image
রাজশাহী : হাটে নতুন ধান ভরপুর কিন্তু ক্রেতা নেই -সংবাদ

ঘামে জন্মানো ধান, সিন্ডিকেটে বন্দী কৃষকের স্বপ্ন

সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী

নরম রোদে সোনালি হয়ে ওঠা বরেন্দ্রর মাঠে কাস্তের শব্দে, মাড়াইয়ের ধুলোয়, নতুন ধানের গন্ধে মুখর হওয়ার কথা ছিল কৃষকের ঘর-আঙিনা। কিন্তু সেই সোনালি দৃশ্যের আড়ালেই জমে উঠেছে নীরব দীর্ঘশ্বাস। ধান ঘরে উঠেছে ঠিকই, উঠেনি কৃষকের স্বস্তি। বরং হালখাতার দেনা, উৎপাদন খরচের হিসাব আর বাজারের নির্মম বাস্তবতা মিলিয়ে কৃষকের স্বপ্নগুলো যেন একে একে ঝরে পড়ছে। যে ধান বুকে ভর করে বাঁচার আশা দেখায়, সেই ধানই আজ পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারের পাল্টা নেমে গেছে নিচে, অথচ কৃষকের কাঁধে চেপে বসেছে লোকসানের পাহাড়।

বরেন্দ্র অঞ্চল জুড়ে আমন কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে। নতুন ধান ঘরে উঠলেও কৃষকের মনে নেই কোন উৎসাহ। ডিসেম্বর মাস চলছে। সার-কীটনাশকসহ সব দোকানে দোকানে চলছে হাল খাতা। বর্তমানে আমন ধানের দর বাজারে একেবারে নিম্নমুখি। এতে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন ফিকে হতে বসেছে। বাজারে দাম কম হওয়াই হতাশায় ভুকছেন পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকেরা।

আমনের কাটা-মাড়ায়ের শুরুতেই সরকার আমনের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রতি মণ এক হাজার ৩৬০ টাকা দরে। সরকারী ভাবে আমন কেনাও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু সরকারের বেধে দেয়া দর বাজারে প্রভাব পড়ছেনা। বর্তমানের বাজারে প্রতিমণ ধান এক হাজার ১০০ টাকা হতে এক হাজার ২০০ টাকার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। যা গত বছর এ সময় প্রতিমণ ধানের বাজার ছিল এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। গত বছরের তুলনাই চলতি বছর প্রতি মণে দুইশত টাকা কম পাচ্ছে কৃষক।

কৃষকেরা বলছেন, ডিসেম্বর মাসে সর্ব দোকানে হালখাতা শুরু হয়। এ সময় কৃষকের ধান বিক্রি করে তা পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু ধান ব্যবসায়ীরা ধান কিনতে অনেকটা অনেহা দেখাচ্ছেন।

এদিকে একাধিক স্থানীয় ধান ব্যবসায়ী বলছেন, পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের ধান কেনে থাকেন মিল মালিকেরা। কৃষকের ধান কেনে মিলমালিদের দিয়ে থাকেন তারা। কিন্তু চলতি আমন মৌসুমে মিল মালিকেরা কচ্ছপের গতি ধান কিনচ্ছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীর (আড়ত) ঘরে অনেক ধান আটকা পড়ে থাকায় তারা কৃষকের ধান খুব বেশি কেনতে পারচ্ছেনা।

বর্তমানে বাজারে প্রতিমণ (৪০ কেজি ) ধান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, যা গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। এর এক সপ্তহ আগে ও প্রতিমণ ধান বাজারে বিক্রি হচ্ছিল এক হাজার ২৩০ থেকে এক হাজার ২৬০ টাকায়। মাত্র কয়দিনের ব্যবধানে আবারো মণ প্রতি কমেছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা।

কৃষকেরা জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে উচু-নিচু ক্ষেত প্রায় ৭০ ভাগ জমি বৃষ্টিপানির উপর নির্ভর করে আমন চাষাবাদ করে থাকে কৃষকেরা। আমনের মাঝামাঝি সময়ে পোকা আক্রমন দেখা দেয়। তাই অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে কৃষকদের দ্বিগুন খরচ হয়েছে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর গ্রামের কৃষক সাহা আলম। ১৬ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চলতি মৌসুমে আমন চাষাবাদ করেছিলেন তিনি। মাঠে ধান ভাল থাকায় বুকে অনেক স্বপ্ন বেঁধেছিলেন তিনি। জমির ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে । সে হিসাব করে দেখেন তার বিঘাপ্রতি ১৬ মণ করে ফলন হয়েছে। আর মাহজনকেই দেয়া লাগবে প্রতি বিঘায় ১০ মণ ধান। যে টুকু থাকে বাজারে ধানের দরের যে অবস্থা তাতে বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারবো না। ঘর থেকে গচ্ছা দেয়া লাগবে।

গোদাগাড়ী উপজেলার চানন্দালায় গ্রামের কৃষক তসিকুল বলেন, চলতি বছর কীটনাশক প্রয়োগে আমন উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। এমতেই ফলন কম হচ্ছে তার পরে বাজারে ধানের দান পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। সম্প্রতি সরেজমিন এক সপ্তহ যাবত রাজশাহীর অঞ্চলের মধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলার কাকন হাট তানোর উপজেলার কালিগঞ্জ হাটেও নওগাঁর বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা যায় হাটে নতুন ধান ভরপুর হয়ে উঠেছে। কৃষকেরা ধান বিক্রি করতে এসেছেন। কিন্তু ধানের ক্রেতা নেই বললেই চলে। মণ প্রতি এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ মধ্যে দাম ঘুরপাক খাচ্ছে।

অনেক স্থানীয় ধান ব্যবসায়ীর ঘরে বাইরে অনেক বস্তা ভর্তি ধান পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে কথা হয় কয়েকজন ধান ব্যবসায়ী সাথে। তারা বলেন, তারা মুলত মাঠ পর্যায়ে কৃষকের ধার কেনে মিলমালিকদের দিয়ে থাকেন। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে মিলমালিকেরা ধান কেনতে আগ্রহী নয়। তাই বাজারে ধানের দাম নিম্নমুখি অবস্থান করছে।

তবে না প্রকাশ করার শর্তে একাধিক মিলমালিক বলেন,আমনের ভরা মৌসুমে সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানী শুরু করেছে। তাই বাজারে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। আমাদের কিছুই করার নাই। সরকার দুইমাস চাল আমদানী বন্ধ করলে কৃষকেরা ভাল দাম পাবে।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, সরকারে বেধে দেয়া ধানের দর বিষয়ে তিনি বলেন ডিসেম্বর মাসে ধানের দাম কম থাকে। তাই একটু ধোয্য ধরে ধান বিক্রি করতে কৃষকদের অনুরোধ করেন তিনি।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি