image
জয়পুরহাট স্মৃতিস্তম্ভ

জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, শাহজাদপুর শেরপুর হানাদার মুক্ত দিবস রোববার

শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ ডেস্ক

রোববার ১৪ ডিসেম্বর জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, শাহজাদপুর ও বগুড়ার শেরপুর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের পবিত্র মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানরা, বাংলার অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগ্রামী বাঙালি জাতির অনেক রক্তের বিনিময়ে জাতি পেয়েছে সুনির্দিষ্ট একটি ভূখ-, মানচিত্র খঁচিত লাল-সবুজের পতাকা এর নাম-ই স্বাধীনতা। সুদীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

জয়পুরহাট : ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভোরে পূর্বগগনে রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়ে দেখছে হানাদার মুক্ত জয়পুরহাটের বিজয়ের গৌরবগাথা এই দিনটিকে। এ দিনটি ছিল জয়পুরহাটের মুক্তিকামী-মুক্তিপাগল জনতার আনন্দ-বেদনার অশ্রুসিক্ত একটি দিন। এক দিকে যেমন স্বজন হারানোর বেদনা, তেমনি অন্যদিকে হানাদারমুক্ত হওয়ার আনন্দ।

এদিকে রোববার ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস উপলক্ষে এদিন জেলার সদর উপজেলার পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমিতে সকাল ৮টায় ও একই উপজেলার কড়ই কাদিরপুর বধ্যভূমিতে সকাল সাড়ে ৯টায় পুষ্পস্তক অর্পণের মধ্যদিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকেন জেলা প্রশাসন।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের সীমানাবর্তী পাঁচবিবি থানার ভূঁইডোবা গ্রাম হয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। লাল সবুজের ভেতরে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র খঁচিত পতাকা আর অস্ত্র হাতে যোদ্ধার দল কন্ঠে বিজয় বাংলা স্লোগান। তারা জেলার পাঁচবিবি থানা চত্বরে প্রবেশ করে, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন। সেই দিনটিতে পাঁচবিবির হাজারো মুক্তিকামী-মুক্তিপাগল মানুষ আনন্দে-উল্লাসে ফেটে পড়েন। বিজয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয় পাঁচবিবি থানা সদর এলাকা। হানাদার বাহিনী পালিয়ে বগুড়ার দিকে যাওয়ায় পাঁচবিবি থেকে মুক্তিযোদ্ধার দলটি পায়ে হেঁটে জয়পুরহাট মহকুমা সদরে বিনা বাধায় প্রবেশ করেন। শহরের জয়পুরহাট-পাঁচবিবি সড়কে ডাকবাংতে পতাকা উত্তোলন করেন যোদ্ধারা। জয়পুরহাট শহরের মুক্তিপাগল মানুষ যখন জানতে পারেন, মুক্তিযোদ্ধার দল পাঁচবিবি থেকে জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন, তখন থেকে শহরের রাস্তা আর অলি-গলিতে বিজয় বাংলা স্লোগানে- স্লোগানে শহর যেন পরিণত হয় এক বিজয় আনন্দ মিছিলের শহরে। বিকালে ডাকবাংতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বাঘা বাবলু।

সিরাজগঞ্জ : এদিকে ৯ ডিসেম্বর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সমবেত করে সিরাজগঞ্জ মুক্ত করার জন্য মুক্তি বাহীনি শপথ গ্রহণ করেন। মুক্তি বাহীনির নিজস্ব রণকৌশলে চারিদিক থেকে একযোগে আক্রমণ শুরু করে সিরাজগঞ্জ মুক্ত করার জন্যে। সকল মুক্তি যোদ্ধাদের সমবেত করার জন্যে সিরাজগঞ্জের মুক্তি যুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন ভুলু ও আমিনুল ইসলাম চৌধুরী (মুজিব বাহিনীর গেরিলা) উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের এই দিনে সিরাজগঞ্জে মুজিব বাহিনীর গেরিলা দলসহ সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধারা ১০ ডিসেম্বর শহর থেকে ৩ মাইল দুরে শৈলাবাড়ি ক্যাম্পসহ শহরের বিভিন্ন পাকিস্থানী হানাদার বাহীনির ক্যাম্পে অতর্কিকে একযোগে আক্রমণ করে। ৩ দিনের এই যুদ্ধে পাকিস্থানী হানাদার বাহীনির বিপুল ক্ষয় ক্ষতি নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রসস্ত্রের বিরুদ্ধে মুক্তি যোদ্ধারা থ্রি নট থ্রি রাইফেল এস এল আর ও মাত্র ৪টি এল এম জি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়। এই যুদ্ধে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৪ জন ক্যাপ্টেন সহ ১৮ জন সৈন্য নিহত হয়। এই যুদ্ধে বিপুল পরিমান অস্ত্রসস্ত্রসহ সামরিক রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্ত গত হয়।

৩ দিনের এই যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সাথে মরণ পন যুদ্ধ করে নিহত হন ইঞ্জিনিয়র আহসান হাবিব, সুলতান মাহমুদ, মকবুল হোসেন কালু। মুক্তিযোদ্ধাদের এই আক্রমনে টিকতে না পেরে ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী রেল যোগে ঈশ্বর্দীর অভিমুখে পালিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে হাজার হাজার জনতা ও বিজয়ী মুক্তিবাহীনি জয় বাংলা স্লোগানে মুখরীত করে সিরাজগঞ্জ শহর দখল করে নেয় এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংরাদেশের পতাকা উত্তোরণ করা হয় ।

শাহজাদপুর : মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শাহজাদপুরবাসীর কাছে এক অবিস্মরণীয় দিন। ৭১ এর এই দিনে স্থলপথে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ এবং আকাশপথে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলার মুখে শাহজাদপুর পাক হানাদার মুক্ত হয়। পাক হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও আলবদরদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ ও পাশবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে মুক্তি পাগল মানুষ প্রকম্পিত করেছিল শাহজাদপুরের  জনপদ। ১৪ ডিসেম্বর রচিত হয় শাহজাদপুর হানাদার  মুক্ত দিবসের ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়ি ফেরিঘাট ছিল পাক বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। শক্তিশালী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বার বার চেষ্টা করেও তাদের পরাজিত করতে সফল হতে পারছিলেন না। সেই থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে সংগঠিত থাকে। একপর্যায়ে নভেম্বরের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে গোটা সিরাজগঞ্জ জেলায় পাক বাহিনী পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। ৯ ডিসেম্বর শাহজাদপুর থানার পূর্বাঞ্চলের ধিতপুর ও কৈজুরীতে পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়ে যমুনা নদীপথে আরিচা ঘাট হয়ে ঢাকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এদিকে হিলি, জয়পুরহাট ও বগুড়া পতনের পর পাকবাহিনী পিছু হটার নীতি গ্রহণ করে। ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা যাওয়ার পথে পাকবাহিনী শাহজাদপুরে এসে স্থানীয় রবীন্দ্র কাচারী বাড়ি, সরকারি কলেজ ও বাঘাবাড়ি ফেরিঘাটে তিনটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। শাহজাদপুরে আসার পথে পাকবাহিনী বগুড়া-নগরবাড়ি মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সেতু উড়িয়ে দিয়ে সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অবশেষে ১৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে স্থলপথে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ এবং আকাশপথে মিত্রবাহিনীর উপর্যুপরি বিমান হামলা শুরু হলে পাক বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তারা তিনটি ক্যাম্পে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে বাঘাবাড়ি ফেরিঘাট হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ওইদিন বিকেলে থানার পূর্বাঞ্চল থেকে মির্জা আব্দুল বাকী ও খালেদুজ্জামান খান এবং পশ্চিমাঞ্চল থেকে আব্দুর রাজ্জাক মুকুলের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা  প্রবেশ করে শাহজাদপুর থানা সদরে। মুক্তিপাগল হাজার হাজার মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বরণ করে নেন মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানিদের। শাহজাদপুর থানা ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

শেরপুর : এদিকে বগুড়ার শেরপুরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক কাজ শুরু হয়। পরে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মুক্তি বাহিনী। কমান্ডার নিযুক্ত হন ন্যাপ নেতা সিদ্দিক হোসেন। স্থানীয় ডিজে হাই স্কুল মাঠে রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। দারোগা ওয়াজেদ মিয়ার সহযোগিতায় হাবিলদার আবদুল হালিম অস্ত্র চালানোর কৌশল শেখান। ২৪ এপ্রিল শেরপুরে পাকহানাদার বাহিনী প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় গাছ ফেলে রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও সামান্য অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু হানাদারদের আধুনিক অস্ত্রের মুখে পিছু হটেন তারা। এরপর তারা ভারত ও দেশের অন্য স্থানে শ্রশিক্ষণ নিয়ে শেরপুরে ফিরতে শুরু করেন।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে সারিয়াকান্দি থেকে মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু মিয়ার নেতৃত্বে সড়ক পথে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ও ধুনট থেকে মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেন খাঁনের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল শেরপুর শহরে প্রবেশ করেন। পরে শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। তুমুল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুর শহরকে পাক হানাদার মুক্ত করেন। আক্রমণের সময় পাক হানাদার ও তাদের দোসররা পৌরশহরের পাশের ঘোলাগাড়ী কলোনি গ্রামে অবস্থান নেয়। খবর পেয়ে দেরি না করে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানেও আক্রমণ চালান। সময়ের ব্যবধানে মুক্তিযোদ্ধারা ঘোলাগাড়ীসহ পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এসময় ওই এলাকার বেশ কিছু স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি