ভালুকার চানপুর গারো বাজার আশপাশের কয়েক গ্রামে আখের রস জাল করে তৈরি হচ্ছে মুখরোচক মিষ্টি সুস্বাদু পাটালি গুড়। গ্রামের মানুষের প্রিয় খাবার আখের গুড় স্থানীয় আখ মাড়াই মিনি কারখানা হতে তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে কৃষক ও কারখানা মালিকরা। শ্যালো ইঞ্জিনচালিত মাড়াই কলে আখের কাঁচা রস বের করে বড় আকৃতির স্টিলের কড়াইয়ে রস জাল করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে। জাল দেয়া শেষ হলে ঘন রস তাওয়ায় ঢেলে একজন শ্রমিক হাতল ওয়ালা কাঠের চামচায় অনবরত ডলতে থাকে। একপর্যায়ে ওই গরম রস জমাট বাঁধতে শুরু করলে একটি বড় সাইজের পাত্রে ঢেলে দেয়া হয়। পাত্রের রসগুলো আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে পাটালি গুড়ে রুপান্তরিত হয়। কোনো এক সময় ভালুকা ও পাশর্^বর্তী ফুলবাড়ীয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে উৎপাদিত আখের রসে তৈরি হতো গুঁড়া বা ধুলা লাল চিনি যা গ্রামের মানুষের প্রত্যেকের ঘরের মাটির পাতিল, চিনা মাটির বইয়াম, কাঁচের বইয়াম ইত্যাদি পাত্রে রাখা হতো। গ্রাম্য হাটে চিনি মহলে শুকনা কলাপাতা, পদ্ম পাতায় করে লাল চিনি বিক্রি হতো। লাল চিনি দিয়েই তৈরি হতো ছোট-বড় লাল বাতাসা। বাড়িতে আত্মীয়-কুটুম আসলে শালি ধানের আতপ চাল ও লাল চিনি দিয়ে ক্ষীর-পায়েশ রেধে নাস্তা দেয়া হতো। তাছাড়া বিয়ে ও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে ক্ষীর পিঠা, চিনি চালের গুঁড়ার মিশ্রণে সবার প্রিয় তরল মিডুরি যা খাবার শেষে পরিবেশন করা হতো। কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় যান্ত্রিক চিনিকলে উৎপাদিত সাদা চিনির সার্বজনীন ব্যবহার নিজস্ব প্রযুক্তির নির্ভেজাল লাল চিনি এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তবে ভালুকায় আখের আবাদ বেড়ে যাওয়ায় আশপাশে চিনি কল না থাকায়, উৎপাদিত আখ স্থানীয়ভাবে নিজস্ব প্রযুক্তিতে পাটালি গুড় তৈরি করে চাষিরা ও গুড় ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন। ফুলবাড়ীয়া উপজেলার পলাশতলী ও রঘুনাথপুর এলাকায় এখনও অল্প পরিসরে লাল চিনি উৎপাদন হয় যা স্থানীয় বাজারগুলোতে কদাচিৎ পাওয়া গেলেও চড়া দামে কিনতে হয়। বর্তমানে ভালুকায় উৎপাদিত আখের গুড় দিয়ে ক্ষীর পিঠাসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবার তৈরি হয়। যে কারণে অন্যান্য এলাকার উৎপাদিত গুড়ের চেয়ে ভালুকার আখের গুড়ের গুণগত মান ভালো হওয়ায় চাহিদা রয়েছে সর্বত্র, দামও বেশি। উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে আখের ব্যাপক আবাদ হওয়ায় এসব আখ মাড়াইয়ে ২০/২৫টির মতো গুড় উৎপাদন কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানায় মৌসুমে ৭০/৮০ লাখ টাকা করে গুড় উৎপাদন করা হয়। এসব গুড় স্থানীয বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকার ও ফরিয়াদের মাধ্যমে বাজারজাত হয়ে থাকে। ভালুকার ডাকাতিয়া ইউনিয়নের চানপুর গারো বাজার গ্রামের গুড় উৎপাদনকারী আখ মাড়াইকল মালিক ওসমান মিয়া জানান, তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে নিজস্ব কলে রস তৈরি করে আখের গুড় উৎপাদন করে মোটামুটি লাভবান হয়েছেন। মল্লিকবাড়ী, চানপুর, নয়নপুর, আউলাতলিসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে শত শত আখ চাষি রয়েছে। এসব চাষিদের উৎপাদিত আখ বিভিন্ন মাড়াই কলে গুড় তৈরি করে প্রতি মৌসুমে কোটি কোটি টাকা আয় করে থাকেন। গুড় বিক্রির আয় হতে বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে তারাও লাখ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করে নিজেরা আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছেন। তিনি জানান, তারা যদি সরাসরি পাইকার বা ক্রেতার কাছে গুড় বিক্রি করতে পারতেন তাহলে লাভবান হতে পারতেন। মধ্যস্বত্বভোগী আড়তদারদের মাধ্যমে তারা গুড় বিক্রি করায় লাভের একটা বড় অংশ চলে যায় তাদের পকেট থেকে। তার পরেও ভালুকায় আখের গুড় উৎপাদন করে প্রতি মৌসুমে কারখানা মালিক ও আখ চাষিরা শত কোটি টাকার ওপরে আর্থিক আয় করে থাকেন যা অন্য কোনো কৃষিতে পাওয়া যায় না।
তাদের দাবি, সরকারি প্রনোদনা ও কারিগরি দিক-নির্দেশনা পেলে আখ চাষ ও গুড় উৎপাদন করে এ এলাকাকে আরও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ করা সম্ভব। তিনি জানান, সাত মণ কাঁচা রস জাল করলে এক মণ গুড়ের পাটা তৈরি করা যায়। প্রতি মণ গুড় তৈরিতে খরচ হয় ৩০০০ টাকার মতো। প্রতিদিন তারা ১০ মণ গুড় উৎপাদন করতে পারেন। গত বছরের তুলনায় এ বছর গুড়ের দাম কিছুটা কম হওয়ায় তারা লোকসানের আশঙ্কা করছেন। প্রতি মণ গুড় বর্তমান বাজারে পাইকারি ৩ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মণ গুড় বিক্রি করে ৬-৭শ’ টাকা মুনাফা পাওয়া যায়। এতে খরচ বাদে দৈনিক তারা ৬-৭ হাজার, মাসে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করে থাকেন। ডিসেম্বর মাসের প্রথম থেকে শুরু হওয়া গুড় উৎপাদন কাজ একটানা ৬ মাস পর্যন্ত চালু থাকে।
তাদের উৎপাদিত গুড়ের জন্য বিভিন্ন এলাকার পাইকার ও ফরিয়ারা অগ্রিম বায়না দিয়ে থাকেন। ১৪/১৫ জন শ্রমিক আখ সংগ্রহ, মাড়াই, রস ছাড়ানো, জাল করা ও গুড় তৈরির কাজ করে থাকেন।