বেলতলী বধ্যভূমি দিনে গো-চারণ রাতে মাদকসেবীদের আড্ডা

অযত্নে অবহেলায় অরক্ষিত কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন বেলতলী বধ্যভূমিটি। দিনে গো-চারন ভূমি আর রাতে মাদকসেবী ও অপরাধীদের নিরাপদ আড্ডাস্থলেই যেন পরিনত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত এ জায়গাটি।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, লাকসাম রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা জুড়ে এ বধ্যভূমির সীমানা। এখনো মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসবে মানুষের হাঁড় কংকাল। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক সেনারা বিভিন্ন বয়সের প্রায় ১০ হাজার বাঙ্গালী নারী পুরুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন এবং হত্যা করে মাটি চাপা দেয় এখানে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এ বধ্যভূমি রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। করা হয়নি সংরক্ষণ। লাগানো হয়নি স্মৃতি রক্ষার্থে একটি সাইনবোর্ডও। লাকসাম রেলওয়ে জংশনের লাগোয়া দক্ষিণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তৈরী ব্যাংকারের পাশে প্রায় দুই হাজার ফুট এলাকা জুড়ে এ বধ্যভূমি। তবে রেলওয়ের কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশন থেকে চট্টগ্রামের চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ডাবল রেললাইন নির্মানকালে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিকদের দাবির প্রেক্ষিতে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দিয়েছিল।

এ বধ্য ভূমির ইতিহাস জানা এবং পাকসেনাদের নির্যাতনের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষীদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গবেষনা সুত্রে জানা যায়, পাক বাহিনী দেশের অন্যান্য এলাকার মত ১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল লাকসাম এলাকা দখল করে। এরপর পাক বাহিনী লাকসাম রেল জংশনের পশ্চিম দক্ষিণ পাশে অবস্থিত থ্রী এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পে পাক বাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পর যুদ্ধকালীন মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে লাকসাম রেলওয়ে জংশন কে। এ ক্যান্টনমেন্টের অধীনে ছিল লাকসামসহ কুমিল্লার দক্ষিণ এলাকা, চাঁদপুর, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চল। এসব অঞ্চল থেকে পাক বাহিনী শ’ শ’ যুবক-যুবতীসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ট্রাকে করে তুলে নিয়ে আসত। এদের মধ্যে যুবতীদের উপর যৌন নিপীড়ন শেষে হত্যা করা হতো। এখানে সব বয়সের লোকদের হত্যার পর ধরে আনা লোকদের মাটি চাপা দেয়া হতো। বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর এবং বরিশাল অঞ্চলের ট্রেনে আসা যাত্রীদের পাক সেনারা ধরে নিয়ে যেত ঐ থ্রী এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে। সেখানে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যার পর বেলতলী বধ্য ভূমি তে মাটি চাপা দেয়া হতো।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লাকসাম রেলজংশনের ঝাড়ুদার শ্রীধাম চন্দ্র দাস জানান, ৭১ এর ১৫ এপ্রিল পাক সেনারা লাকসাম আক্রমন করে। পরদিন লাকসাম জংশন প্লাটফরমে কয়েকজন বাঙ্গালীর লাশ বিক্ষিপ্ত পড়েছিল। তৎকালীন রেলওয়ে স্যানেটারি ইন্সপেক্টর আমাকে ডেকে লাশগুলো সরানোর আদেশ দেন। আমি নিজেই লাশগুলো রেলওয়ে জংশনের দক্ষিনে নিয়ে মাটি চাপা দেই।

তিনি জানান, সারাদিন বেলতলীতে গর্ত খুঁড়ে রাখতাম। পরদিন সকালে সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে লাশগুলো এনে এখানে মাটি চাপা দিতাম। ঐ সময় আমি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের লাশ মাটি চাপা দেবার সময় স্থানটিকে চিহ্নিত করে রাখি। পরে দেশ স্বাধীন হবার পর সে স্থান থেকে তার লাশ তুলে তাদের স্বজনদেরকে বুঝিয়ে দেই।পাক বাহিনীর হাত থেকে নিজের জীবন এবং মা বাবার জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি বাধ্য হয়ে তখন লাশ মাটি চাপা দেয়ার কাজটি করেছি। কত লাশ দু’হাতে মাটি চাপা দিয়েছি তার হিসাব মেলাতে পারছিনা। শ্রীধাম জানান, সে সময়ের কথা গুলো মনে হলে এখনো রাতে ঘুম আসে না।

শ্রীধাম আরও জানান, শুধু বধ্যভূমিতে লাশ মাটি চাপা দেয়া ছাড়াও ট্রেনের শত শত যাত্রীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হতো তাদেরকে সন্ধ্যার পর অনেক সময় মালবাহী ট্রেনের বগি বোঝাই করে মরদেহ গুলো চাঁদপুর নিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দিত। এছাড়াও লাকসাম ষ্টেশন প্লাট ফরমের নাম-ঠিকানাবিহীন যাত্রীদের যে লাশগুলো পড়ে থাকতো এবং থ্রী এ সিগারেট ফ্যাক্টরির লাশগুলো ব্রিটিশ বাংকারের পাশে বেলতলাতে কোন মতে ১ ফুট ২ফুট গর্ত খুঁড়ে করে মাটি চাপা দিতাম। একদিন দুইদিন পরপর এভাবে ২০/২৫টি লাশ একসাথে চাপা দিতাম।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ৯৯ সালে ঢাকার একদল সাংবাদিকের অনুরোধে শ্রীধাম দাস বেলতলী বধ্যভূমি খুঁড়ে বের করেন বেশ কয়েকটি মাটি চাপা দেয়া মানুষের হাড় গোড় ও কঙ্কাল। এ সময় উদ্ধার করা বেশ ক’টি মাথার খুলি ও কিছু হাড় বতমানে যা ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

এদিকে যুদ্ধকালীন সহকারী প্লাটুন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় লাকসাম রেলওয়ে জংশনে ট্রেন আসা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পাক বাহিনী ধরে নিয়ে নির্যাতন করে এই বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দিত। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এ স্থানটি রাস্ট্রীয় ভাবে সংরক্ষণ জরুরি।

লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নার্গিস সুলতানা জানান, এ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে এটি রক্ষনাবেক্ষন ও সংস্কারের জন্য কাজ শুরু হয়েছে।