ধান মাড়াই মেশিন তৈরিতে ব্যস্ত কারিগর -সংবাদ
এক সময়ে গরু ঘুরিয়ে অর্থাৎ মলন মলে কৃষকরা ধান ঘরে তুলতেন। আর বিছালী (গো-খাদ্য) পেতে পাকা ধানের মুঠো আছড়িয়ে ধান সংগ্রহ করতেন তারা।
দক্ষ কারিগরদের তৈরি, ফলে আমন মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারদের ভিড় জমে
কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের আওতায় আনতে ভূমিকা রাখছে এই যন্ত্র
কৃষিতে উৎপাদন ব্যয়, শ্রম ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে
এসব সনাতন ও কষ্টসাধ্য পদ্ধতি বদলে কৃষিতেও এসেছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। এখনকার দিনে মটরচালিত মাড়াই মেশিনের সাহায্যে ধান মাড়াই করা হচ্ছে সহজে। এতে একদিকে উৎপাদন ব্যয় কমছে, অন্যদিকে সময়েরও সাশ্রয় হচ্ছে। যদিও প্রথম দিকে রাইস হারভেস্টার বা ধান রোপণ ও মাড়াইযন্ত্র বেশি দামে কিনতে হয়েছিলো কৃষককে।
সময়ের গতিতে এখন ধান মাড়াইয়ের এ মেশিন দেশেই তৈরি হওয়ার ফলে সহজে কিনতে পাচ্ছেন কৃষক। সারাদেশের মধ্যে কুমিল্লার পরে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জেই বেশি তৈরি হচ্ছে এ যন্ত্রটি।
এখন আমন সংগ্রহের সময়ে এখানকার কারিগরদের তৈরিকৃত ধান মাড়াইয়ের মেশিন যাচ্ছে ফরিদপুর, মাদারীপুর, মাগুরা, রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের অধিকাংশ জেলায়।
সরেজমিনে কালীগঞ্জ শহরের বেশ কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা যায়, শহরের বিভিন্ন সড়কের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা স্থানগুলোতে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো ওয়ার্কশপ। যেখানে কারিগরদের দম ফেলার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাদের মধ্যে কেউ কাঠের বডি তৈরি করছেন, কেউ লেদ মেশিনে ফেলে ঝালাইয়ের কাজ ও মেশিনের সব অংশ সেট করছেন, আবার কেউবা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ত্যাড়া-বাঁকা ঠিক করছেন। আর সর্বশেষ নিপুণ হাতে কেউ কেউ করছেন রঙের কাজ। এছাড়া কারখানার মালিক কখনও মুঠোফোনে লেনদেন সারছেন, আবার ঘুরে ঘুরে কারিগরদের কাজ দেখছেন, দিচ্ছেন নির্দেশনা। অবস্থাটা এমন চারপাশে যেন কাজের প্রতিযোগিতা চলছে।
একাধিক কারিগর জানান, সারাবছর তারা কারখানায় কাজ করেন। তবে আমন ও বোরো ধান ঘরে তোলার সময়ে কাজের ব্যস্ততায় তাদের খাওয়া ও ঘুম বন্ধের উপক্রম হয়। তারা বলেন, দেশের সব জেলাতেই ধান উৎপাদন হয়। কিন্ত সব জেলাতে ধান মাড়াইয়ের মেশিন তৈরি হয় না। সেদিক দিয়ে সারাদেশের মধ্যে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কারণ এখানকার কারিগরদের তৈরিকৃত ধান মাড়াইয়ের মেশিন অত্যন্ত মজবুত ও টেকসই।
জানা যায়, ৩০-৩৫ বছর আগে ধান মাড়াই মৌসুমের সময় কয়েকজন কারিগরকে বেতন চুক্তিতে এনে কাজ করাতেন এখানকার কারখানা মালিকরা। তাদের কাছ থেকে স্থানীয় কারিগররা সব কাজ ভালোভাবে শিখে নেন। তারা আরও জানান, ধান মাড়াই মেশিন তৈরিতে সারাদেশের মধ্যে এখনও কুমিল্লা সেরা। তবে কালীগঞ্জ আছে তার পরের অবস্থানেই। কারিগর চন্দন বিশ্বাস জানান, প্রায় ২৮ বছর ধরে ওয়ার্কশপে কাজ করেন। কারখানায় সারাবছর ধান মাড়াই মেশিনের অংশ বিশেষ তৈরি করে রাখেন। আর মৌসুম আসলেই এগুলো শুধুমাত্র সেটিং শেষে আকর্ষণীয় রঙ করে ছেড়ে দেন। যে কারণে তখন বাইরের জেলাসহ দূর-দূরান্তে দ্রুত পণ্য পাঠাতে পারেন। তিনি আরও বলেন, একটি উপজেলা শহর হলেও কালীগঞ্জের ধান মাড়াইয়ের মেশিনের বিশেষ চাহিদা রয়েছে বলেই সারাদেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এখান থেকে মেশিন কিনে নিয়ে নিজ এলাকায় বিক্রি করেন।
দিশারী কাঠহোলা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের সত্ত্বাধিকারী আলহাজ্ব লুৎফর রহমান জানান, এখানকার কারিগরদের দক্ষতা অনেক বেশি। তাদের তৈরিকৃত ধান মাড়াইয়ের মেশিন সহজে ব্যবহার উপযোগী ও অধিক টেকসই। সারাদেশের পাইকাররা মৌসুম আসলেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। চাহিদা মতো মালের অর্ডার দিয়ে গাড়ি ভরে নিয়ে যান। তিনি বলেন, তার কারখানায় সারাবছর কমপক্ষে ৫০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। তবে মৌসুম আসলেই তার ৩ গুণ বেশি শ্রমিক কাজে লাগাতে হয়। তারপরও চাহিদা অনুযায়ী মাল ডেলিভারি দিতে পারেন না। প্রায় ২২ বছর ধরে কারখানা চালাচ্ছেন। যতদিন যাচ্ছে ক্রমেই এখানকার ধান মাড়াইয়ের মেশিনের চাহিদা সারাদেশে বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
একতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সত্ত্বাধিকারী সনজিৎ বিশ^াস জানান, পা দিয়ে চালানো ধানঝাড়া মেশিন এখন মটরচালিত। ফলে অপেক্ষাকৃত টেকসই করেই এ মেশিন বানাতে হয়। আর অত্যন্ত নিখুঁতভাবে মেশিনের বিয়ারিং সেটের কাজ করা লাগে। যেগুলোর জন্য এখানকার কারিগররা বিশেষ পারদর্শী। ফলে এখানকার ধান মাড়াই মেশিন বেশি টেকসই, মজবুত ও সহজচালিত হয়।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনি জানান, কৃষিতে এখন আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। সরকারিভাবে ফসল রোপণ, কর্তন ও মাড়াই মেশিন কৃষকদের ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কালীগঞ্জের অনেকগুলো ওয়ার্কশপ ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দক্ষ কারিগর দিয়ে ধান মাড়াইয়ের মেশিন তৈরি করে বিভিন্ন জেলায় সাপ্লাই দিচ্ছে তারা। তিনি বলেন, এগুলো কৃষি যান্ত্রিকীকরণের একটি বিরাট উদাহরণ।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ধান মাড়াই মেশিন তৈরিতে ব্যস্ত কারিগর -সংবাদ
বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫
এক সময়ে গরু ঘুরিয়ে অর্থাৎ মলন মলে কৃষকরা ধান ঘরে তুলতেন। আর বিছালী (গো-খাদ্য) পেতে পাকা ধানের মুঠো আছড়িয়ে ধান সংগ্রহ করতেন তারা।
দক্ষ কারিগরদের তৈরি, ফলে আমন মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারদের ভিড় জমে
কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের আওতায় আনতে ভূমিকা রাখছে এই যন্ত্র
কৃষিতে উৎপাদন ব্যয়, শ্রম ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে
এসব সনাতন ও কষ্টসাধ্য পদ্ধতি বদলে কৃষিতেও এসেছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। এখনকার দিনে মটরচালিত মাড়াই মেশিনের সাহায্যে ধান মাড়াই করা হচ্ছে সহজে। এতে একদিকে উৎপাদন ব্যয় কমছে, অন্যদিকে সময়েরও সাশ্রয় হচ্ছে। যদিও প্রথম দিকে রাইস হারভেস্টার বা ধান রোপণ ও মাড়াইযন্ত্র বেশি দামে কিনতে হয়েছিলো কৃষককে।
সময়ের গতিতে এখন ধান মাড়াইয়ের এ মেশিন দেশেই তৈরি হওয়ার ফলে সহজে কিনতে পাচ্ছেন কৃষক। সারাদেশের মধ্যে কুমিল্লার পরে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জেই বেশি তৈরি হচ্ছে এ যন্ত্রটি।
এখন আমন সংগ্রহের সময়ে এখানকার কারিগরদের তৈরিকৃত ধান মাড়াইয়ের মেশিন যাচ্ছে ফরিদপুর, মাদারীপুর, মাগুরা, রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের অধিকাংশ জেলায়।
সরেজমিনে কালীগঞ্জ শহরের বেশ কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা যায়, শহরের বিভিন্ন সড়কের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা স্থানগুলোতে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো ওয়ার্কশপ। যেখানে কারিগরদের দম ফেলার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাদের মধ্যে কেউ কাঠের বডি তৈরি করছেন, কেউ লেদ মেশিনে ফেলে ঝালাইয়ের কাজ ও মেশিনের সব অংশ সেট করছেন, আবার কেউবা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ত্যাড়া-বাঁকা ঠিক করছেন। আর সর্বশেষ নিপুণ হাতে কেউ কেউ করছেন রঙের কাজ। এছাড়া কারখানার মালিক কখনও মুঠোফোনে লেনদেন সারছেন, আবার ঘুরে ঘুরে কারিগরদের কাজ দেখছেন, দিচ্ছেন নির্দেশনা। অবস্থাটা এমন চারপাশে যেন কাজের প্রতিযোগিতা চলছে।
একাধিক কারিগর জানান, সারাবছর তারা কারখানায় কাজ করেন। তবে আমন ও বোরো ধান ঘরে তোলার সময়ে কাজের ব্যস্ততায় তাদের খাওয়া ও ঘুম বন্ধের উপক্রম হয়। তারা বলেন, দেশের সব জেলাতেই ধান উৎপাদন হয়। কিন্ত সব জেলাতে ধান মাড়াইয়ের মেশিন তৈরি হয় না। সেদিক দিয়ে সারাদেশের মধ্যে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কারণ এখানকার কারিগরদের তৈরিকৃত ধান মাড়াইয়ের মেশিন অত্যন্ত মজবুত ও টেকসই।
জানা যায়, ৩০-৩৫ বছর আগে ধান মাড়াই মৌসুমের সময় কয়েকজন কারিগরকে বেতন চুক্তিতে এনে কাজ করাতেন এখানকার কারখানা মালিকরা। তাদের কাছ থেকে স্থানীয় কারিগররা সব কাজ ভালোভাবে শিখে নেন। তারা আরও জানান, ধান মাড়াই মেশিন তৈরিতে সারাদেশের মধ্যে এখনও কুমিল্লা সেরা। তবে কালীগঞ্জ আছে তার পরের অবস্থানেই। কারিগর চন্দন বিশ্বাস জানান, প্রায় ২৮ বছর ধরে ওয়ার্কশপে কাজ করেন। কারখানায় সারাবছর ধান মাড়াই মেশিনের অংশ বিশেষ তৈরি করে রাখেন। আর মৌসুম আসলেই এগুলো শুধুমাত্র সেটিং শেষে আকর্ষণীয় রঙ করে ছেড়ে দেন। যে কারণে তখন বাইরের জেলাসহ দূর-দূরান্তে দ্রুত পণ্য পাঠাতে পারেন। তিনি আরও বলেন, একটি উপজেলা শহর হলেও কালীগঞ্জের ধান মাড়াইয়ের মেশিনের বিশেষ চাহিদা রয়েছে বলেই সারাদেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এখান থেকে মেশিন কিনে নিয়ে নিজ এলাকায় বিক্রি করেন।
দিশারী কাঠহোলা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের সত্ত্বাধিকারী আলহাজ্ব লুৎফর রহমান জানান, এখানকার কারিগরদের দক্ষতা অনেক বেশি। তাদের তৈরিকৃত ধান মাড়াইয়ের মেশিন সহজে ব্যবহার উপযোগী ও অধিক টেকসই। সারাদেশের পাইকাররা মৌসুম আসলেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। চাহিদা মতো মালের অর্ডার দিয়ে গাড়ি ভরে নিয়ে যান। তিনি বলেন, তার কারখানায় সারাবছর কমপক্ষে ৫০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। তবে মৌসুম আসলেই তার ৩ গুণ বেশি শ্রমিক কাজে লাগাতে হয়। তারপরও চাহিদা অনুযায়ী মাল ডেলিভারি দিতে পারেন না। প্রায় ২২ বছর ধরে কারখানা চালাচ্ছেন। যতদিন যাচ্ছে ক্রমেই এখানকার ধান মাড়াইয়ের মেশিনের চাহিদা সারাদেশে বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
একতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সত্ত্বাধিকারী সনজিৎ বিশ^াস জানান, পা দিয়ে চালানো ধানঝাড়া মেশিন এখন মটরচালিত। ফলে অপেক্ষাকৃত টেকসই করেই এ মেশিন বানাতে হয়। আর অত্যন্ত নিখুঁতভাবে মেশিনের বিয়ারিং সেটের কাজ করা লাগে। যেগুলোর জন্য এখানকার কারিগররা বিশেষ পারদর্শী। ফলে এখানকার ধান মাড়াই মেশিন বেশি টেকসই, মজবুত ও সহজচালিত হয়।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনি জানান, কৃষিতে এখন আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। সরকারিভাবে ফসল রোপণ, কর্তন ও মাড়াই মেশিন কৃষকদের ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কালীগঞ্জের অনেকগুলো ওয়ার্কশপ ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দক্ষ কারিগর দিয়ে ধান মাড়াইয়ের মেশিন তৈরি করে বিভিন্ন জেলায় সাপ্লাই দিচ্ছে তারা। তিনি বলেন, এগুলো কৃষি যান্ত্রিকীকরণের একটি বিরাট উদাহরণ।