‘গ্রামাঞ্চলে একটি কুসংস্কার প্রচলিত আছে যে কুষ্ঠরোগ একটি অভিশাপ ও পাপের ফল এবং একটি দুরারোগ্য রোগ, যদিও এই মিথ্যা ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই, বলেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. একেএম আবু সাঈদ। কয়েকদিন আগে তার কার্যালয়ে দৈনিক সংবাদের এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ডা. সাঈদ বলেন, কুষ্ঠরোগ যক্ষার মতো একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবের কারণে সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুরে মানুষের মধ্যে এই মারাত্মক রোগটি বাড়ছে। তিনি আরও বলেন যে কুষ্ঠরোগ পাপের ফল নয়। সঠিক শনাক্তকরণের পর সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব হতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে কুষ্ঠ একটি মৃদু সংক্রামক ও দীর্ঘ মেয়াদী জীবাণুঘটিত রোগ কিন্তু ছোঁয়াচে নয়।
উল্লেখ্য, চার্চ অফ বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (সিবিএসডিপি) এর আরেকটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, দ্যা লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিএলএমআইবি) এর অর্থায়নে, জুন ২০১৫ থেকে মেহেরপুর জেলায় অ্যাডভোকেসি ফর এমপাওয়ারমেন্ট প্রজেক্ট (এইপি) এর মাধ্যমে কুষ্ঠরোগী সনাক্তকরণের কাজ শুরু করে। এই প্রতিবেদক জেলার অনেক রোগীর সাথে সরজমিনে যেয়ে দেখা করে কথা বলেছেন।
অতিসম্প্রতি তিনি মুজিবনগর উপজেলার বিশ্বনাথপুর এবং দরিয়াপুর গ্রামে দুই রোগীর সাথে দেখা করেছেন। ফাহিম মুস্তাফির ওরফে জাহিদ, জেনারুল ইসলাম এবং লাভলী খাতুনের ছেলে। বাবা জেনারুল
একজন দরিদ্র দিনমজুর। ১৬ বছর বয়সে জাহিদের তার গ্রামের বন্ধুদের সাথে খেলার কথা ছিল। সেই সময় সে প্রচন্ড ব্যথায় ঘরের ভিতরে অবস্থান করছিল। কিন্তু কেউ জানত না কী কারণে জাহিদের এই অসহনীয় ব্যথা এবং কোন রোগে ভুগছে। ২০২২ সালে তার প্রথম লক্ষণ দেখা দেয়।
জাহিদের বাবা জানান, সন্ধ্যা আপা (সালোম কর্মী) তাকে মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান কিন্তু শিশু হওয়ায় চিকিৎসক তাকে ২৫০-শয্যাবিশিষ্ট মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করেন। ডাক্তার তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী জেলা কুষ্টিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে রেফার্ড করেন। কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যায়নি। অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে জাহিদের বাবা তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
এরই মধ্যে দুই বছর পার হয়ে যায়। যদিও ভুল রোগ নির্ণয় তবুও সাময়িক ভাবে সামান্য উন্নতি দেখা যায়। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তীব্র জ্বর, শরীরে ব্যথা প্রচন্ড জ্বরের সাথে তাতে তার
অবস্থার অবনতি ঘটে। একজন সালোম কর্মী তাকে মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।
সেখানকার ডাক্তাররা তাকে পিজি হাসপাতালে রেফার্ড করেন। পিজি হাসপাতালের ডাক্তাররা তার ত্বক পরীক্ষার জন্য ঢাকাস্থ মহাখালী কুষ্ঠ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। অবশেষে কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞ জাহিদ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত বলে শনাক্ত করেন। দুই বছর ধরে তার রোগ নির্ণয় করা হয়েছিল যা ছিল ভুল এবং তখন তার শারিরীক অবস্থা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি ঘটে। ফলস্বরূপ, তার বাবা-মা সামাজিকভাবে হেয় হতেন প্রতিবেশীদের কাছে। তাদের মনে হয়েছিল যে এই রোগটি পাপের ফল।
এই সময়ের মধ্যে জাহিদের দরিদ্র পিতা মাতা প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। জাহিদের ওষুধের প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে, তার মা লাভলী সালোমের এরিয়া কোঅর্ডিনেটরের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে বাংলাদেশে লেপ্রসি মিশনের কর্মরত ডা. জুয়েলের সাথে পরামর্শ করেন। তিনি তাকে অবিলম্বে নীলফামারী লেপ্রসি হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। এইপি কোঅর্ডিনেটর সন্ধ্যা মন্ডল জাহিদকে নীলফামারীর লেপ্রসি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য, আলসার আক্রান্ত আরেক রোগী সামাদকেও সেখানে পাঠান। অবশ্য তিনি এখন সুস্থ।
অর্ধেক মাস পর জাহিদ ঈদের ছুটি উপভোগ করতে বাড়ি ফিরে আসে। জাহিদের স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে খুশি হন পরিবারের লোকজন। এবং তারা জাহিদকে সস্পূর্ণ সুস্থ্য করার জন্য
পূণরায় নীলফামারী লেপ্রসী হাসপাতালে পাঠানোর জন্য সালোমকে অনুরোধ করেন। কুষ্ঠরোগের স্থানীয় ব্যবস্থাপনা তাকে আবার নীলফামারীতে লেপ্রসী হাসপাতালে পাঠান।
জাহিদের দাদী, যিনি তার নাতির সাথে ১৫ দিন হাসপাতালে ছিলেন, তিনি জানতে পারেন যে কুষ্ঠ একটি চিকিৎসাযোগ্য রোগ, কোনো পাপের ফল নয়। তিনি জাহিদকে পূর্ণ আরোগ্যের জন্য কুষ্ঠ হাসপাতালে পাঠানোর জন্য খুবই আশাবাদী এবং আগ্রহী ছিলেন।
যাই হোক, ফলপ্রসূ চিকিৎসার পর জাহিদ বাডিতে ফিরে আসে। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং খুশি। সে আবার তার বন্ধুদের সাথে স্কুলে যাবে এতদিন যারা তার সাথে মিশতো না এবং কোনও খেলাধুলাযতে অংশ গ্রহণ করতে দিতোনা। সে এবং তার বাবা-মা কুষ্ঠরোগ মিশনের কাজে খুশি। কুষ্ঠরোগ মিশনের লোকেরা মাঝে মাঝে তার গ্রামে যায় এবং তার দেখাশোনা করেন। তারা তাকে পরামর্শ দেন এবং প্রয়োজনে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করেন বলে জাহিদের পিতা মাতা জানান।
প্রসঙ্গক্রমে, এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০১৫ সাল থেকে সালোম চার্চ অব বাংলাদেশ এ যাবত ৬৮৮ জন কুষ্ঠরোগীকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বলাই বাহুল্য জেলার মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি গ্রাম কর্মীরা সার্ভে করতে পেরেছেন। এখন প্রায় সকল রোগীই সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং বর্তমানে মাত্র ৪৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। সালোম কর্মীদের সময়মত তৎপরতার
কারণে কুষ্ঠরোগে কেউই প্রতিবন্ধী হননি। তাছাড়া তারা বিভিন্ন জায়গায় জনসমাগম দেখলে স্কীন টেস্ট করেন এবং উঠান বৈঠক করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করেন।
অর্থ-বাণিজ্য: আগামী বছরও স্বর্ণের দাম বাড়তে পারে