে দেখা গেছে একটি বৈকাল তিলিহাঁস। এছাড়া দেশী মেটে হাঁস, লালমাথা ভূতিহাঁস, ইউরেশিয় সিথিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, কালা মানিকজোড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আইইউসিএনের গবেষকরা জানিয়েছেন, পদ্মারচরে অনেক দুর্লভ প্রজাতির পাখি পাওয়া যাচ্ছে। ২০২০ সালৈ পদ্মাচরে প্রথম দেখা গেছে ‘কমন মার্গেঞ্জার’। বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী ও গবেষক অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান পদ্মারপাড়ে এ পাখিটির দেখা পান। তিনি বলেন, ‘কমন মার্গেঞ্জার’ পাখি বাংলাদেশে অনিয়মিত। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিবৃতি। এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল ও ভুটানে দেখা যায়। সাম্প্রতিক এটিকে তৃতীয়বারের মতো দেখা গেল। এদিকে রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে চালানো এ পাখিশুমারি ও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইইউসিএনের বন্যপ্রাণী মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু। তিনি বলেন, রাজশাহীতে পাখিরা অনেক ভাল অবস্থানে আছে। এর কারণ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। জায়গা অনেক বেশি হওয়ার কারণে পাখিরা এখানে আশ্রয় নেয়। এক চরে অনুকূল পরিবেশ না পেলে তারা আরেক চরে উড়ে যায়। আইইউসিএনের আরেক গবেষক সারোয়ার আলম বলেন, আমরা সাধারণত হাওর অঞ্চলের পাখির শুমারি করে থাকি। তবে এ শীত মৌসুমে রাজশাহীতে প্রথম শুমারি করা হয়েছে। রাজশাহীর অভ্যন্তরে থাকা পদ্মা নদীর প্রায় ৩৯ কিলোমিটার অংশে আমরা শুমারি করেছি। যার মধ্যে পবা উপজেলার চরখানপুর, খিদিরপুর, দশনম্বর চর ও চারঘাট অংশ ও খিদিরপুরের মধ্যচরে সবচেয়ে বেশি পাখির বিচরণ দেখেছি। রাজশাহী বার্ড ক্লাবের সদস্য নূর এ সাউদ বলেন, আমরা সর্বমোট ৪ হাজার ২৫টি পাখি গণনা করেছি। যেগুলো ৩৭ প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে ২৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সবচেয়ে বেশি বিচরণ দেখা গেছে পিয়ং হাঁসের। সৈকত পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে টেমিংয়ের চাপাখি। সবচেয়ে বিরল পাখি ছিল বৈকাল তিলিহাঁস। শুমারি চলাকালীন আইইউসিএনের উদ্যোগে দূর পরিযায়ী এক পাখির পিঠে ট্র্যাকার বসানো হয়। সেই পাখিটির নাম পাতি তিলিহাঁস। ইংরেজী নাম ‘কমন টিল’। এটি দুর্লভ প্রজাতির পাখি। এর মাধ্যমে পাখিটির চলাচলের পথ ও আচরণ সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। প্রতি ঘণ্টায় মোবাইল ফোনে এর গতিবিধির হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রতি কোন এক দুপুরে পদ্মা নদীর মাঝারদিয়া এলাকায় পাখিটি ছেড়ে দেয়ার পরদিন বিকেল সোয়া ৫টা পর্যন্ত সে সাড়ে ৯ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছে। তখন পর্যন্ত তার সর্বশেষ অবস্থান ছিল পবা উপজেলার চরখানপুর এলাকায়। আইইউসিএনের গবেষক সারোয়ার আলম জানান, হাঁস জাতের পাখিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। এটির ওজন ৩১০ গ্রাম। এটি সবচেয়ে দূর পরিযায়ী হাঁস। ট্যাগের ওজন প্রায় ১০ গ্রাম- যা পাখির শরীরের ওজনের মাত্র ৩ শতাংশ। ফলে এর স্বাভাবিক চলাফেরায় সমস্যা হয়নি। গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য এটি বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি।
এদিকে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে একাধিক কুমিরের দেখা মিলেছে। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক একটি কুমিরের ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী দম্পতি ইমরুল কায়েস ও উম্মে খাদিজা ইভা। ছোট কুমির দেখেছেন স্থানীয় জেলেরা। এ অবস্থায় নদীতে গোসল না করতে এলাকাবাসীকে মাইকিং ও লিফলেটের মাধ্যমে সতর্ক করছে রাজশাহী বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।
গত ১৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিকেলে পদ্মার ষাটবিঘা চরে পাখির ছবি তুলতে গিয়ে কায়েস দম্পতি কুমিরটির দেখা পান। ড্রোনে ধারণ করা ভিডিও ও ছবিতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় কুমিরটি পানির ধারে রোদ পোহাচ্ছে। স্থানীয় রাজু আহাম্মেদ প্রথম কুমিরটি দেখেছিলেন গরু চরাতে গিয়ে। আইইউসিএন জানিয়েছে, ছবিতে দেখা প্রাণীটি মিঠাপানির কুমির, যা বাংলাদেশে বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
আইইউসিএনের মুখ্য গবেষক এ বি এম সারোয়ার আলম জানান, ২০১৫ সালে মিঠাপানির কুমির বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরে পাবনা ও আরও দুটি স্থানে কুমির দেখা যায়, যেগুলো এখন সুন্দরবনের করমজল প্রজননকেন্দ্রে সংরক্ষিত। তিনি ধারণা করছেন, রাজশাহীর কুমিরটি সম্ভবত ভারতের চাম্বুল নদ এলাকা থেকে এসেছে। রাজশাহী বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, স্থানীয় জেলেরা ছোট কুমিরও দেখেছেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মায় একাধিক কুমির রয়েছে। তিনি বলেন, “এগুলো জলজ প্রাণী, জলেই থাকুক। তাদের বিরক্ত করা যাবে না।”
এদিকে স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ প্রশাসনের কাছে কুমিরটি ধরে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তবে আলোকচিত্রী ইমরুল কায়েস চান, কুমিরটি যেন মুক্তভাবে নদীতেই থাকে, যাতে এর প্রজনন সম্ভব হয়। তাঁর আশঙ্কা, আইইউসিএন কুমিরটিকে ধরে নিয়ে যেতে পারে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগের লিফলেটে বলা হয়েছে, কুমির হিং¯্র হলেও তারা জলজ বাস্ততন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই কুমির দেখলে বিরক্ত না করা, নদীতে গোসল না করা, শিশুদের নদীর ধারে না পাঠানো, ছোট নৌকা চলাচল সাময়িক বন্ধ রাখা এবং রোদ পোহানো কুমিরের দিকে ঢিল না ছোড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। লিফলেটে আরও উল্যেখ করা হয়েছে, বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী কুমিরকে বিরক্ত করা, ধরা, হত্যা করা বা বিক্রি করা দন্ডনীয় অপরাধ। সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদন্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
রাজশাহীর পদ্মা নদী যেন আবার ফিরে পাচ্ছে নিজের পুরনো রূপ, এক সময় যে নদীর বুক ছিল প্রাণের ভরপুর, সেই পদ্মার নদীতে আবার দেখা মিলছে জীবনের চিহ্নকোথাও কুমিরের মসৃণ গা সূর্যের আলোয় চকচক করছে, আবার কোথাও বিরল পাখির ডানায় ভেসে আসছে ভোরের সঙ্গীত। নদীতে ভেসে বেড়ানো কুমিরের মাথা আর আকাশ ছোঁয়া ডানার মৃদু শব্দ যেন মিলেমিশে লিখছে প্রকৃতির নতুন কবিতা।
দীর্ঘদিন ধরে মানবিক কর্মকান্ড, নদীভাঙন আর দূষণে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল এই নদীর বুকে প্রাণের ছোঁয়া। কিন্তু এবার পদ্মা যেন নিজেই নিজের পুনর্জন্মের আয়োজন করেছে। ভোরের শিশিরে ভেজা ঘাসের গন্ধে, তীরে বসে থাকা জেলে বা পথচলার মাঝখানে থেমে যাওয়া মানুষদের চোখে ফুটে উঠছে বিস্ময়“এ যে আবার সেই পুরনো পদ্মা, যাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম!”
প্রকৃতির এই পুনর্জাগরণ কেবল পরিবেশগত দিক থেকেই নয়, এটি এক অনবদ্য কবিতার মতো ছুঁয়ে যায় মানুষের মনকেও। কুমিরের ধীর পদচারণা আর পাখির নরম ডানার ছোঁয়া যেন মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতি কখনো হারায় না, শুধু অপেক্ষা করে ফিরে আসার সময়ের। রাজশাহীর পদ্মা তাই আজ শুধু একটি নদী নয়; সে যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে জল, বায়ু আর প্রাণ একত্রে আঁকছে জীবনের নতুন রঙিন চিত্র। রাজশাহীর বুক চিরে বয়ে চলা পদ্মা নদী শুধু একটি জলধারা নয়, এটি প্রকৃতির বিশাল এক জীবন্ত গ্যালারি। এই নদীতে দেখা মিলেছে বিরল প্রজাতির পাখি ‘কমন মার্গেন্জার’ এবং একটি কুমিরের, যা নদীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্যের ইতিবাচক বার্তা বহন করে। পরিবেশবিদদের মতে, এ ধরনের প্রাণীর উপস্থিতি প্রমাণ করে পদ্মা এখনও প্রাণে ভরপুর এবং জীববৈচিত্র্যের একটি সম্ভাবনাময় আশ্রয়স্থল।
এই বিরল প্রজাতিগুলোর উপস্থিতি শুধুই আকর্ষণীয় নয়, বরং নদী রক্ষায় নতুন করে ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে।
পাখিদের কলতানে এখন মুখর রাজশাহীর পদ্মা। বাংলাদেশে দেখা যায় না বললেই চলে এমন ‘কমন মার্গেঞ্জার’ দুর্লভ পাখির দেখা মিলেছে পদ্মার চরে। পদ্মার চরাঞ্চলে গিয়ে হাঁস প্রজাতির যে দুর্লভ পাখির দেখা মিলেছে, সেগুলোর চোখ, পা ও পায়ের পাতা লাল এবং উজ্জ্বল। মূলত এই পাখিগুলো লাল-কমলা রঙের, দেখতে অনেকটাই হাঁসের মতো। এর পাখির বৈজ্ঞানিক নাম ‘মার্গার মার্গেঞ্জার’। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে একে ‘পাতি মার্গেঞ্জার’ হিসেবে উল্যেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে- পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর এ হাঁসকে রাজশাহীর পদ্মায় প্রথমবারের মতো দেখা গেছে। ওই শুমারিতে বিরল প্রজাতির ‘বৈকাল তিলিহাঁস’ পাখিরও দেখা মিলেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) সম্প্রতি রাজশাহীর পদ্মা নদীর ৩৯ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ পাখিশুমারি করে। আইইউসিএন বাংলাদেশের ওয়াইন্ড বার্ড মনিটরিং প্রোগ্রামের আওতায় করা এ শুমারিতে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, রাজশাহী বার্ড ক্লাব এবং বন অধিদপ্তর। ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী দুর্লভ পাখির যেসব তথ্য প্রকাশ করে সেখানে রাজশাহীর পদ্মাপাড়ের এ পাখিশুমারির তথ্যচিত্র পাঠানো হবে। আইইউসিএন বাংলাদেশের তথ্য মতে, শুমারিতে পদ্মার পাড়জুড়ে ৩৭ প্রজাতির মোট ৪ হাজার ২৫টি পাখি গণনা করা হয়। এর মধ্যে ২৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০০টি পাওয়া গেছে পিয়ং হাঁস। সৈকত পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে টেমিংয়ের চা পাখি। সবচেয়ে বিরল পাখির মধ্যে দেখা গেছে একটি বৈকাল তিলিহাঁস। এছাড়া দেশী মেটে হাঁস, লালমাথা ভূতিহাঁস, ইউরেশিয় সিথিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, কালা মানিকজোড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আইইউসিএনের গবেষকরা জানিয়েছেন, পদ্মারচরে অনেক দুর্লভ প্রজাতির পাখি পাওয়া যাচ্ছে। ২০২০ সালৈ পদ্মাচরে প্রথম দেখা গেছে ‘কমন মার্গেঞ্জার’। বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী ও গবেষক অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান পদ্মারপাড়ে এ পাখিটির দেখা পান। তিনি বলেন, ‘কমন মার্গেঞ্জার’ পাখি বাংলাদেশে অনিয়মিত। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিবৃতি। এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল ও ভুটানে দেখা যায়। সাম্প্রতিক এটিকে তৃতীয়বারের মতো দেখা গেল। এদিকে রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে চালানো এ পাখিশুমারি ও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইইউসিএনের বন্যপ্রাণী মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু। তিনি বলেন, রাজশাহীতে পাখিরা অনেক ভাল অবস্থানে আছে। এর কারণ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। জায়গা অনেক বেশি হওয়ার কারণে পাখিরা এখানে আশ্রয় নেয়। এক চরে অনুকূল পরিবেশ না পেলে তারা আরেক চরে উড়ে যায়। আইইউসিএনের আরেক গবেষক সারোয়ার আলম বলেন, আমরা সাধারণত হাওর অঞ্চলের পাখির শুমারি করে থাকি। তবে এ শীত মৌসুমে রাজশাহীতে প্রথম শুমারি করা হয়েছে। রাজশাহীর অভ্যন্তরে থাকা পদ্মা নদীর প্রায় ৩৯ কিলোমিটার অংশে আমরা শুমারি করেছি। যার মধ্যে পবা উপজেলার চরখানপুর, খিদিরপুর, দশনম্বর চর ও চারঘাট অংশ ও খিদিরপুরের মধ্যচরে সবচেয়ে বেশি পাখির বিচরণ দেখেছি। রাজশাহী বার্ড ক্লাবের সদস্য নূর এ সাউদ বলেন, আমরা সর্বমোট ৪ হাজার ২৫টি পাখি গণনা করেছি। যেগুলো ৩৭ প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে ২৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সবচেয়ে বেশি বিচরণ দেখা গেছে পিয়ং হাঁসের। সৈকত পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে টেমিংয়ের চাপাখি। সবচেয়ে বিরল পাখি ছিল বৈকাল তিলিহাঁস। শুমারি চলাকালীন আইইউসিএনের উদ্যোগে দূর পরিযায়ী এক পাখির পিঠে ট্র্যাকার বসানো হয়। সেই পাখিটির নাম পাতি তিলিহাঁস। ইংরেজী নাম ‘কমন টিল’। এটি দুর্লভ প্রজাতির পাখি। এর মাধ্যমে পাখিটির চলাচলের পথ ও আচরণ সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। প্রতি ঘণ্টায় মোবাইল ফোনে এর গতিবিধির হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রতি কোন এক দুপুরে পদ্মা নদীর মাঝারদিয়া এলাকায় পাখিটি ছেড়ে দেয়ার পরদিন বিকেল সোয়া ৫টা পর্যন্ত সে সাড়ে ৯ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছে। তখন পর্যন্ত তার সর্বশেষ অবস্থান ছিল পবা উপজেলার চরখানপুর এলাকায়। আইইউসিএনের গবেষক সারোয়ার আলম জানান, হাঁস জাতের পাখিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। এটির ওজন ৩১০ গ্রাম। এটি সবচেয়ে দূর পরিযায়ী হাঁস। ট্যাগের ওজন প্রায় ১০ গ্রাম- যা পাখির শরীরের ওজনের মাত্র ৩ শতাংশ। ফলে এর স্বাভাবিক চলাফেরায় সমস্যা হয়নি। গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য এটি বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি।
এদিকে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে একাধিক কুমিরের দেখা মিলেছে। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক একটি কুমিরের ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী দম্পতি ইমরুল কায়েস ও উম্মে খাদিজা ইভা। ছোট কুমির দেখেছেন স্থানীয় জেলেরা। এ অবস্থায় নদীতে গোসল না করতে এলাকাবাসীকে মাইকিং ও লিফলেটের মাধ্যমে সতর্ক করছে রাজশাহী বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।
গত ১৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিকেলে পদ্মার ষাটবিঘা চরে পাখির ছবি তুলতে গিয়ে কায়েস দম্পতি কুমিরটির দেখা পান। ড্রোনে ধারণ করা ভিডিও ও ছবিতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় কুমিরটি পানির ধারে রোদ পোহাচ্ছে। স্থানীয় রাজু আহাম্মেদ প্রথম কুমিরটি দেখেছিলেন গরু চরাতে গিয়ে। আইইউসিএন জানিয়েছে, ছবিতে দেখা প্রাণীটি মিঠাপানির কুমির, যা বাংলাদেশে বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
আইইউসিএনের মুখ্য গবেষক এ বি এম সারোয়ার আলম জানান, ২০১৫ সালে মিঠাপানির কুমির বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরে পাবনা ও আরও দুটি স্থানে কুমির দেখা যায়, যেগুলো এখন সুন্দরবনের করমজল প্রজননকেন্দ্রে সংরক্ষিত। তিনি ধারণা করছেন, রাজশাহীর কুমিরটি সম্ভবত ভারতের চাম্বুল নদ এলাকা থেকে এসেছে। রাজশাহী বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, স্থানীয় জেলেরা ছোট কুমিরও দেখেছেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মায় একাধিক কুমির রয়েছে। তিনি বলেন, “এগুলো জলজ প্রাণী, জলেই থাকুক। তাদের বিরক্ত করা যাবে না।”
এদিকে স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ প্রশাসনের কাছে কুমিরটি ধরে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তবে আলোকচিত্রী ইমরুল কায়েস চান, কুমিরটি যেন মুক্তভাবে নদীতেই থাকে, যাতে এর প্রজনন সম্ভব হয়। তাঁর আশঙ্কা, আইইউসিএন কুমিরটিকে ধরে নিয়ে যেতে পারে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগের লিফলেটে বলা হয়েছে, কুমির হিং¯্র হলেও তারা জলজ বাস্ততন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই কুমির দেখলে বিরক্ত না করা, নদীতে গোসল না করা, শিশুদের নদীর ধারে না পাঠানো, ছোট নৌকা চলাচল সাময়িক বন্ধ রাখা এবং রোদ পোহানো কুমিরের দিকে ঢিল না ছোড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। লিফলেটে আরও উল্যেখ করা হয়েছে, বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী কুমিরকে বিরক্ত করা, ধরা, হত্যা করা বা বিক্রি করা দন্ডনীয় অপরাধ। সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদন্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।