খড়খড়িয়া নদী বেষ্টিত নীলফামারীর সৈয়দপুর শহর শত্রুমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। সারাদেশে বিজয়ের পতাকা ১৬ ডিসেম্বর উড়লেও সৈয়দপুর ছিলো পুরোপুরি শত্রু বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ১৯৭১ সালে ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালে দেশের অন্যান্য জনপদ শত্রুমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার পশ্চিম পাকিস্তান সমর্থক উর্দুভাষীরা নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় সৈয়দপুরে চলে আসে। এমন পরিস্থিতিতে বাঙ্গালী শূন্য গোটা সৈয়দপুর শহরটি উর্দুভাষী বিহারীদের দখলে চলে যায়। এসব উর্দুভাষীদের সার্বক্ষণিক সহায়তা করে সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈনিকরা।
তাছাড়াও ৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর ভারতের বিহার প্রদেশের অবাঙ্গালী উর্দুভাষীরা রেলওয়ের শহর সৈয়দপুরে চলে আসে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ আবার সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় চাকুরির সুযোগ পায়। ফলে পাকিস্তান জমানার শুরু থেকেই সৈয়দপুরকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী পার্বতীপুর, রংপুরের আলমনগর, কাউনিয়া ও লালমনিরহাট শহরে দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে উর্দুভাষী বিহারীদের শক্তিশালী আবাসস্থল গড়ে ওঠে। এরই প্রেক্ষিতে উগ্র উর্দুভাষী পাকিস্তানপন্থীরা সৈয়দপুরকে বেইজ করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের নিজস্ব প্রদেশ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রস্তাবিত ওই প্রদেশের নাম দেয়া হয়েছিলো নিউ বিহার প্রদেশ। যার প্রাদেশিক রাজধানী হতো সৈয়দপুর। পাকিস্তানপন্থী বিহারীদের এমন কল্পনা ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত সৈনিকরা মিলে তারা ইস্পাত দৃঢ়তায় সৈয়দপুর রক্ষার প্রস্তুতি নেয়। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা চরম বেকায়দায় পড়ে যায়। সেই সময়ে নীলফামারী জেলার ছয়টি থানার মধ্যে ডিমলা ১১ ডিসেম্বর, ডোমার ৬ ডিসেম্বর, জলঢাকা ১২ ডিসেম্বর, নীলফামারী সদর ১৩ ডিসেম্বর, কিশোরীগঞ্জ ১৫ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হলেও সৈয়দপুর শত্রুমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। এই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াইয়ে সহায়ক হয়ে দাঁড়ায় সৈয়দপুর শহর বেষ্টিত খড়খড়িয়া নদী। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি খান সেনারা পানিকে বেশ ভয় পেতো। আর এই সুযোগকে কাজে লাগায় মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা বাহিনী। সৈয়দপুরকে শত্রুমুক্ত করতে এটি শেষ প্রতিরোধ যুদ্ধ ভূমিতে পরিণত হয়।
ইছামতি যুদ্ধের দায়িত্ব থাকা মিত্র বাহিনীর ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধীন ২১ রাজপুত রাইফেলস জানতো এই অঞ্চলেই নির্ধারণ হবে এ জনপদের ভাগ্য। পাকিস্তানি বাহিনীর কুখ্যাত ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সর্বশেষ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয় খড়খড়িয়া নদীর তীরে। ঠাকুরগাঁও দখলের পর মিত্রবাহিনীর প্রবল আঘাতে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা ইছামতি নদীর ধারে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তারা প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে খড়খড়িয়া নদীর তীরে শেষ শক্তি সঞ্চয় করে অবস্থান নেয় সৈয়দপুর সেনানিবাস ও শহরে বসবাসরত পাকসেনাদের সহায়ক শক্তি উর্দুভাষীদের রক্ষা করার প্রত্যয়ে।
এমন সংবাদ পেয়ে রাজপুত ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা ব্রিগেডিয়ার পিএন কাথপালিয়ার নেতৃত্বে দ্রুত খড়খড়িয়া নদীর দিকে অগ্রসর হয়। দিনের শেষ বেলায় শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মরণপণ মুক্তির লড়াই। ‘এ’ কোম্পানির একটি প্লাটুন সামনে এগিয়ে গিয়ে শত্রুর দৃষ্টি নিজের দিকে নেয়। এমন অবস্থায় বি ও সি কোম্পানীর মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে। দ্বিতীয় স্টেপে ডি কোম্পানীর আক্রমণ শত্রুপক্ষকে দিশেহারা করে ফেলে। এই যুদ্ধে সন্ধ্যার আগেই ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। নিহত হয় তাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর এমএ সাঈদসহ অসংখ্য সৈন্য। জীবিতদের করা হয় গ্রেফতার।
এরপর পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সদস্যরা সৈয়দপুরের দিকে ধেয়ে আসে।
পরিস্থিতি বুঝে পাকিস্তানি মেজর শাফি আত্মসর্ম্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। উত্তরাঞ্চলীয় জিওসি মেজর জেনারেল নজর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের পর সারেন্ডারের চুড়ান্ত আলোচনা হয় দারোয়ানীতে। সেখানে হেলিকপ্টারে পৌছান ৬ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল পিসি রেড্ডি। এই অভিযানে বিমান বাহিনীর বৈমানিক হয়েও পদাতিক বাহিনীর ভূমিকায় নেতৃত্বে দেন উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার। আর এই খড়খড়িয়া তীরের যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানিদের শেষ প্রতিরোধ চূর্ণ বিচূর্ণ করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। এই দিনটি ছিলো ১৮ ডিসেম্বর।
এদিনই সৈয়দপুর শত্রুমুক্ত হয়। সারা শহরসহ সৈয়দপুর সেনা ছাউনিতে উড়ে সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত চিহ্নিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।