image
জলবায়ুর প্রভাবে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। শূন্য হাঁড়ি হাতে উপকূলের এক নারী

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেড়েছে দুর্যোগ, জীবিকা হারাচ্ছে উপকূলের মানুষ

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, খুলনা

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও খরায় জীবিকা হারাচ্ছে মানুষ। ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে বলে একাধিক গবেষণা সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বছরের পর বছর আলোচনা হলেও সমাধান মেলেনি। এ দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ ও জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিত করার দাবিতে আজ ও আগামীকাল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ-২০২৫’ শুরু হতে যাচ্ছে।

সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষয় আমরা (ধরা)-এর সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য হলো জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য পরিবেশগত ন্যায্যতার আন্দোলন আরো শক্তিশালী করা। ১৪টি দেশের অন্তত ১৫ জন বিশিষ্ট পরিবেশবিদ, গবেষক, নীতিনির্ধারক ও সামাজিক আন্দোলনের নেতার উপস্থিতিতে সম্মেলনে সারাদেশ থেকে সহস্রাধিক প্রতিনিধি অংশ নেবেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৩০ বছরে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে, যার পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, বন্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগে ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল হারাচ্ছে মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার দেশের উপকূলীয় নারী-শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। উপকূলে ‘জীবনের লড়াই’ ক্রমেই কঠিন হচ্ছে। পাশাপাশি অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

দুর্যোগকবলিত মানুষ লবণাক্ততার আগ্রাসন, নদ-নদী ও জলাশয় দখল ও দূষণসহ নানা কারণে পেশা হারাচ্ছে। অনেকে নিরুপায় হয়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলা, রাজধানী অথবা দেশের বড় শহরগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রায় ৬০ শতাংশ ঢাকা, ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম নগর ও ২০ শতাংশ আন্ত জেলায় অভিবাসী হয়েছে।

‘ক্লাইমেট ভালনারবিলিটি অ্যান্ড রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট ইন লো লাইং কোস্টাল সিটিজ অব বাংলাদেশ ইউজিং অ্যানালিটিক হায়ারার্কিক প্রসেস’ নামের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় ২২টি শহরের ঝুঁকির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অব ওয়াটার অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ নামের সাময়িকীতে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল গবেষকের এ গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ঝুঁকির প্রকৃত প্রভাব মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে কতটা হুমকির মুখে ফেলে, তা সংখ্যা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।

ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ২০৫০ সালের মধ্যে নতুন করে এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের দুই কোটি ৬০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে উন্নয়ন সংস্থা ‘কারিতাস বাংলাদেশ’। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড়, অস্বাভাবিক জোয়ারের প্লাবন, লবণাক্ততা ও নদীভাঙনের মতো দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। তারা নিজ এলাকা ছেড়ে শহরের বস্তিতে নিম্নমুখী জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে।

জলবায়ু সচেতনতা এবং সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এর প্রভাবে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার জীবন-জীবিকা ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। উপকূলে ‘জীবনের লড়াই’ ক্রমেই কঠিন হচ্ছে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। শীত-গরমের তীব্রতা বাড়ছে। অসময়ে বন্যা-খরা হচ্ছে। পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে খাবার পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। নদীভাঙন ও লবণাক্ততা বাড়ছে, যা প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা সংগঠক শুভ্র শচীন আরও বলেন, কৃষিনির্ভর এলাকার মানুষ কাজ হারিয়ে শহরে যাচ্ছেন কাজের খোঁজে। কেউ যাচ্ছেন একা আবার কেউ সপরিবারে। শুধু গরিব নন, ধনীরাও এর শিকার হচ্ছেন। ফলে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এই সংকট মোকাবিলায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো মানবসৃষ্ট কারণ। চলতি বছরের জুন থেকে আগস্টে মানবসৃষ্ট কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে এবং এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ক্লাইমেট সেন্ট্রালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ তীব্র তাপপ্রবাহে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা ৩০ দিনেরও বেশি সময় ধরে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন তীব্র তাপমাত্রা সহ্য করেছে। এমন পরিস্থিতি আগামীর জন্য গভীর সতর্কবার্তাই দিচ্ছে। এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে হলে বড় শহরগুলোর পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশকে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। কেননা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন করা যায়নি। এমনকি অভিযোজনও কঠিন হয়ে উঠেছে।

মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাধার ভরাট, বন ধ্বংস, অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ইত্যাদি কর্মকা- দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ নষ্ট করেছে। দেশে বনভূমি ও জলাভূমির পরিমাণ ক্রমেই কমেছে। একটি আদর্শ শহরে প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমির কথা বলা হলেও এ দেশের কোনো শহরেই তা নেই। বিশ্বব্যাপী আশির দশক থেকেই শিল্পায়ন ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণকে কেন্দ্র করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। নব্বইয়ের দশকে বিষয়টি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি