দুটি হাত নেই, তবু থেমে নেই তার জীবনযুদ্ধ। অদম্য ইচ্ছে শক্তি, মনোবল ও পরিশ্রমকে সঙ্গী করে সংগ্রামী পথচলা চালিয়ে যাচ্ছেন দিনাজপুরের হাকিমপুর (হিলি) উপজেলার জালালপুর গ্রামের দুই হাতবিহীন যুবক রুবেল হোসেন। ভিক্ষার থালা নয়, গলায় ঝোলানো ডিমের ডালা নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় রাস্তায় নামেন তিনি। নিজের পরিশ্রমেই সংসারের চাকা ঘোরাতে চান এই অদম্য পঙ্গু মানুষটি। ২৫ বছর বয়সী রুবেলের জীবন শুরু হয় এক দুঃসহ দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে, মাত্র ৮ বছর বয়সে বর্ষায় মাঠে গরু আনতে গিয়ে স্পর্শ করেন ঝড়ে ছিঁড়ে পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে। অজ্ঞাতসারে দুই হাতে তার ধরে থাকা শিশুটি মুহূর্তেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। স্থানীয়রা মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলেও চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, বাঁচাতে হলে দুই হাত কেটে ফেলতেই হবে। তখন থেকেই শুরু হয় রুবেলের নতুন জীবন, সংগ্রামের জীবন। রুবেলের বাবা বহু আগেই মারা গেছেন। অসহায় মা-ই তাকে বড় করেছেন নানা কষ্ট সহ্য করে। হাত না থাকায় নিজের শরীরের প্রয়োজনীয় কোনো কাজই তিনি নিজে করতে পারেন না। খাওয়া-দাওয়া থেকে গোসল, এমনকি পোশাক পরিবর্তন, সবই করেন রুবেলের মা বা প্রতিবেশীরা। শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও কখনও ভিক্ষার পথে হাঁটেননি রুবেল। ছোটবেলা থেকেই দুই পায়ে ভর করে পালন করেছেন ছাগল। নিজের পরিশ্রমের ওপরই ছিল তার বিশ্বাস। বিয়েও করেছেন, সংসারে এসেছে এক কন্যা সন্তান। সংসারের চাহিদা বাড়ায় এখন ডিমের ব্যবসা করছেন তিনি।
প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই গলায় ডিম ভর্তি ডালা ঝুলিয়ে হিলি শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ঘুরে বিক্রি করেন সিদ্ধ ডিম। তার দুই হাত নেই, ফলে ডিমের খোসা ছড়িয়ে ক্রেতাকে দেওয়ার মতো কোনো উপায়ও নেই। তবুও মানুষ তাকে ফেলে যায় না। বরং নিজেরাই ডালা থেকে ডিম নিয়ে খোসা ছিঁড়ে খান, দামটা দিয়ে দেন রুবেলের পকেটে। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ডিম বিক্রি করে তিনি আয় করেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
হঠাৎ তাকে দেখে থমকে দাঁড়ান পথচারীরাও। বিস্ময়ের সঙ্গে মিশে থাকে মায়া, আর থাকে শ্রদ্ধা, কারণ ভিক্ষা নয়, নিজের সামর্থ্য ও পরিশ্রমের ওপর ভর করেই তিনি গড়ছেন নিজের স্বপ্ন। পাঁচবিবি থেকে কাজে হিলিতে আসা আইনুল হক বলেন, দূর থেকে দেখে ভাবলাম শীতের দিনে একটু ডিম খাব। কাছে এসে দেখি যুবকের দুহাতই নেই। নিজেই ডালা থেকে ডিম নিয়ে খোসা ছিঁড়ে খেলাম। সে চাইলে ভিক্ষা করতে পারতো, কিন্তু করছে না। তার ইচ্ছে শক্তিকে আমি স্যালুট জানাই।
আরেক ক্রেতা লুৎফর রহমান বলেন, দেখলাম গলায় ডিমের ডালা ঝুলানো। কাছে গিয়ে বুঝলাম তার হাতে নেই। মনে গভীর মায়া লাগলো। নিজের হাতে ডিম নিয়ে খেলাম। সত্যিই বিচিত্র এই দুনিয়া, আর রুবেলের মতো মানুষেরা আমাদের শিক্ষা দেয়অক্ষমতা নয়, মনোবলই বড় শক্তি। স্থানীয় রাব্বি ও মতিন আলী বলেন, রুবেলকে আমরা চিনি। সে খুব অসহায়, দুই হাত নেই। কিন্তু ভিক্ষা করে না। ডিম বিক্রি করে সংসার চালায়। তার জীবনযুদ্ধ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে রুবেল বলেন, ছোটবেলায় কারেন্টে দুই হাত গেছে। মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে। দুই বছর হলো বিয়ে করেছি, একটা মেয়ে হয়েছে। সংসারে খরচ বাড়ছে তাই বসে থাকলে হবে না। ডিমের ব্যবসা করছি। মানুষ খুব ভালো, সবাই দয়া করে আমাকে সাহায্য করে। ছোটবেলা থেকে পরিশ্রম করে আসছি, কখনো কারও কাছে হাত বাড়াইনি।
তিনি আরও জানান, অনেক আগে থেকেই পঙ্গু ভাতা পাই। ব্যবসা আর ভাতার টাকায় আল্লাহর রহমতে সংসার ভালোই চলছে। অদম্য এই তরুণ আজ মানুষের চোখে অনুপ্রেরণার প্রতীক। শারীরিক অক্ষমতা নয়, ইচ্ছে শক্তি আর আত্মবিশ্বাসই যে জীবনের আসল চালিকা শক্তি, রুবেল তারই জীবন্ত উদাহরণ।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫
দুটি হাত নেই, তবু থেমে নেই তার জীবনযুদ্ধ। অদম্য ইচ্ছে শক্তি, মনোবল ও পরিশ্রমকে সঙ্গী করে সংগ্রামী পথচলা চালিয়ে যাচ্ছেন দিনাজপুরের হাকিমপুর (হিলি) উপজেলার জালালপুর গ্রামের দুই হাতবিহীন যুবক রুবেল হোসেন। ভিক্ষার থালা নয়, গলায় ঝোলানো ডিমের ডালা নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় রাস্তায় নামেন তিনি। নিজের পরিশ্রমেই সংসারের চাকা ঘোরাতে চান এই অদম্য পঙ্গু মানুষটি। ২৫ বছর বয়সী রুবেলের জীবন শুরু হয় এক দুঃসহ দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে, মাত্র ৮ বছর বয়সে বর্ষায় মাঠে গরু আনতে গিয়ে স্পর্শ করেন ঝড়ে ছিঁড়ে পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে। অজ্ঞাতসারে দুই হাতে তার ধরে থাকা শিশুটি মুহূর্তেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। স্থানীয়রা মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলেও চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, বাঁচাতে হলে দুই হাত কেটে ফেলতেই হবে। তখন থেকেই শুরু হয় রুবেলের নতুন জীবন, সংগ্রামের জীবন। রুবেলের বাবা বহু আগেই মারা গেছেন। অসহায় মা-ই তাকে বড় করেছেন নানা কষ্ট সহ্য করে। হাত না থাকায় নিজের শরীরের প্রয়োজনীয় কোনো কাজই তিনি নিজে করতে পারেন না। খাওয়া-দাওয়া থেকে গোসল, এমনকি পোশাক পরিবর্তন, সবই করেন রুবেলের মা বা প্রতিবেশীরা। শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও কখনও ভিক্ষার পথে হাঁটেননি রুবেল। ছোটবেলা থেকেই দুই পায়ে ভর করে পালন করেছেন ছাগল। নিজের পরিশ্রমের ওপরই ছিল তার বিশ্বাস। বিয়েও করেছেন, সংসারে এসেছে এক কন্যা সন্তান। সংসারের চাহিদা বাড়ায় এখন ডিমের ব্যবসা করছেন তিনি।
প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই গলায় ডিম ভর্তি ডালা ঝুলিয়ে হিলি শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ঘুরে বিক্রি করেন সিদ্ধ ডিম। তার দুই হাত নেই, ফলে ডিমের খোসা ছড়িয়ে ক্রেতাকে দেওয়ার মতো কোনো উপায়ও নেই। তবুও মানুষ তাকে ফেলে যায় না। বরং নিজেরাই ডালা থেকে ডিম নিয়ে খোসা ছিঁড়ে খান, দামটা দিয়ে দেন রুবেলের পকেটে। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ডিম বিক্রি করে তিনি আয় করেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
হঠাৎ তাকে দেখে থমকে দাঁড়ান পথচারীরাও। বিস্ময়ের সঙ্গে মিশে থাকে মায়া, আর থাকে শ্রদ্ধা, কারণ ভিক্ষা নয়, নিজের সামর্থ্য ও পরিশ্রমের ওপর ভর করেই তিনি গড়ছেন নিজের স্বপ্ন। পাঁচবিবি থেকে কাজে হিলিতে আসা আইনুল হক বলেন, দূর থেকে দেখে ভাবলাম শীতের দিনে একটু ডিম খাব। কাছে এসে দেখি যুবকের দুহাতই নেই। নিজেই ডালা থেকে ডিম নিয়ে খোসা ছিঁড়ে খেলাম। সে চাইলে ভিক্ষা করতে পারতো, কিন্তু করছে না। তার ইচ্ছে শক্তিকে আমি স্যালুট জানাই।
আরেক ক্রেতা লুৎফর রহমান বলেন, দেখলাম গলায় ডিমের ডালা ঝুলানো। কাছে গিয়ে বুঝলাম তার হাতে নেই। মনে গভীর মায়া লাগলো। নিজের হাতে ডিম নিয়ে খেলাম। সত্যিই বিচিত্র এই দুনিয়া, আর রুবেলের মতো মানুষেরা আমাদের শিক্ষা দেয়অক্ষমতা নয়, মনোবলই বড় শক্তি। স্থানীয় রাব্বি ও মতিন আলী বলেন, রুবেলকে আমরা চিনি। সে খুব অসহায়, দুই হাত নেই। কিন্তু ভিক্ষা করে না। ডিম বিক্রি করে সংসার চালায়। তার জীবনযুদ্ধ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে রুবেল বলেন, ছোটবেলায় কারেন্টে দুই হাত গেছে। মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে। দুই বছর হলো বিয়ে করেছি, একটা মেয়ে হয়েছে। সংসারে খরচ বাড়ছে তাই বসে থাকলে হবে না। ডিমের ব্যবসা করছি। মানুষ খুব ভালো, সবাই দয়া করে আমাকে সাহায্য করে। ছোটবেলা থেকে পরিশ্রম করে আসছি, কখনো কারও কাছে হাত বাড়াইনি।
তিনি আরও জানান, অনেক আগে থেকেই পঙ্গু ভাতা পাই। ব্যবসা আর ভাতার টাকায় আল্লাহর রহমতে সংসার ভালোই চলছে। অদম্য এই তরুণ আজ মানুষের চোখে অনুপ্রেরণার প্রতীক। শারীরিক অক্ষমতা নয়, ইচ্ছে শক্তি আর আত্মবিশ্বাসই যে জীবনের আসল চালিকা শক্তি, রুবেল তারই জীবন্ত উদাহরণ।