রংপুরের পীরগাছায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক দম্পতি দীর্ঘদিন ধরে কোচিং ব্যবসা চালিয়ে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিভাবকদের দাবি, সেই দম্পতি কোচিং শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট, প্রশংসাপত্র ও নম্বরপত্র আটকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছেন। গত ১ ডিসেম্বর নম্বরপত্র আটকে ২২ হাজার টাকা দাবির ঘটনায় রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ করা হয়।
সরেজমিনে ভুক্তভোগী, স্থানীয় অভিভাবক ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমন একাধিক অভিযোগ পাওয়া যায়।
অভিযোগে জানা যায়, পীরগাছার দামুর চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খন্দকার ফখরুল ইসলাম এবং একই বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান এমদাদুল হক মিলন এক শিক্ষার্থীর প্রশংসাপত্র ও নম্বরপত্র আটকে ২২ হাজার টাকা দাবি করেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, লাইব্রেরিয়ান এমদাদুল হক মিলন এবং তার স্ত্রী বড়দরগাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কৃষি) রুবি বেগম তাদের বাড়িতে কয়েক বছর ধরে বড়দরগাহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল নামে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করছেন। এলাকার কয়েকজন অভিভাবক দাবি করেছেন, শিক্ষার্থীদের নিয়মিত স্কুলের ভিতরেই প্রাইভেট কোচিংয়ে নিতে প্ররোচিত করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২০ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ নামে একটি নির্দেশনা জারি করে। এই নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনো শিক্ষক তার নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং করাতে পারবেন না। অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়ানোর ক্ষেত্রেও শর্ত আছে: প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি নিতে হবে এবং একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট ওই নীতিমালার বৈধতা বহাল রাখেন। আদালত বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর এবং নীতিমালা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়, স্কুল বা কলেজের কর্মরত শিক্ষক হলে তিনি কোনোভাবেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টিউশন বা কোচিং চালাতে পারবেন না। আদালত মত দেন, জনস্বার্থে জারি করা ২০১২-র নীতিমালাই শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কোচিং বা টিউশন বন্ধের আইনি ভিত্তি। এ বিষয়ে অভিযোগকারী ভ্যান চালক মোহারম আলী বলেন, ‘আমি ভ্যান চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালাই। আমার ছেলেকে বড়দরগাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করার দিন রুবি ম্যাডাম আমাকে স্কুল সংলগ্ন কফি হাউজে নিয়ে বলেন, এই স্কুলে পড়াশোনা হয় না। আমার কোচিংয়ে দিলে তোমার ছেলে মানুষ হবে। প্রথমে বলেছিল মাসে পাঁচশো টাকা কম নিবে। পরে দাবিকৃত অতিরিক্ত টাকাসহ রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিলাপ, উন্নয়ন ফি, হল ফি সবই দিতে হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তার ছেলে এসএসসিতে জিপিএ -৫(এ প্লাস) পাওয়ার পর রংপুর সরকারি কলেজে ভর্তির জন্য স্কুলে প্রশংসাপত্র নিতে গেলে প্রথমে ২২ হাজার টাকা দাবি করা হয়। অনেক অনুরোধের পরে ১০ হাজার দিয়ে প্রশংসাপত্র পেয়েছি, কিন্তনম্বরপত্রের জন্য আবার বাকি টাকা চেয়েছে। টাকা না দিলে নম্বরপত্র দিবে না বলে হুমকি দিয়েছে। অভিভাবক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষক দম্পতির কোচিং সেন্টারে আমার মেয়েকে পড়েছিল। পরে তারা সার্টিফিকেট আটকে টাকা নেয়ার চেষ্টা করেছে। এটা বহুদিন ধরে চলছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সব জানে কিন্তু চুপ থাকে। অভিভাবক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রেজিস্ট্রেশনের টাকা দিয়েছিলাম, পরে কোচিং মালিক মিলন সেই টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করে। আমার ছেলের রেজিস্ট্রেশনই করা হয়নি।
সরকারি কারমাইকেল কলেজ রংপুর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক, এম এ রউফ খান বলেন, ‘মানুষ হওয়ার মূল জায়গাটা শিক্ষা। আর সেটাই যখন বাণিজ্যে পরিণত হয় তখন পুরো সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর, কিস্তু এখন অনেক জায়গায় প্রাইভেট কোচিং মহামারীর মতো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষা নীতিমালা লঙ্ঘন করলে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত করার কথা থাকলেও সেটা কার্যত কাগজেই রয়ে গেছে। প্রাইভেট কোচিংয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে শিক্ষা আইন আনার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত এর দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।’ ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা মনে করছেন, স্কুল পরিচালনা কমিটি, উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের কোচিং নির্ভরতা কমবে।
স্থানীয় শিক্ষানুরাগী সুমন চৌধুরী বলেন, শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য, সার্টিফিকেট আটকে রাখা, ভর্তি ও পরীক্ষার ফি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। আইন ও নীতিমালা আছে, প্রয়োগ খুব দুর্বল। ফলে শিক্ষা, যা হওয়ার কথা মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ অধিকার, সেটাই অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক ফাঁদে আটকা পড়ছে। অভিযোগ বিষয়ে দামুর চাকলা উচ্ বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান এমদাদুল হক মিলন বলেন, তিনি এবং তার স্ত্রী বড়দরগাহ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রুবি নিজ বাসায় ‘বড়দরগাহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল’ নামে কোচিং পরিচালনা করেন। সেখানে পড়ানো শিক্ষার্থীদের পাওনা টাকা আদায়ের জন্য তিনি প্রশংসাপত্র আটকে রেখেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খন্দকার ফখরুল ইসলাম বলেন, ওই শিক্ষার্থী কোচিংয়ের ছাত্র হওয়ায় তার নম্বরপত্র শিক্ষক মিলন নিয়েছে। বিষয়টি অন্যায় হয়েছে।
পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাশীষ বসাক বলেন, এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক কোচিং পরিচালনা করতে পারেন না। এ বিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল আহসান বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ক্যাম্পাস: ঢাবিতে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস উদযাপিত
সারাদেশ: রৌমারীতে ধান-চাল সংগ্রহ শুরু