খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়া একসময় ছিল সোনার ফসলের মাঠ। ধান, শাকসবজি, পাট, ডাল সবকিছুই ফলতো এই উর্বর জমিতে।কিন্তু এখন সেই চিত্র অতীত। অতিবৃষ্টির কারণে বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা এমনভাবে বেড়েছে যে কৃষকের মাঠে আর ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। জমির বুকজুড়ে জমে থাকা পানি এখন মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে হাতের লাঙল ফেলে ধরেছেন জাল আর ঘুনি।
৬০বছর বয়সী অচিন্ত মহাজন কৃষ্ণনগর গ্রামের মানুষ।বর্তমানে থাকছেন উত্তর বিলপাবলা। একসময় ছিলেন কৃষক, এখন মৎস্যজীবী। নিজের দুই একর জমিতে ধান চাষ করে সংসার চলত মোটামুটি। কিন্তু গত কয়েক বছরের অতিবৃষ্টিতে বিল ডাকাতিয়া এলাকা ডুবে থাকে প্রায় সারা বছরই। ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, মাছও ভেসে গেছে। এখন তিন সদস্যের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে।অচিন্তর কথায়, জমি আছে, কিন্তু কিছু ফলাইতে পারি না। এখন বিলের মাছই ভরসা। সকালেই জাল নিয়ে যাই, মাছ ধরি, বিকেলে একটি আড়ৎ ঘরে কাজ করি। যা পাই, তাই দিয়ে সংসার চলে।তার মতো একই অবস্থায় পড়েছেন গ্রামের অনেকেই।রমেশ বালা (৫০),প্রশান্ত মন্ডল(৪৫)শিশির ঢাল(৫০)সবাই কোনোনা কোনোভাবে জাল বুনছেন, ঘুনি বানাচ্ছেন, কিংবা মাছ বিক্রির কাজে লেগে আছেন। কৃষকের গ্রাম এখন একরকম মৎস্যজীবী গ্রামে পরিণত হয়েছে। আগে মাছ ধরা কাজটি অনেকের চোখে ছিল তুচ্ছ । কিন্তু এখন সেই সামাজিক ভেদাভেদ মিলিয়ে গেছে পেটের দায়ে।
বিল ডাকাতিয়া এলাকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা তারক চন্দ্র ম-ল বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে ধান বা ফসল কিছুই উৎপাদন হচ্ছে না। জমি থেকে এখন আর কোনো লাভ নেই। সবাই এখন মাছ ধরে বেঁচে আছে। আগে কে কৃষক, কে শ্রমিক, কে নেতা এখন সবাই এক। তারকের কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গভীর সামাজিক বাস্তবতা। বন্যা, জলাবদ্ধতা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানুষকে নতুন জীবনধারায় ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষিত বেকার যুবক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাও এখন মাছ বিক্রির ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে সকাল সকাল বাজারে ছুটছেন।এই রূপান্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এলাকার নারীরাও।
কৃষ্ণনগর গ্রামের শুকদেব মহাজন(৬০)প্রতিদিন সকালে কৃষ্ণনগর মৎস্য আড়তে মাছ বাছাই ও সংরক্ষণের কাজ করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে পান ৪০-৫০ টাকা।শুকদেব বলেন, আগে স্কৃষিকাজেই সংসার চলত, এখন অন্য কাজ না করলে সংসার চলে না।একসময় গ্রামীণ নারীরা মাঠের কাজ বা মাছের আড়তে কাজ করাকে অপছন্দ করতেন। কিন্তু এখন বিল ডাকাতিয়ার নারীরাও পরিবার চালাতে পুরুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সমাজে এই পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক নয়, নারীর ভূমিকার ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনছে।
মাছ ধরার পাশাপাশি ব্যবসায়িক চক্রও গড়ে উঠেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন সকালে কৃষ্ণনগর আড়ত থেকে ৪-৫ হাজার টাকার মাছ কিনে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করেন। লাভ খুব বেশি না হলেও এতে সংসার চলে। কোনোদিন লাভ হয়, কোনোদিন লোকসান। তবু থামলে তো পেট চলবেনা, বলেন একজন মাছ ফেরিওয়ালা হরশিত মন্ডল।এভাবে দিন দিন বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলে একটি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি হচ্ছে। আগে কৃষকরা যেখানে বীজ, সার আর জমির ওপর নির্ভর করতেন,এখন তারা জালের গুণ, চারোর মজবুতি, আর বাজারদরের খবর রাখেন।বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলে এই জলাবদ্ধতার সমস্যা নতুন নয়,কিন্তু এখন তা স্থায়ী আকার ধারণ করেছে। নদী ভরাট, নিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতা, এবং অতি বর্ষণ মিলিয়ে পানি নামার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ফসলি জমি এখন পরিণত হয়েছে স্থায়ী জলাশয়ে। স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খুলনা অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে গেছে কখনো অতিবৃষ্টি, কখনো খরা। এই পরিস্থিতিতে কৃষকেরা ধীরে ধীরে মাছ চাষ বা মাছ ধরার দিকে ঝুঁকছেন।
অনেকেই আবার নতুনভাবে চিন্তা করছেন যেমন ভাসমান শাকসবজি চাষ বা মিশ্র খামার প্রকল্প গড়ার।
বিল ডাকাতিয়ার গল্প আসলে বাংলাদেশের বহু নিম্নাঞ্চলের গল্প। যেখানে প্রকৃতি বদলেছে, সেখানে মানুষও বদলে গেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে।অচিন্ত মহাজন,শুকদেব মহাজনের মতো মানুষরা জানেন,আগামী মৌসুমেও হয়তো ফসল ফলবে না। তবুও তারা হাল ছাড়েননি। ভোরের কুয়াশায়,বিলে জাল ফেলতে ফেলতে তারা আশার গান গেয়ে যান জল তো আছে,মাছও আছে, পরিশ্রম করলে কিছু না কিছু মিলবেই।বিল ডাকাতিয়ার এই মানুষদের জীবন এখন টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক। প্রকৃতির বিরুপ আচারনে তারা মাথা নোয়াননি বরং নিজেদের নতুন পরিচয়ে গড়ে তুলেছেন জীবিকার নতুন পথ।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়া একসময় ছিল সোনার ফসলের মাঠ। ধান, শাকসবজি, পাট, ডাল সবকিছুই ফলতো এই উর্বর জমিতে।কিন্তু এখন সেই চিত্র অতীত। অতিবৃষ্টির কারণে বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা এমনভাবে বেড়েছে যে কৃষকের মাঠে আর ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। জমির বুকজুড়ে জমে থাকা পানি এখন মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে হাতের লাঙল ফেলে ধরেছেন জাল আর ঘুনি।
৬০বছর বয়সী অচিন্ত মহাজন কৃষ্ণনগর গ্রামের মানুষ।বর্তমানে থাকছেন উত্তর বিলপাবলা। একসময় ছিলেন কৃষক, এখন মৎস্যজীবী। নিজের দুই একর জমিতে ধান চাষ করে সংসার চলত মোটামুটি। কিন্তু গত কয়েক বছরের অতিবৃষ্টিতে বিল ডাকাতিয়া এলাকা ডুবে থাকে প্রায় সারা বছরই। ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, মাছও ভেসে গেছে। এখন তিন সদস্যের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে।অচিন্তর কথায়, জমি আছে, কিন্তু কিছু ফলাইতে পারি না। এখন বিলের মাছই ভরসা। সকালেই জাল নিয়ে যাই, মাছ ধরি, বিকেলে একটি আড়ৎ ঘরে কাজ করি। যা পাই, তাই দিয়ে সংসার চলে।তার মতো একই অবস্থায় পড়েছেন গ্রামের অনেকেই।রমেশ বালা (৫০),প্রশান্ত মন্ডল(৪৫)শিশির ঢাল(৫০)সবাই কোনোনা কোনোভাবে জাল বুনছেন, ঘুনি বানাচ্ছেন, কিংবা মাছ বিক্রির কাজে লেগে আছেন। কৃষকের গ্রাম এখন একরকম মৎস্যজীবী গ্রামে পরিণত হয়েছে। আগে মাছ ধরা কাজটি অনেকের চোখে ছিল তুচ্ছ । কিন্তু এখন সেই সামাজিক ভেদাভেদ মিলিয়ে গেছে পেটের দায়ে।
বিল ডাকাতিয়া এলাকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা তারক চন্দ্র ম-ল বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে ধান বা ফসল কিছুই উৎপাদন হচ্ছে না। জমি থেকে এখন আর কোনো লাভ নেই। সবাই এখন মাছ ধরে বেঁচে আছে। আগে কে কৃষক, কে শ্রমিক, কে নেতা এখন সবাই এক। তারকের কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গভীর সামাজিক বাস্তবতা। বন্যা, জলাবদ্ধতা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানুষকে নতুন জীবনধারায় ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষিত বেকার যুবক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাও এখন মাছ বিক্রির ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে সকাল সকাল বাজারে ছুটছেন।এই রূপান্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এলাকার নারীরাও।
কৃষ্ণনগর গ্রামের শুকদেব মহাজন(৬০)প্রতিদিন সকালে কৃষ্ণনগর মৎস্য আড়তে মাছ বাছাই ও সংরক্ষণের কাজ করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে পান ৪০-৫০ টাকা।শুকদেব বলেন, আগে স্কৃষিকাজেই সংসার চলত, এখন অন্য কাজ না করলে সংসার চলে না।একসময় গ্রামীণ নারীরা মাঠের কাজ বা মাছের আড়তে কাজ করাকে অপছন্দ করতেন। কিন্তু এখন বিল ডাকাতিয়ার নারীরাও পরিবার চালাতে পুরুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সমাজে এই পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক নয়, নারীর ভূমিকার ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনছে।
মাছ ধরার পাশাপাশি ব্যবসায়িক চক্রও গড়ে উঠেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন সকালে কৃষ্ণনগর আড়ত থেকে ৪-৫ হাজার টাকার মাছ কিনে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করেন। লাভ খুব বেশি না হলেও এতে সংসার চলে। কোনোদিন লাভ হয়, কোনোদিন লোকসান। তবু থামলে তো পেট চলবেনা, বলেন একজন মাছ ফেরিওয়ালা হরশিত মন্ডল।এভাবে দিন দিন বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলে একটি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি হচ্ছে। আগে কৃষকরা যেখানে বীজ, সার আর জমির ওপর নির্ভর করতেন,এখন তারা জালের গুণ, চারোর মজবুতি, আর বাজারদরের খবর রাখেন।বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলে এই জলাবদ্ধতার সমস্যা নতুন নয়,কিন্তু এখন তা স্থায়ী আকার ধারণ করেছে। নদী ভরাট, নিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতা, এবং অতি বর্ষণ মিলিয়ে পানি নামার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ফসলি জমি এখন পরিণত হয়েছে স্থায়ী জলাশয়ে। স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খুলনা অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে গেছে কখনো অতিবৃষ্টি, কখনো খরা। এই পরিস্থিতিতে কৃষকেরা ধীরে ধীরে মাছ চাষ বা মাছ ধরার দিকে ঝুঁকছেন।
অনেকেই আবার নতুনভাবে চিন্তা করছেন যেমন ভাসমান শাকসবজি চাষ বা মিশ্র খামার প্রকল্প গড়ার।
বিল ডাকাতিয়ার গল্প আসলে বাংলাদেশের বহু নিম্নাঞ্চলের গল্প। যেখানে প্রকৃতি বদলেছে, সেখানে মানুষও বদলে গেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে।অচিন্ত মহাজন,শুকদেব মহাজনের মতো মানুষরা জানেন,আগামী মৌসুমেও হয়তো ফসল ফলবে না। তবুও তারা হাল ছাড়েননি। ভোরের কুয়াশায়,বিলে জাল ফেলতে ফেলতে তারা আশার গান গেয়ে যান জল তো আছে,মাছও আছে, পরিশ্রম করলে কিছু না কিছু মিলবেই।বিল ডাকাতিয়ার এই মানুষদের জীবন এখন টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক। প্রকৃতির বিরুপ আচারনে তারা মাথা নোয়াননি বরং নিজেদের নতুন পরিচয়ে গড়ে তুলেছেন জীবিকার নতুন পথ।