পলাশের চরনগরদী এলাকার জিআরসি টীমকে আগরতলা রাজাকর্তৃক উপহার দেয়া সুবিশাল মাঠ যা বর্তমানে মানুষের বেচাকেনার হাট নামে বেশ সুপরিচিত, সেই চরনগরদীর সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে বৈলাম-চন্দনার স্মৃতি বিজড়িত মনোরম উপাখ্যান। বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁ এর বংশের বিশাল দেহের শক্ত পোক্ত সুদর্শন পুরুষ ছিলেন বৈলাম খাঁ। অপরদিকে চরসিন্দুরের জমিদারকন্যা চন্দনা ছিলো রুপে, গুনে, কৌশলে, পারদর্শিতায় একেবারে ষোল আনা। একদা পরিণত বয়সে চন্দনা সখিদের নিয়ে শীতলক্ষ্যা দর্শনে যায়, ঘাটে তখন সুপুরুষ সওদাগর বৈলাম খাঁ শীতলক্ষ্যার তিরে তরী ভীড়ায়। প্রথম পরিচয়েই দুজনার দুজনকে ভালো লেগে যায়। কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বিয়ে, কিভাবে সম্ভব হতে পারে বুদ্ধিমতি চন্দনা তখন পরিকল্পনা করে অসম্ভবকে সম্ভব করার। একমাত্র কন্যা ছাড়া আর কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় চন্দনার বাবা তখন পার্শ্ববর্তী দুষ্টু জমিদারদের দ্বারা নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়ে রাজ্য পরিচালনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। চন্দনা তখন বৈলাম খাঁ কে ছদ্মবেশ ধারন করে তার বাবার সংকট মোকাবেলা করতে বলেন। উক্ত সংকট মোকাবেলায় বৈলাম খাঁ বীরত্বের পরিচয় দেয়ায় চন্দনার বাবা তাকে খুশি হয়ে যা চাইবে তাই দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এই সুযোগে বৈলাম খাঁ, চন্দনাকে বিয়ে করার আবদার জানায়। চন্দনার বাবার চিন্তা গুরু থেকে গুরুতর হয়। গোপনে নিজ কন্যাকে ডেকে সবকিছু জানায়। ইচ্ছার টানে, অনিচ্ছার ভানে চন্দনা তখন বাবাকে তার ওয়াদা পুরন করতে অনুরোধ জানায়। এই ঘটনা মুহুর্তেই পুরা তল্লাটে ছড়িয়ে যায়। অত:পর,একমাত্র মেয়ের বিয়েতে উপহার হিসেবে চন্দনার বাবা তাকে বিশাল জমিদারিত্বের অংশবিশেষ লিখে দিতে মনোবাসনা স্থির করেন। কথামতো বিয়েতে আয়োজন করেন সকলের উপস্থিতিতে এক বিশাল আড়ম্বর সভার। একটানা যতগুলো অঞ্চলের নাম বলতে পারবে চন্দনা, তাকে লিখে দেওয়া হবে সেই সব পরগনার মালিকানা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে একসময় শুরু হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষনের।বুদ্ধিমতি চন্দনা তখন ছন্দে ছন্দে বইতে বইতে বিরাব, তারায় তারায় তারাব, এইভাবে একেরপর এক অঞ্চলের নাম টানা বলে যাচ্ছিলো। সব বলা হয়ে গেলে বাবাকেই মেয়ের অধীনে চলে যেতে হবে এই ভেবে শঙ্কায় জমিদার বাবু তখন হাসতে হাসতে চন্দনার গলা চেপে ধরে বলেন- আর কিছু বলিস না মা, এবার থাম। তারপরও গলা থেকে অস্ফুট স্বরে কের কেরাইতে কেরাবো বলে সর্বশেষ অঞ্চলের নামটাও হাসতে হাসতে উচ্চারণ করেন চন্দনা। মুহুর্তেই চন্দনার প্রত্যুৎপন্নমতিতায় আড়ম্বর সভা পঞ্চমুখ হয়ে যায়।
গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, দেশ থেকে দেশান্তর ছড়িয়ে পড়ে চন্দনার জয়গান।বর্তমান গয়েশপুর, বাড়ারচর, রাজারদী, চরনগরদী, উত্তর চন্দন, দক্ষিণ উত্তর চন্দন, রাবান, বরাব, বাঘাব, ছয়ঘরিয়া, ডাঙা, আতলাব, বিরাব, তারাব, কেরাবসহ আরো অসংখ্য এলাকা চলে এসেছিলো চন্দনার মালিকানায়। চন্দনার বংশধরেরা এখনও এসব এলাকায় সগৌরবে বিরাজমান। বরাব গ্রামের দেওদিঘীর পশ্চিম পাড়ে ৮ ফুটেরও বেশী লম্বা বৈলাম খাঁ এর কবর আর চন্দনার কবর কয়েক দশক আগেও দৃশ্যমান ছিলো যা এখন দিঘীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় পালদের ভাষ্যমতে দিঘী খনন করতে গেলে বৈলাম- চন্দনা পরিবারের হাড়গোর নাকি এখনো খুঁজে পাওয়া যায়। আজ বৈলাম খাঁ-ও নেই, সেই চন্দনাও নেই তবুও লোকমুখে এখনও রয়ে গেছে তাদের সেই আখ্যান। রয়ে গেছে তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত বংশধররা। এই এলাকায় পাকামু করা কোনো বাবার আদুরে মেয়েকে তুলনা করা হয় চন্দনার সাথে, আর উঁচু লম্বা ছেলেদের বৈলাম খাঁ এর সাথে। অনেকের মতে বৈলাম খাঁ এর নামানুসারে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু বৈলাম বৃক্ষের নাম আর চন্দনার নামে গলায় লাল দাগবিশিষ্ট তোতা পাখির নাম চন্দনা টিয়া রাখা হয়েছে বলে প্রচলিত মীথ আছে। কতকাল বয়ে গেছে, তবু আজও এখানকার এলাকার পাড়া মহল্লায়, লোকালয়ের নিত্য আড্ডায়, সকাল কিংবা সাঁঝের বেলায় কোথাও না কোথাও দাঁড়ালে হয়তবা বৈলাম- চন্দনার বন্দনা শোনা যায়। শল্প- কৃষি- ফলভান্ডার খ্যাত পলাশে এমনি আরো কতো স্মৃতিবিজড়িত মনোময় ইতিহাস
সারাদেশ: মহানন্দা নেশাজাতীয় সিরাপ জব্দ
সারাদেশ: হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সংস্কৃতি