image

‘বরেন্দ্র অঞ্চলের মৃত্যুকূপ’ পানি-বাণিজ্যের অমানবিক ছায়া

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী

বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটির নিচে যে অন্ধকার দিন-দিন আরও গভীর হচ্ছে, তার নির্মম মুখ আজ উন্মুক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে কোয়েলহাটের একটি সরু গর্তের সামনে। একদিকে মানুষের পানির তীব্র চাহিদা আর অন্যদিকে বেপরোয়া লাভের লোভ এই দুইয়ের সংঘাতে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য অরক্ষিত টেস্ট বোর, যেন গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লুকানো মৃত্যুকূপ। এসব ব্যর্থ কূপ বছরের পর বছর খোলা পড়ে থাকে। কিন্তু সেই পড়ে থাকা গর্তের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় মানুষের জীবনের নির্মম হিসেব।

এ অমানবিক পানি-বাণিজ্যের ছায়ায়ই হারিয়ে গেছে ছোট্ট সাজিদ। মাত্র দুই বছরের একটি শিশু, যে জানতেও পারেনি তার বাড়ির পাশের মাটি কতটা প্রতারণাময়। গর্তটি যে কেবল একটি দুর্ঘটনা নয় অব্যবস্থাপনা, লোভ ও দায়হীনতার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেশজুড়ে। মানুষের বাড়তে থাকা আতঙ্ক জানান দিচ্ছে- বরেন্দ্র অঞ্চলের এ গর্তগুলো শুধু শিশুদেরই নয়, পুরো সমাজের নিরাপত্তা গ্রাস করছে নীরবে। এই মৃত্যুকূপগুলোর অরক্ষিত মুখ আজ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে পানি উত্তোলনের নামে যেসব গর্ত খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে, সেগুলোর দায় নেবে কে? আর কত সাজিদকে হারালে থামবে এই বেপরোয়া পানি-বাণিজ্য?

স্থানীয়রা জানান, গত বছর এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি সেচের পানি তোলার জন্য একের পর এক গভীর টেস্ট বোর খনন করেন। তিনটি কূপে পানি ওঠেনি। ব্যর্থ হওয়া এসব গর্ত খড় আর মাটি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে মাটি সরে গর্তগুলো আবার ফাঁকা হয়ে পড়ে। সেখানেই পড়ে যায় শিশু সাজিদ।

বরেন্দ্র অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে হাজার হাজার গভীর নলকূপ আছে। গবেষণা বলছে, সেচের ৭০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি উঠছে ব্যক্তিমালিকানাধীন কূপ থেকে। লাভের আশায় অনেকেই বারবার কূপ খুঁড়েছেন; ব্যর্থ হলে সেটি সিল না করে ফেলে রাখছেন।

ফলে গ্রামজুড়ে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য গর্ত। এসব অরক্ষিত গর্তের কোনো তালিকা নেই। নেই ভরাটের বাধ্যতামূলক নিয়ম। প্রশাসনও খোঁজ নেয় না ব্যর্থ কূপ সঠিকভাবে সিল করা হয়েছে কিনা। অথচ এই গর্তগুলোর মুখ ৬-১৪ ইঞ্চি, ভেতরের গভীরতা ৩০-১০০ মিটার। প্রাপ্তবয়স্কের দেহ আটকে গেলেও শিশুদের ছোট শরীর সোজা নেমে যায় অতল অন্ধকারে।

২০১৪ সালে ঢাকার শাহজাহানপুরে জিহাদের মৃত্যুর পর আদালত বলেছিল, অরক্ষিত গর্ত রেখে দেয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু সেই শিক্ষাও যেন ভুলে গেছে সবাই। আজ সাজিদের জীবন-মৃত্যুর লড়াই দেখছে পুরো গ্রাম, দেশ এমনকি বিশ্ব।

এদিকে ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার চেয়ে শিশু সাজিদের বাবা রাকিবুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি ফুটফুটে একটা সন্তান হারিয়েছি। আমার একটা কলিজা হারায় ফেলছি। গোটা পৃথিবী থাকলেও আমি আর এটা পাব না।’

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহীর তানোর উপজেলার কোয়েলহাট পূর্বপাড়া গ্রামের বাড়ির সামনেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাকিবুল ইসলাম। ছেলের মৃতুর জন্য গর্ত খনন করা ব্যক্তির অবহেলাকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘যারা হাউজিং করেছে, এটা তাদেরই কাজ। গর্তের মুখে তারা অন্য কিছু দিতো, তারা যদি একটা নিশানা দিতো, তাহলে এ রকম ঘটনা ঘটতো না। তারা কিচ্ছু দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘কীভাবে ঘটনা ঘটেছে, তা সবাই দেখেছে। আমি বিচার চাই। প্রশাসনিকভাবে যে বিচার করবে, আমি তাতেই সন্তুষ্ট। সঠিক যেটা, সেটা আমাকে দেবে।’

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, সাজিদের মা রুনা খাতুনকে নিয়ে বসে আছেন তার মা শেফালী বেগম। শেফালী বেগম সাজিদের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে বললেন, ‘সবাই আমাদের ছোট বাচ্চাটার জন্য দোয়া করেন, যাতে তাকে আমরা ফেরত পাই।’

সাজিদের মা রুনা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘৩ জায়গা খুঁড়েছিল। ২ বছর ধরে বন্ধ না করে গর্তগুলো এভাবে ফেলে রেখেছিল। কেন ফেলে রেখেছিল? আমি কছিরের শাস্তি চাই, তার বিচার চাই।’ রুনা জানান, ঘটনার পর কছির একবার দেখতে এসেছিলেন। তারপর আর আসেননি। তিনি পালিয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে তানোর থানার ওসি মো. শাহীনুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কছিরের দেখা হয়নি। আমরা তাকে পাইনি।’ তাকে আটক করা হবে কিনা, জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘তদন্ত চলছে। আমরা এটা দেখছি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই জরুরি তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে। সব কূপের মানচিত্র তৈরি, ব্যর্থ কূপ ভরাটের ‘ওয়েল ক্লোজার সার্টিফিকেট’ বাধ্যতামূলক করা এবং অবহেলার জন্য মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি