image

শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর: সৌন্দর্য, সংকট ও অস্তিত্বের লড়াই

সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রতিনিধি, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)

শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর শুধু একটি জলাভূমি নয়-এটি প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবিকার এক অনন্য সহাবস্থানের নাম। নীল আকাশের প্রতিবিম্বে ভরা বিস্তৃত জলরাশি, লতা-গুল্মে আচ্ছাদিত প্রান্তর আর অসংখ্য পাখির কলরবে হাইল হাওর যেন প্রকৃতির আঁকা এক জীবন্ত চিত্রপট। স্থানীয়দের কাছে ‘লতাপাতার হাওর’ নামে পরিচিত এই জলাভূমি দীর্ঘদিন ধরে দেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষ ও প্রকৃতিপ্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত হাইল হাওর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সিলেট অববাহিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। বর্ষাকালে প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই হাওর শুষ্ক মৌসুমে সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার হেক্টরে। পাহাড়, চা–বাগান ও প্রাকৃতিক বনবেষ্টিত এই অঞ্চলটি মনু ও কুশিয়ারা নদীর সমভূমির সঙ্গে যুক্ত। বর্ষায় হাওরের পানি আশপাশের জনপদের জীবনধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, আবার শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজের জন্য জমি উন্মুক্ত হয়।

হাইল হাওরের জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখির বিচরণ দেখা যায়। শীতকালে জলপাখির সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজারে পৌঁছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, জাকানা, গ্রেব, হেরন, এগ্রেট, কিংফিশারসহ বিরল ও বিপদগ্রস্ত বেয়ার্স পোচার্ড, বৃহত্তর দাগযুক্ত ঈগল ও প্যালাসের মাছের ঈগল। এই গুরুত্ব বিবেচনায় বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল হাইল হাওরকে গুরুত্বপূর্ণ পাখি এলাকা (ওইঅ) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পাশাপাশি এখানে উভচর, সরীসৃপ, কচ্ছপ ও অসংখ্য দেশীয় মাছের প্রজাতির বসবাস ছিল একসময়।

কিন্তু এই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। সরকারি হিসাবে হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর হলেও পরিবেশবাদীদের মতে বর্তমানে প্রকৃত আয়তন ৭ হাজার হেক্টরেরও কম। হাওরের ১৩১টি বিলের মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রায় বিলীন, অনেক ছড়া ও প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ হারিয়ে গেছে। অবৈধ দখল, অপরিকল্পিত পুকুর খনন ও বাণিজ্যিক মাছ চাষের বিস্তারে ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র, সংকুচিত হচ্ছে জলাভূমি।

৮০’র দশকের পর থেকে হাইল হাওরে বাণিজ্যিক মাছ চাষের প্রসার শুরু হয়, যা ২০০০ সালের পর ব্যাপক আকার ধারণ করে। সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী মহল খাসজমি ও বিল দখল করে গড়ে তুলেছে বিশাল মৎস্য খামার। এর ফলে একসময় শতাধিক প্রজাতির দেশীয় মাছের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত হাইল হাওরে আজ প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক, মৎস্যজীবী ও হাওরনির্ভর সাধারণ মানুষ।

পরিবেশবিদদের মতে, হাইল হাওর রক্ষায় অবৈধ দখল উচ্ছেদ, জমির শ্রেণি পরিবর্তন বন্ধ এবং প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধার জরুরি। পাহাড়ি ছড়াগুলো খনন করে পানি চলাচলের পথ স্বাভাবিক করা না গেলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় অনিবার্য।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবন–জীবিকার মিলনস্থল হাইল হাওর আজ অস্তিত্ব সংকটে। এই ভূস্বর্গ রক্ষা করা শুধু একটি অঞ্চলের দায়িত্ব নয়—এটি দেশ, জাতি ও পরিবেশের স্বার্থেই সময়ের দাবি।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি