image

দাউদপুর মাদ্রাসায় শিক্ষক আছেন চারজন, নেই কোনো শিক্ষার্থী

বছরের পর বছর চলছে ‘শিক্ষা নাটক’

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
জেলা বার্তা পরিবেশক, নওগাঁ

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার দাউদপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ঢুকলেই চোখে পড়ে এক অদ্ভূত নীরবতা। পুরনো টিনশেডের শ্রেণী কক্ষগুলো তালাবদ্ধ, ভেতরে ধুলোমাখা বেঞ্চ-টেবিল। কোথাও ভাঙাচোরা আসবাব, একপাশে স্তূপ করে রাখা, জানালা-দুয়ারে মাকড়সার জাল। দেখে বোঝার উপায় নেই- এটি একটি চলমান এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নাকি পরিত্যক্ত ভবন। পাশেই নতুন ভবন আছে সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চলে।

মাদ্রাসা সূত্রে জানা যায়, কাগজে-কলমে প্রথম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী ১০৪ জন। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীও উপস্থিত নেই। নেই পাঠদান, নেই পরীক্ষা বা নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের কোনো চিহ্ন। অথচ অবাক করার বিষয়, এই শাখায় কর্মরত রয়েছেন চারজন শিক্ষক। হাজিরা খাতায় নিয়মিত স্বাক্ষর রয়েছে, মাস শেষে উত্তোলন করা হচ্ছে বেতন।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত থাকলেও কোনো শ্রেণীকক্ষে পাঠদান চলছিল না। অফিস কক্ষে বসে মোবাইলে সময় কাটাতে দেখা যায় তাদের। পাশেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি থাকায় দূর থেকে পুরো চিত্র বোঝা কঠিন হলেও ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী কক্ষগুলো ছিল সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীশূন্য।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে কার্যত কোনো শিক্ষার্থী নেই। শুধু কাগজে উপস্থিতি দেখিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু দেখানো হয়। এর আড়ালে নিয়মিত বেতন ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেয়া হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে বলেও দাবি তাদের। স্থানীয়দের মতে, প্রশাসনিক তদারকির অভাবেই এমন অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারছে।

এলাকাবাসী ও অভিভাবকদের ক্ষোভ চরমে। স্থানীয় আলতাব ও সোহেল হোসেনের ভাষ্য, শিক্ষার্থী ছাড়াই শিক্ষক বহাল রাখা বড় ধরনের দুর্নীতি। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্য বিষয়টি আংশিক স্বীকার করলেও দায় চাপাচ্ছেন উপবৃত্তি না পাওয়া এবং পাশের দাউদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর।

কাগজে শিক্ষার্থী হিসেবে যাদের দেখানো হয়েছে তাদের মধ্যে সাজিদ, আরিফ নামে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, তারা দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসায় পড়ে না। পাশের দাউদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। আর আজমাইন নামে প্রথম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী জানায়, সে বদলগাছী সদরের একটি মাদ্রাসায় নিয়মিত পড়াশোনা করছে।

এ বিষয়ে দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার সেকেন্দার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘কিছু শিক্ষার্থী আছে, তবে উপবৃত্তি না পাওয়ায় তারা নিয়মিত আসে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে নিউজ না করলেই ভালো হয়। আগামী বছর থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে।’

ইবতেদায়ী শাখার চার শিক্ষকও তহুরা খাতুন (ইবতেদায়ীপ্রধান), রেজাউল করিম মৌলভী), শরিফুল ইসলাম (সাধারণ শিক্ষক), সুফিউল্লাহ (ইবতেদায়ী কারী) একই সুরে জানান, উপবৃত্তি না থাকায় শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসামুখী হচ্ছে না। তাই এ বছর ছাত্র-ছাত্রী নেই। তবে আমরা নিয়মিত মাদ্রাসায় আসি। আগামী বছর শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে। আমরা যোগাযোগ করছি।’

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিউল আলম এ বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি তাদের লিখিত জবাব চেয়েছি। যেহেতু মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে রয়েছে। আমরা মাদ্রাসা বোর্ডকে এ বিষয়ে অবগত করবো।’

দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি জুয়েল সরদার শিক্ষার্থী শূন্যর বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, গত তিন মাস আগে আমি সভাপতি হয়েছি। তাদের শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে নির্দেশ দিয়েছি।’

উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান ছনি বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমি সেখানে গিয়েছি। শিক্ষার্থী নেই কেন জানতে চেয়েছি। আমরা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে এ বিষয়টি অবগত করবো।’

তবে স্থানীয়দের প্রশ্ন, শিক্ষার্থী না থাকলেও কীভাবে বছরের পর বছর চারজন শিক্ষক বহাল থাকেন কার তদারকিতে চলছে এই শিক্ষা কার্যক্রম সরকারি অর্থের দায় নেবে কে দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসার এই চিত্র, এখন শিক্ষা প্রশাসনের কার্যকর নজরদারির দাবি জানাচ্ছে।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি