টাঙ্গাইল জেলা শহরে নানা মাত্রায় শব্দ দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা উপেক্ষা করে সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায় ব্যবহার করা মাইকের উচ্চ মাত্রার শব্দে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হচ্ছে। অতি উচ্চমাত্রার এ শব্দ দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর কোনো প্রতিকার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে শহরের জীবনযাত্রায় শব্দ দূষণের ব্যাপকহারে প্রভাব পড়ছে।
জানা যায়, টাঙ্গাইল শহরের শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যান ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে ঘিরে প্রায় দিনই সভা-সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড হয়ে থাকে। এসব কর্মকান্ডের প্রচারণা কাজে উচ্চ মাত্রার শব্দযন্ত্র ও মাইক ব্যবহার করা হয়। অথচ সন্নিকটেই রয়েছে নজরুল সেনা স্কুল, বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, জামে মসজিদ, টাঙ্গাইল প্রি-ক্যাডেট স্কুল এবং টাঙ্গাইল সরকারি মহিলা কলেজ। সভা-সমাবেশ চলাকালে শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানের পাশে জেলা সদর সড়কে পৌরসভার ল্যাম্পপোস্ট ও বিদ্যুতের খুটিতে কয়েকটি করে মাইকের হর্ণ লাগানো থাকে। এসব মাইকের হর্ণগুলো কখনো কখনো এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে লাগানো হয়ে থাকে। শহরের শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যান ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে পৌরসভার লাইটপোষ্ট ও বিদ্যুতের খুটিতে লাগাতার মাইকের হর্ণ লাগানোর ফলে বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়, টাঙ্গাইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, টাউন প্রাইমারি স্কুল, মডেল প্রাইমারি স্কুল, বিবেকানন্দ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি কুমুদিনী কলেজ সহ বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখায় বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া এসব এলাকায় হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীদের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং সভা সমাবেশের প্রচারণার কাজে ব্যবহৃত মাইক শহরের বিভিন্ন সড়কে ঘুরে ঘুরে প্রচারণা চালায়। সড়কগুলো অধিকাংশই কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল-ক্লিনিক সংলগ্ন। প্রচারণার কাজ করা ব্যক্তিদের অসচেতনতা এবং প্রচার মাইকের নীতিমালা অনুসরণ না করার কারণে অতিমাত্রার উচ্চশব্দে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হয়। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রচার মাইকের নিয়ম কিছুটা হলেও মানা হয়- কিন্তু বাকি সময়ে কোনো প্রকার নিয়ম মানা হয়না।
শহরে প্রতিনিয়ত ব্যাটারি চালিত অটো ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার হর্ণ অতি উচ্চমাত্রায় বাজানোর ফলে যাত্রী-পথচারীরাও শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বখাটে তরুণ-যুবকরা মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের সাইলেন্সারে হলার নামক অংশ এবং হাইড্রলিক হর্ণ লাগিয়ে দাপটের সঙ্গে ব্যবহার করে থাকে। এসব যানবাহন রাস্তায় চলার সময় বিকট শব্দের সৃষ্টি হয়- যে শব্দ যাত্রী ও আশপাশের পথচারীদের চরম বিরক্তির কারণ হয়। তবে এসব বিকট শব্দের যানবাহনের বিরুদ্ধে কদাচিৎ জেলা পুলিশের পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। আবার বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান উপলক্ষেও বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে অনুষ্ঠানের আগে থেকে শুরু করে শেষ না হওয়া পর্যন্ত উচ্চ মাত্রার শব্দযন্ত্র বাজিয়ে এবং বাজি ফুটানোর মাধ্যমে আনন্দ-উৎসব করায় প্রতিবেশিরা চরম অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়ে।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ সংশোধিত ২০২৫ অনুসারে দিন ও রাতে ‘নিরব এলাকায় ৫০ থেকে ৪০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় ৫৫ থেকে ৪৫ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০-৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫-৭০ ডেসিবেল’ শব্দমাত্রা ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসের ১০০ মিটারের মধ্যে ‘নিরব’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব স্থানে শব্দ দূষণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ওই বিধিমালায় প্রথমবার অপরাধের জন্য অনধিক এক মাস কারাদ- বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড; পরবর্তী প্রতিবার অপরাধের জন্য অনধিক ৬ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া বিধি ৬(১) এর অধীন প্রস্তুত আমদানী ও বাজারজাত করণে প্রতিবার অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। ওই বিধিমালায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আইন প্রয়োগ করার কথা বলা হলেও এ বিষয়ে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ বাস্তবে দেখা যায় না।
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তরুণ ইউসুফ জানান, প্রায়শই রাস্তায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশের প্রচার মাইক লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায় একসাথে চার-পাঁচটা ব্যাটারি চালিত অটোতে দুইটা করে হর্ণ লাগিয়ে প্রচারণা চালায়। ফলে অসহনীয় শব্দ দূষণ হয়। যেসব এলাকা দিয়ে ওই প্রচার মাইকগুলো চলাচল করে সেসব এলাকায় মানুষজন খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। এসব শব্দ দূষণ প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোড়ালো প্রতিকার পদক্ষেপগ্রহণ করা প্রয়োজন।
পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন সেফ লাইফ এর সভাপতি রুবেল মিয়া জানান, টাঙ্গাইল জেলা শহর তুলনামূলকভাবে অনেকটা ছোট। এ শহরে অনেকগুলো সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রচারণার কাজে ব্যবহৃত মাইকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলাকালীন সময়েও আশ-পাশে ঘুরাঘুরি করার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করে ২-৩ জন মাইকম্যান জানান, যারা প্রচারণা করায় তারা মাইকসহ ঘণ্টাচুক্তি হিসেবে তাদেরকে ভাড়া করেন। টাঙ্গাইল শহরের প্রায় সব এলাকায়ই ২-৪টা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে। থেমে থেমে প্রচারণা চালালে তারা মন:ক্ষুন্ন হন। একই শর্তে শহরের একজন সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসায়ী জানান, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যারা সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া নেন। তাদের উচিৎ পরিবেশ আইন মেনে শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা। কিন্তু তারা নিজেদের মতো করে শব্দযন্ত্র ব্যবহার করে থাকে। অনেক সময়ই তাদের নির্দেশনা ভাড়াগ্রহণকারীরা মানেন না।
জেলার সচেতন নাগরিক মহল মনে করেন, সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রচার-প্রচারণাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শব্দযন্ত্র ব্যবহারে নীতিমালা অনুসরণ করার বিষয়ে প্রশাসনের জোড়ালো পদক্ষেপগ্রহণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিনত হয়েছে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জহিরুল ইসলাম তালুকদার জানান, যেসব যানবাহনে হাইড্রলিক হর্ণ লাগানো থাকে অভিযান পরিচালিত করে সেসব যানবাহন থেকে হাইড্রলিক হর্ণ খুলে নেওয়া এবং জরিমানা করা হয়। সাম্প্রতিক একটা প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে- পরবর্তীতে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক: বৃষ্টিতে তলিয়ে গেল আশ্রয় শিবির, তীব্র শীতে দুর্ভোগ
আন্তর্জাতিক: ট্রাম্পের অভিবাসী ফেরত অভিযান কি আরও জোরালো হবে
সারাদেশ: বোয়ালখালীতে কৃষকের গরু চুরি
সারাদেশ: বদলগাছীতে মহান বিজয় দিবস পালিত