ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
আধুনিকতার ছোঁয়ায় সিরাজগঞ্জে নবান্নের উৎসব হারিয়ে যেতে বসেছে। আগের মত কৃষকের উঠোন জুড়ে নেই ধান মাড়াইয়ের ব্যস্ততা, আর ঢেঁকির তালে মুখর হয় না গাঁয়ের বধূদের নবান্নের গীত। অথচ এমন একদিন ছিল যে দিনকে নবান্নকে ঘিরে সার্বজনীন উৎসবে মেতে উঠত, আজ সেখানে কেবলই একরাশ শূন্যতা আর স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস। কালের চাকায় পিষ্ট হয়ে বাঙালির হাজার বছরের এই প্রাণের উৎসব তার চিরায়ত রূপ ও রং হারিয়ে এখন বিবর্ণ, জৌলুসহীন।স্মৃতির পাতা ওল্টালে চোখে ভাসে। অন্য রকম সিরাজগঞ্জ। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকেও সিরাজগঞ্জে আমন ধানের সোনালি ঢেউ খেলত। সাদা দিঘা, সরসরিয়া, লাউজাল, মাটিয়াগড়লের মতো বিলুপ্তপ্রায় সব দেশি জাতের ধান কাটার মধ্য দিয়েই শুরু হতো মহোৎসবের প্রস্তুতি। কৃষকেরা সারা রাত জেগে চাদর গায়ে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করতেন বাড়ির উঠানে । সেই নতুন ধানের প্রথম অংশটুকু বাড়ির গিন্নি তুলে নিতেন পিঠা-পায়েসের জন্য।
নবান্ন তখন শুধু একটি দিন ছিল না, ছিল পৌষ মাস পর্যন্ত বিস্তৃত এক আনন্দযজ্ঞ। ঘরে ঘরে নতুন খেজুরের রসের সঙ্গে গাভি বা মহিষের ঘন দুধ মিশিয়ে তৈরি হতো দুধের পিঠা, ভাপা, পাকান, কুশলি, পাটিসাপটার মতো রসনা বিলাসী সব আয়োজন। রান্না হতো নতুন চাল-ডালের খিচুড়ি আর পাটালি গুড়ের পায়েস। ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কলাপাতা বিছিয়ে একসঙ্গে বসে সেই খাবার খেতেন। উৎসবের রঙ ছড়াত গ্রামের বাড়িগুলি দিনের আলোয় লাঠি খেলা, পুঁথিপাঠ, সাঁতার আর হাঁড়ি ভাঙার মতো গ্রামীণ খেলাধুলায় মুখর থাকত । আর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দূর থেকে ভেসে আসত কবিগান, জারিগান আর যাত্রাপালার সুর। নবান্ন ছিল একাধারে ফসল, সংস্কৃতি আর সামাজিক ঐক্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। আজকের সেই প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানগুলি কেবলই ইতিহাস। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের দাপটে হারিয়ে গেছে সেই সুগন্ধি দেশি ধান। ট্রাক্টর ও হারভেস্টারের যান্ত্রিক শব্দে চাপা পড়েছে ধান মাড়াইয়ের লোকগান। কৃষিকাজ এখন আর উৎসব নয়, নিছকই এক বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া। বহু কৃষক এখন আর মাটির সঙ্গে বাঁধা নেই।
জমি লিজ দিয়ে তারা এখন শহুরে জীবনের দিকে ঝুঁকছেন। অন্যদিকে, একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় কমে গেছে সম্মিলিত আয়োজনের উৎসাহ। গ্রামের সেই আন্তরিকতার জায়গায় এখন দানা বেঁধেছে দলাদলি, মামলা-মোকদ্দমা আর বিচ্ছিন্নতা। আকাশ সংস্কৃতি আর হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোন কেড়ে নিয়েছে লোকজ সংস্কৃতির আবেদন। নতুন প্রজন্মের কাছে লাঠি খেলা বা জারিগানের চেয়ে ডিজিটাল বিনোদন অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ফলে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রবাহ প্রায় থেমে গেছে। এখনো কিছু পরিবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করে নবান্নের স্মৃতিটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু খন্ড খন্ড এই প্রচেষ্টাগুলো সার্বজনীন উৎসবের সেই হারিয়ে যাওয়াকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ।প্রবীণদের মুখে আজও ভাসে সেই সোনালি দিনের গল্প, যখন নবান্ন ছিল একতার প্রতীক, আনন্দের উপলক্ষ আর হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। কালের পরিক্রমায় চলনবিলের নবান্ন আজ তার জৌলুস হারিয়ে এক ধূসর ক্যানভাসে পরিণত হয়েছে । যা কেবল পুরানো স্মৃতি হয়েই থাকবে আগামী প্রজন্মের কাছে । এ বিষয়ে তেতুলিয়া গ্রামের আবু হানিফ (৭৫) জানান, আগের দিনে নবান্নে খুব আনন্দ ফুর্তি হতো। প্রতিটি কৃষক পরিবার আনন্দ ফুর্তিতে ভরে থাকত। অগ্রাগায়ন মাসে ধান কাটা গরু দিয়ে ধান মলন (মাড়াই) করত । ধান সারা হলে প্রতিটি পরিবারে পরে যেত পিঠা খাওয়ার ধুম । এ সময় জামাই ঝিসহ আত্মীয়স্বজন কে দাওয়াত দিয়ে নানা ধরনের পিঠা খাওযার ধুম পরে যেত । এ সময় পরিবার গুলিতে আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত । বর্তমানে আধুনিক যান্ত্রিক যুগে আর সেরকম আনন্দ নেই । এখন পিঠা খেতে হলে গ্রামের মানুষ গুলিও শহরের মানুষের মত চিতই পিঠা কিনে এনে দুধের পিঠা খায় ।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫
আধুনিকতার ছোঁয়ায় সিরাজগঞ্জে নবান্নের উৎসব হারিয়ে যেতে বসেছে। আগের মত কৃষকের উঠোন জুড়ে নেই ধান মাড়াইয়ের ব্যস্ততা, আর ঢেঁকির তালে মুখর হয় না গাঁয়ের বধূদের নবান্নের গীত। অথচ এমন একদিন ছিল যে দিনকে নবান্নকে ঘিরে সার্বজনীন উৎসবে মেতে উঠত, আজ সেখানে কেবলই একরাশ শূন্যতা আর স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস। কালের চাকায় পিষ্ট হয়ে বাঙালির হাজার বছরের এই প্রাণের উৎসব তার চিরায়ত রূপ ও রং হারিয়ে এখন বিবর্ণ, জৌলুসহীন।স্মৃতির পাতা ওল্টালে চোখে ভাসে। অন্য রকম সিরাজগঞ্জ। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকেও সিরাজগঞ্জে আমন ধানের সোনালি ঢেউ খেলত। সাদা দিঘা, সরসরিয়া, লাউজাল, মাটিয়াগড়লের মতো বিলুপ্তপ্রায় সব দেশি জাতের ধান কাটার মধ্য দিয়েই শুরু হতো মহোৎসবের প্রস্তুতি। কৃষকেরা সারা রাত জেগে চাদর গায়ে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করতেন বাড়ির উঠানে । সেই নতুন ধানের প্রথম অংশটুকু বাড়ির গিন্নি তুলে নিতেন পিঠা-পায়েসের জন্য।
নবান্ন তখন শুধু একটি দিন ছিল না, ছিল পৌষ মাস পর্যন্ত বিস্তৃত এক আনন্দযজ্ঞ। ঘরে ঘরে নতুন খেজুরের রসের সঙ্গে গাভি বা মহিষের ঘন দুধ মিশিয়ে তৈরি হতো দুধের পিঠা, ভাপা, পাকান, কুশলি, পাটিসাপটার মতো রসনা বিলাসী সব আয়োজন। রান্না হতো নতুন চাল-ডালের খিচুড়ি আর পাটালি গুড়ের পায়েস। ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কলাপাতা বিছিয়ে একসঙ্গে বসে সেই খাবার খেতেন। উৎসবের রঙ ছড়াত গ্রামের বাড়িগুলি দিনের আলোয় লাঠি খেলা, পুঁথিপাঠ, সাঁতার আর হাঁড়ি ভাঙার মতো গ্রামীণ খেলাধুলায় মুখর থাকত । আর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দূর থেকে ভেসে আসত কবিগান, জারিগান আর যাত্রাপালার সুর। নবান্ন ছিল একাধারে ফসল, সংস্কৃতি আর সামাজিক ঐক্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। আজকের সেই প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানগুলি কেবলই ইতিহাস। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের দাপটে হারিয়ে গেছে সেই সুগন্ধি দেশি ধান। ট্রাক্টর ও হারভেস্টারের যান্ত্রিক শব্দে চাপা পড়েছে ধান মাড়াইয়ের লোকগান। কৃষিকাজ এখন আর উৎসব নয়, নিছকই এক বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া। বহু কৃষক এখন আর মাটির সঙ্গে বাঁধা নেই।
জমি লিজ দিয়ে তারা এখন শহুরে জীবনের দিকে ঝুঁকছেন। অন্যদিকে, একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় কমে গেছে সম্মিলিত আয়োজনের উৎসাহ। গ্রামের সেই আন্তরিকতার জায়গায় এখন দানা বেঁধেছে দলাদলি, মামলা-মোকদ্দমা আর বিচ্ছিন্নতা। আকাশ সংস্কৃতি আর হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোন কেড়ে নিয়েছে লোকজ সংস্কৃতির আবেদন। নতুন প্রজন্মের কাছে লাঠি খেলা বা জারিগানের চেয়ে ডিজিটাল বিনোদন অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ফলে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রবাহ প্রায় থেমে গেছে। এখনো কিছু পরিবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করে নবান্নের স্মৃতিটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু খন্ড খন্ড এই প্রচেষ্টাগুলো সার্বজনীন উৎসবের সেই হারিয়ে যাওয়াকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ।প্রবীণদের মুখে আজও ভাসে সেই সোনালি দিনের গল্প, যখন নবান্ন ছিল একতার প্রতীক, আনন্দের উপলক্ষ আর হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। কালের পরিক্রমায় চলনবিলের নবান্ন আজ তার জৌলুস হারিয়ে এক ধূসর ক্যানভাসে পরিণত হয়েছে । যা কেবল পুরানো স্মৃতি হয়েই থাকবে আগামী প্রজন্মের কাছে । এ বিষয়ে তেতুলিয়া গ্রামের আবু হানিফ (৭৫) জানান, আগের দিনে নবান্নে খুব আনন্দ ফুর্তি হতো। প্রতিটি কৃষক পরিবার আনন্দ ফুর্তিতে ভরে থাকত। অগ্রাগায়ন মাসে ধান কাটা গরু দিয়ে ধান মলন (মাড়াই) করত । ধান সারা হলে প্রতিটি পরিবারে পরে যেত পিঠা খাওয়ার ধুম । এ সময় জামাই ঝিসহ আত্মীয়স্বজন কে দাওয়াত দিয়ে নানা ধরনের পিঠা খাওযার ধুম পরে যেত । এ সময় পরিবার গুলিতে আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত । বর্তমানে আধুনিক যান্ত্রিক যুগে আর সেরকম আনন্দ নেই । এখন পিঠা খেতে হলে গ্রামের মানুষ গুলিও শহরের মানুষের মত চিতই পিঠা কিনে এনে দুধের পিঠা খায় ।