বাংলার মাটি, জল, বাতাসে একসময় যে সুর বেজে উঠত মানুষের প্রাণে, আজ সেই সুরের করুণ হাহাকার বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। একতারা, দোতারা, বাঁশির সুরে ভেসে বেড়ানো সেই লোকসংগীত ও পালাগান আজ কেবল স্মৃতির ধূসর অধ্যায়। জয়পুরহাটের আক্কেলপুরসহ উত্তর জনপদের গ্রামগুলোয় এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, যেন নিজ মাটিতেই নির্বাসিত হচ্ছে বাংলার প্রাচীনতম সংগীতরূপ।
এক সময় গ্রামের মেলা মানেই ছিল পালাগানের মঞ্চ, আর গানের তালে তালে উত্তাল জনতা। কাহিনির ভেতর দিয়ে উচ্চারিত হতো প্রেম, ত্যাগ, ভক্তি আর মানবতার শাশ্বত বার্তা। রাতভর চলত গান, ঢোলের ধ্বনি কাঁপিয়ে দিত আকাশ-বাতাস। কিন্তু এখন সেই সুর নীরব, সেই মঞ্চ শূন্য। হাটে বাজারেও দেখা যেত লোকসংগীতের গান। উপজেলার শান্তা গ্রামের প্রবীণ লোকশিল্পী আব্দুস সালাম বলেন, “আগে আমাদের গান শুনে গ্রাম মাতত, এখন টেলিভিশনের আওয়াজে ডুবে গেছে মানুষ। একতারা এখন ধুলোয় পড়ে থাকে, আর আমরা কেবল স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছি।” জীবনের প্রায় ছয় দশক তিনি পার করেছেন পালাগানের দলে। মলুয়া সুন্দরী, ধনপতি-সীতারাম, বেহুলা-লখিন্দর, লাইলী মজনু , রাধা-কৃষ্ণ— এসব পালা তার মুখে মুখে ফিরত। এখন সেই গান, সেই গায়ক, সেই রাত—সবই ইতিহাস।
লোকসংগীত কেবল বিনোদন নয়; এটি ছিল সাধারণ মানুষের জীবনবোধ, নৈতিকতা, ইতিহাস ও ধর্মীয় দর্শনের বাহক। নিরক্ষর জনতার কাছে লোকগানই ছিল শিক্ষা ও জ্ঞানের উৎস। কৃষকের দুঃখ, নারীর ব্যথা, প্রেমিকের আকুলতা—সবই গাঁথা থাকত সুরে। একেকটি পালা যেন একেকটি জীবন্ত ইতিহাস।
আধুনিকতার চাপে, প্রযুক্তির ঝলকে এই সুরগুলো নিভে যাচ্ছে। ইউটিউব, ডিজে, আধুনিক পপ সংস্কৃতি গ্রামীণ আসরের জায়গা দখল করেছে। এখন আর গ্রামে মেলা মানেই লোকগান নয়; বরং সাউন্ডবক্সে বাজে বাণিজ্যিক গান।
আক্কেলপুর থিয়েটারের সভাপতি মো. আয়ুব মিয়া বলেন, “লোকজ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে আমরা এই সংগঠন চালিয়ে আসছি। ১৫–২০ বছর আগে লোকসংগীত, পালাগান, জারি—এসব গানের প্রতি মানুষের গভীর আগ্রহ ছিল। আমরা চেষ্টা করছি লোকসংগীতের সৌন্দর্য তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে আবারও আকৃষ্ট করতে। কিন্তু এ কাজে স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা পাই না। যারা সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চাকে ভালোবাসেন, তারা ও প্রশাসন যদি এগিয়ে আসেন, তবে হারিয়ে যেতে থাকা এই লোকজ ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমাদের প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী হবে এবং আঞ্চলিক লোকসংগীতকে জাতীয় মঞ্চে তুলে ধরার সুযোগ সৃষ্টি হবে।”
গোপীনাথপুরে ইউনিয়নের বাউল সোহাগ বলেন, তরুণ প্রজন্মের আগ্রহে যে শূন্যতা দেখা দিয়েছে, তা সবচেয়ে ভয়াবহ। এখনকার যুবসমাজ আধুনিক সংগীতেই সীমাবদ্ধ, তারা জানেই না ‘মলুয়া সুন্দরী’ বা ‘ধনপতি-সীতারাম’ কী গল্প বহন করে। লোকগানের শিক্ষাগত, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তারা অনুধাবন করতে পারছে না। তবে আমরা চেষ্টা করতেছি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: টেইক অফ ইস্তাম্বুল ২০২৫ এ বাক্কো’র অংশগ্রহণ
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: টিএমজিবি সদস্যদের জন্য কনটেন্ট তৈরির কর্মশালা আয়োজন