image

নীরবতার আড়ালে মুক্তিযোদ্ধা জহর সেন

বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রতিনিধি, শ্রীমঙ্গল

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কিছু নাম বারবার উচ্চারিত হয়, আবার কিছু নাম থেকে যায় নীরবতার আড়ালে—তবু তাদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। সিলেটের জকিগঞ্জের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জহর সেন তেমনই এক অনালোকিত অধ্যায়।

১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ বিজয় দিবসে সাংবাদিক দেবদুলাল মুন্নার একটি ফেসবুক পোস্ট নতুন করে আলোচনায় আসে এই গেরিলা যোদ্ধার জীবন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের গল্প।

একসময়কার শ্রীমঙ্গল থানা শহরের কলেজ রোডে শ্রীমঙ্গল আদর্শ মহাবিদ্যালয় -এর সাবেক প্রভাষক এবং বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক দেবদুলাল মুন্না ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে লেখেন—জহর সেনের একটি ছবি বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, অনেকেই সেটি নিজের নামে পোস্ট করেছেন, যেন তিনিই ছবিটির আবিষ্কারক। অথচ জহর সেনকে নিয়ে প্রথম লিখিত তথ্যভিত্তিক পোস্টটি তিনিই প্রকাশ করেন ২০১৯ সালে, পরে তথ্য সংশোধন করে আবার ২০২১ সালে লেখেন।

জহর সেন ছিলেন তৎকালীন সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানার এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। বয়সে তরুণ হলেও তার মধ্যে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রথম যুদ্ধে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে হবিগঞ্জের বাহুবলে গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ করেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই হয়ে ওঠে তার জীবনের মূল লক্ষ্য।

দেবদুলাল মুন্নার পোস্ট অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জহর সেন ১৭ জন পাকিস্তানি সেনা ও দুই আলবদর সদস্যকে হত্যা করেন। এই তথ্য তিনি বিভিন্ন সূত্র ও স্মৃতির ভিত্তিতে উল্লেখ করেছেন। তবে যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে জহর সেনের জন্য অপেক্ষা করছিল এক নির্মম বাস্তবতা।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে জহর সেন দেখতে পান তাঁর পারিবারিক জীবনের ভিত্তি ভেঙে গেছে। তাঁর এক কাজিন নির্যাতনের শিকার হন এবং পিতা-মাতা নির্মমভাবে নিহত হন। এই ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি তাঁকে মানসিকভাবে গভীরভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। যুদ্ধের জয় তাঁর জীবনে এনে দেয়নি স্বস্তি বা নিরাপত্তা।

জহর সেন কখনো মুক্তিযোদ্ধার সনদের জন্য আবেদন করেননি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নিজেকে নিরাপদ মনে না করায় তিনি ধীরে ধীরে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি ভারতে চলে যান এবং পরবর্তীতে ভারতের আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই নীরবে কেটেছে তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়।

অনেকের অজানা তথ্য হলো—জহর সেন আর বেঁচে নেই। দেবদুলাল মুন্না তাঁর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি ২০২৪ সালে করিমগঞ্জেই মৃত্যুবরণ করেন। কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা আনুষ্ঠানিক স্মরণ ছাড়াই নিভে যায় এক গেরিলা যোদ্ধার জীবনপ্রদীপ।

দেবদুলাল মুন্না উল্লেখ করেন, তাঁর প্রথম লেখা পড়ে ডকুমেন্টারি নির্মাতা কাউসার চৌধুরী জহর সেনকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এ বিষয়ে এক তরুণ ও এক তরুণী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন। তবে নানা কারণে সেই উদ্যোগ আর বাস্তব রূপ পায়নি। ফলে জহর সেনকে পর্দায় তুলে ধরার সম্ভাবনাও থেকে গেছে অপূর্ণ।

এই প্রতিবেদনটির তথ্যসূত্র হিসেবে দেবদুলাল মুন্না উল্লেখ করেছেন মহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর পিএস সালেকউদ্দিন রচিত বই ‘সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ’। পাশাপাশি তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে তিনি নিজে জহর সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সে সময় ‘প্রিয় প্রজন্ম’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল, যদিও বর্তমানে সেই সংখ্যাটি বা বইটি তাঁর কাছে সংরক্ষিত নেই বলে তাঁর ফেসবুক একাউন্টে মন্তব্য করেন।

জহর সেনের যে ছবিটি নিয়ে এত আলোচনা, সেটি সংরক্ষিত রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। ছবিটি তুলেছিলেন একজন ফরাসি আলোকচিত্র সাংবাদিক অ্যান ডি হেনিং। বাকিটা ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির ওপরই নির্ভরশীল।

জহর সেনের নাম বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত নয়, তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদকও গ্রহণ করেননি। যুদ্ধশেষে ভারত থেকে ফিরে এসে নিজের জন্য স্বীকৃতি দাবি করার পথেও তিনি হাঁটেননি। ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা, যুদ্ধোত্তর বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত ক্ষতির ভার হয়তো তাঁকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রেখেছিল। তবু এই অনুল্লিখিত বাস্তবতা তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বা ত্যাগকে খাটো করে না। ইতিহাসের মূলধারার বাইরে থেকেও জহর সেন দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন—নিঃশব্দে, প্রচারের বাইরে। তাঁর জীবনগাথা সকলকে মনে করিয়ে দেয়, মুক্তিযুদ্ধ কেবল তালিকা, পদক কিংবা পরিচিত নামের ইতিহাস নয়; এটি অসংখ্য নীরব বীরের আত্মত্যাগের সমষ্টি। বিজয়ের দিনে তাই জহর সেনের মতো বিস্মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করাই হতে পারে ইতিহাসের প্রতি সবচেয়ে সংযত ও দায়িত্বশীল শ্রদ্ধা।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি