image
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

শ্রীমঙ্গল চায়ের রাজধানী ও সবুজের স্বপ্ননগরী

বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রতিনিধি, শ্রীমঙ্গল

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে, কুয়াশার চাদর মাখা ভোরের আলোয় আর রেইনফরেস্টের সিক্ত সবুজে সাজানো যে শহরটির নাম বারবার উচ্চারিত হয় তা হলো শ্রীমঙ্গল। চা-বাগান, জীববৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন ও গবেষণার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই ভ্রমণনগরী যেন প্রকৃতির কোলে এক স্বপ্নের ঠিকানা। মৌলভীবাজার জেলার ৪২৫.১৫ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এই উপজেলায় ১৮৪.২৯ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সবুজের সমুদ্রচা-বাগান। ব্রিটিশ প্ল্যান্টারদের হাত ধরে ১৮৫৪ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে শুরু হয় শ্রীমঙ্গলের চা-বাণিজ্যের অধ্যায়। সেই সময়ের পুরোনো চা-বাগান, ডিনস্টন সিমেট্রি, শ্রমিক বসতি ও বহু কথ্য উপাখ্যান আজও এ অঞ্চলের ইতিহাসকে জীবন্ত রাখে। বর্তমানে সিলেট বিভাগের ছয়টি টি-ভ্যালির অংশ হিসেবে শ্রীমঙ্গলে আছে ৩৮টি চা-বাগান, আর সংলগ্ন অঞ্চলের বাগান মিলিয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০-এরও বেশি। তাই এর ‘চায়ের রাজধানী’ পরিচয় নিছক উপাধি নয় একটি প্রাপ্ত স্বীকৃতি।

বিটিআরআই: ১৯৫২ সালে পাকিস্তান চা বোর্ডের প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্র স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে রূপ নেয় বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)-এ। বর্তমানে আটটি বিশেষায়িত গবেষণা বিভাগ চায়ের মাটি, সার, রোগবালাই, উৎপাদন, গুণমান, পরিসংখ্যান ও অর্থনীতি নিয়ে আধুনিক গবেষণা পরিচালনা করছে।

বিআরআই-এর বিজ্ঞানীরা বিটি ১ থেকে বিটি ২৮ পর্যন্ত উন্নত জাতের ক্লোন উদ্ভাবন করেছেন। সাম্প্রতিক উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে সিলভার চা এবং “সাতকড়া চায়ের সঙ্গে দেশি ফল ও প্রথাগত ফ্লেভারের সমন্বয় এখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

লাউয়াছড়া: লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক, প্রায় ১,২০০ হেক্টর বিস্তৃত এক রেইনফরেস্ট, যেখানে ২,৫০০-এরও বেশি পাখি, স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ প্রজাতির আবাস। বনে দেখা যায় বনবিড়াল, সিভিট, বানর, হরিণসহ নানা বন্যপ্রাণী। পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রখানা খাসিয়া পুঞ্জি, আনারস ও লেবুর বাগানসহ এখানকার মানব প্রকৃতি সহাবস্থান।

শ্যামলী ও তার ডিপ ফিজাপ এলাকা পিকনিক, বিশ্রাম ও আলোকচিত্রের আদর্শ স্থান। শরৎকালে কাশফুল, সাদা মেঘ এবং সবুজ ঢেউ মিলিয়ে প্রকৃতি এখানে তুলির টানে রঙ ছড়িয়ে দেয়।

বিটিআরআই সংলগ্ন এলাকা—চা-গাছ, ফুলবাগান ও গবেষণার আবহ, লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্করেইনফরেস্টের জীবন্ত জাদুঘর, রাবার বাগান ৮,০৮৩ একর বিস্তীর্ণ প্রকল্প বাস্তব শ্রমজীবনের অনন্য চিত্র, ভাড়াউড়া লেক শাপলা, অতিথি পাখি ও নীরবতার সঙ্গী, রাজঘাট লেক—চা-বাগানের পাশে শান্ত লেক, সঙ্গে সাঁতারকেন্দ্র, মাগুরছড়া গ্যাস কূপ—১৯৯৭ সালের বিস্ফোরণের স্মৃতি বহনকারী স্থান, যজ্ঞ কুন্ডের ধারা শ্রীমঙ্গলের একমাত্র প্রাকৃতিক ঝর্ণা, নির্মাই শিববাড়ী, সিতেশ দেবের চিড়িয়াখানা, আরগ্য কুঞ্জ, ডিনস্টন সিমেট্রি প্রতিটি স্থানের বুকে জড়ানো আছে পৃথক গল্প। চা-শ্রমিকদের প্রজন্ম, খাসিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব ঐতিহ্য, স্থানীয় কৃষকউদ্যোক্তা, শিক্ষক গবেষক, সাংবাদিক রাজনীতিবিদ সবাই মিলেই শ্রীমঙ্গল এক বৈচিত্র্যময় সামাজিক গড়নে দাঁড়িয়ে আছে। আঞ্চলিক খাদ্য, সাতকড়া, লোকসংস্কৃতি এবং চা-কেন্দ্রিক জীবনপ্রবাহ এখানে নিজস্ব স্বাদ তৈরি করেছে।

শ্রীমঙ্গলের ইতিহাস, সমাজ ও অগ্রযাত্রায় বহু গুণী ব্যক্তির অবদান রয়েছে। তাদের উল্লেখ এ অঞ্চলের পরিচিতিকে আরও উজ্জ্বল করে। রাজনীতি, সমাজ ও প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জীবন সাঁওতাল (আসাম প্রাদেশিক পরিষদের এমএনএ), ডা. সূর্যমনি দেব, যতীন্দ্র মোহন দত্ত, অজিত চৌধুরী, ভূনবীরের লাকু দত্ত চৌধুরী, সাবেক এমপি মো. ইলিয়াস, সাবেক এমপি মোহাম্মদ আহাদ মিয়া, সাবেক এমপি শফিকুর রহমান, শ্রীমঙ্গল পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ক্ষীরোদ দেব চৌধুরী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান দেওয়ান আব্দুর রশিদ, সাবেক পৌর কমিশনার হাফেজ মুসলিম উদ্দিন, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান এম এ মুসাব্বির, ডাঃ গিরীন্দ্র চক্রবর্তী, এস কে রায়, ডা. রমা রঞ্জন দেব, রাসেন্দ্র দত্ত (রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান), ডা. আব্দুল আলী, ডা. গোলাম জিলানী, সাংবাদিক বিপুল রঞ্জন চৌধুরী, মো. শাহজাহান মিয়া, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ইসমাইল হোসেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আছকির মিয়া, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান এম এ রহিম, পৌর চেয়ারম্যান কমলেশ ভট্টাচার্য, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান মহাসিন মিয়া মধু, অধ্যাপক নিখিল ভট্টাচার্য, চা শ্রমিক নেতা সুরেন্দ্র চন্দ্র ব্যানার্জি, চা শ্রমিক নেতা রাজেন্দ্র প্রসাদ ব্যানার্জি, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের প্রতিষ্ঠাতা শীতেশ দেব, প্রফেসর সাইয়িদ মুজিবুর রহমান, সাবেক পৌর কমিশনার বলাই ভট্টাচার্য, প্রফেসর সৈয়দ মূয়ীজুর রহমান, সুনীল রায়সহ আরও অনেক নাম অম্লান অবদান রেখে গেছেন।

সম্প্রতি