মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁর আত্রাই উপজেলায় দেশীয় মাছের সংকটে ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি শিল্পে ভাটা পড়েছে। নদী ও জলাশয়ে পানি কম থাকায় কাক্সিক্ষত পরিমাণ মাছ মিলছে না। ফলে কাঁচা মাছের দাম বেড়ে যাওয়ায় শুটকি উৎপাদন কমেছে, আর এতে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ খাতের সঙ্গে জড়িত শতাধিক ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মানুষ।
নদীভিত্তিক এলাকা হওয়ায় আত্রাই উপজেলায় প্রায় শতাধিক ছোট-বড় জলাশয় রয়েছে। এসব জলাশয় থেকে পুঁটি, খলিশা, টাকি, শৈল, চান্দা ও চোপড়াসহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। এসব মাছ দিয়েই দীর্ঘদিন ধরে শুটকি উৎপাদন হয়ে আসছে, যা দেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রপ্তানি হয়। আত্রাইয়ের পাশাপাশি জেলার মান্দা উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় শুটকি উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
তবে চলতি বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকায় মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী মাছ না পাওয়ায় পুঁটি, খলিশা ও টাকি মাছ কেজিপ্রতি ৪০-৫০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে শুটকি উৎপাদনের খরচ বেড়েছে এবং অনেক চাতাল এখনো ফাঁকা পড়ে রয়েছে।
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার ভরতেঁতুলিয়া গ্রাম শুঁটকির গ্রাম হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিতি। রেল স্টেশনের দুই পাশে চোখে পড়বে শুটকির মাছ শুকানোর চাতাল।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার, (১৮ ডিসেম্বর ২০২৫) আত্রাই উপজেলার ভরতেঁতুলিয়া গ্রামের শুটকিপল্লীর ব্যবসায়ীরা জানান, শুঁটকি বিক্রি করেই তাদের সারা বছরের সংসার চলে। কিন্তু এ বছর মাছের সংকটে উৎপাদন নিয়েই অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তারা।
তারা জানান, নওগাঁর শুঁটকি সৈয়দপুর, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, জামালপুর ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়ে থাকে। পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরাতেও রয়েছে এই শুটকির চাহিদা। সাধারণত প্রথমে শুঁটকি সৈয়দপুরে পাঠানো হয়, পরে সেখান থেকে ট্রেনযোগে ভারতে রপ্তানি করা হয়।
জেলার প্রধান মৎস্য বাজার আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ মৎস্য আড়ত। এখান থেকে শুঁটকি ব্যবসায়ীরা কাঁচা মাছ কিনে পরিষ্কার করে লবণ দিয়ে রোদে শুকিয়ে শুটকি তৈরি করেন। ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি মৌসুমে খলিশা মাছের দাম কেজিতে ৭৫-৮০ টাকা, পুঁটি ১০০-১৬৫ টাকা এবং টাকি মাছ ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শৈল ও বোয়ালসহ অন্যান্য দেশীয় মাছ না পাওয়ায় উৎপাদন আরও ব্যাহত হচ্ছে। ভরতেঁতুলিয়া গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী রকিবুল হাসান বলেন, ‘গত বছর এক মৌসুমে প্রায় ২৫ লাখ টাকার শুটকি বিক্রি করেছি। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ লাখ টাকার শুটকি তৈরি হয়েছে। মাছ কম পাওয়ায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, ফলে লাভ কমে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শুঁটকির গুণগত মান আরও উন্নত করা গেলে দেশের বাইরে বড় বাজার তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু মানের ঘাটতির কারণে দামও কম পাচ্ছি, চাহিদাও কমে যাচ্ছে।’
সিংগা গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী আলহাজ্ব আজহার আলী জানান, তিন মন কাঁচা পুঁটি মাছ শুকিয়ে এক মন শুটকি হয়, যা বিক্রি হয় ১০-১২ হাজার টাকায়। আর চার মন খলিশা শুকিয়ে এক মন শুঁটকি পাওয়া যায়, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার টাকা।
অপর শুটকি ব্যবসায়ী সাদেক মোল্লা বলেন, ‘নদীতে কিছু পানি থাকলেও বিল ও জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেছে। আবার চায়না জাল (রিং জাল) দিয়ে অবাধে মাছ শিকার করায় মাছের প্রজনন কমছে। এতে প্রতিবছরই দেশীয় মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।’ তিনি মাছের প্রজনন রক্ষায় মৎস্য বিভাগের আরও কঠোর তদারকির দাবি জানান।
এ বিষয়ে আত্রাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের নিরাপদ ও মানসম্মতভাবে শুঁটকি তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধভাবে মাছ শিকার বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’
নওগাঁ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আলী বলেন, ‘আত্রাই উপজেলায় ২৬ জন এবং মান্দা উপজেলাসহ মোট প্রায় ৪০০ জন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শুঁটকি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বর্ষা মৌসুমে পানি কম থাকায় সঠিক সময়ে মাছের প্রজনন হয়নি। তবুও চলতি বছর জেলায় প্রায় ২৫০ টন শুঁটকি উৎপাদন হবে বলে আশা করছি, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫-৬ কোটি টাকা।’
মাছের সংকট কাটিয়ে উঠতে দেশীয় মাছের প্রজনন বৃদ্ধি, অবৈধ জাল ব্যবহার বন্ধ এবং শুঁটকি মানোন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।