নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৩ শতাধিক মাদকের স্পটে জমজমাট মাদক ব্যবসা চলছে। এরমধ্যে শুধু কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে মাদকের স্পট রয়েছে একশ’র অধিক। এসব মাদকের স্পট নিয়ন্ত্রণে ৩০/৩৫টি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। খুচরা ব্যবসায়ীর সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি। মাদকসেবীর সংখ্যা ২০/২৫ হাজার মানুষ। এদের তালিকায় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ধর্ণাঢ্য ব্যক্তিরা রয়েছেন। ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিদের কারো কারো এ তালিকায় নাম আছে। বছরে এসব মাদকসেবীর অপচয় হয় বিপুল পরিমাণ টাকা। সন্ধ্যার পরপরই মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। সুযোগ পেয়ে শিক্ষার্থী ও তরুণরাও মাদক সেবনে ঝুঁকছে। বর্তমানে নানা প্রতিকূলতায় মাদকবিরোধী অভিযান মুখ থুবড়ে পড়ছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, রূপগঞ্জের সর্বত্রই যেন চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। উপজেলার গোলাকান্দাইল ৫নং ক্যানেল এলাকা, গোলাকান্দাইল উত্তরপাড়া বালুরমাঠ, কালী মজলিসের বাগ, মুসলিমপাড়া কাঁঠবাগান, নীলভিটা, শিংলাবো, আমলাবো, তারাবো পৌরসভার হাটিপাড়া, নোয়াপাড়া, বরাবো, রূপসী, বরপা, মৈকুলী, খাদুন, যাত্রামুড়া, গন্ধর্বপুর, কাজীপাড়া, কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র, চনপাড়া গ্রাম, পশ্চিমগাঁও, কেওডালা, নগরপাড়া, বাগবাড়ী, দেলপাড়া, নয়ামাটি, কামশাইর, বরুণা, পূর্বগ্রাম, বড়ালু, পাড়াগাঁও, নাওড়া এলাকা রীতিমতো মাদকের ডিপো, রূপগঞ্জ ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া, ইছাপুরা, পিতলগঞ্জ, মধুখালী, জাঙ্গীর, ভিংরাবো, মশুরী ও পূর্বাচল উপশহরে মাদকের সয়লাব। শুধু এসব এলাকাই নয়, উপজেলার রাতালদিয়া, সাওঘাট, পূর্ব দড়িকান্দি, মাছিমপুর, রূপসী স্লুইসগেট, কালাদি, আতলাশপুর, হাটাবো টেকপাড়া, মাসাবো, আতলাপুর, কালনী, জিন্দা, খাস কামালকাঠি, বেলদী, শিমুলিয়া, হারারবাড়ি সহ আরও অনেক এলাকায় মাদকের ব্যবসা জমজমাট। এদের মধ্যে কেউ ইয়াবা, কেউ ফেনসিডিল, কেউ হেরোইন আবার কেউবা গাঁজার ব্যবসায়ী। মাদকের কালো ছায়ায় অন্ধকার রূপগঞ্জ। অল্প সময়ে ধনী হওয়ার আশায় অনেক তরুণ ও নারীও এ পেশায় ঝুঁকছেন। মাদক বহনে শিশু-কিশোরদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। মরণ নেশা গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইসপিল, টিডিজেসিক ও লুপিজেসিক ইঞ্জেকশনসহ নানা ধরণের মাদকদ্রব্যে এখন হাতের নাগালেই। এছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে আধুরিয়া পর্যন্ত ছোট-বড় প্রায় ৫ শতাধিক শিল্পকারখানা রয়েছে। এসব শিল্পকারখানায় রয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক। এদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। এসব শ্রমিকদের অধিকাংশ বহিরাগত। এরা ছোট ছোট খুপরি ঘরে কিংবা মেস ভাড়া করে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছে। এসব খুপরি ঘরে মাদক ব্যবসায়ীরা ফেরি করে মাদকদ্রব্য সরবরাহ করছে। সড়ক ও নৌপথে এলাকায় অবাধে মাদকদ্রব্য আসে।

চনপাড়া পূণর্বাসন কেন্দ্রে মাদক বেচাকেনা চলে প্রকাশ্যে। প্রতি সন্ধ্যায় এই বস্তিতে বসে মাদকের হাট। শুরু হয় কোলাহল। এ রমরমা আসর চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এখানে ফেরি করে বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি করা হয়। রাজধানীর ডেমরা, সারুলিয়া, যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষ চনপাড়া বস্তিতে আসে মাদক সেবন করতে। এখানে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটেছে হত্যাকান্ডের ঘটনাও। স্থানীয় প্রশাসন এখানকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। মাদকের হাটখ্যাত চনপাড়া বস্তি থেকে থানা পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও প্রভাবশালীরা নিয়মিত বখরা পায় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যক্তি জানান, মাদকের বিষাক্ত ছোবলে রূপগঞ্জের হাজার হাজার তরুণের জীবন বিপন্ন। মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকসংক্রান্ত দ্বন্দ্বে খুনের ঘটনা তো রয়েছেই। এছাড়া সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও রাঘব-বোয়ালরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে পুলিশের সঙ্গে মতের অমিল হলেই চলে লোক দেখানো অভিযান। অভিযানের খবর পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা নিরাপদে চলে যায়। পুলিশের অভিযান ব্যর্থ হয়। মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে মাদক বহন করে থাকেন। ইয়াবা ও ফেনসিডিল বহন করা হয় লাউ, নারিকেল আর ম্যাচের বাক্সের ভেতরে করে। হেরোইন বহন করা হয় মিষ্টির প্যাকেটের ভেতরে। আর গাঁজা বহন করা হয় ছালার চটের ভেতরে করে।

মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করা হয় শিশু-কিশোরদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু, কিশোর ও মহিলাদের দিয়ে মাদক বহন করা হয়। মহিলাদের স্পর্শকাতর জায়গায় রেখে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজা বহন করা হয়।

রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তরিকুল ইসলামন বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান নিয়মিত চলে। রূপগঞ্জে অনেক দুর্গম ও চনপাড়া বস্তি এলাকাটা ঘিঞ্জি। টের পেয়ে পুলিশ ঢোকার আগেই মাদক কারবারিরা নিরাপদে পালিয়ে যায়।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মাদক ব্যবসা ও সেবন নির্মুলে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সভা-সমাবেশ করা হচ্ছে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করছে। শিগগিরই মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সফলতা আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।