১৪৬ কিলোমিটার আয়তনের এক সময়ের চির যৌবনা প্রমক্তা মাতামুহুরী নদী বর্তমানে দখল, দূষণ, অপরিকল্পিত বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ এবং পলি জমে ভরাট হয়ে পড়ার কারণে মারাত্মকভাবে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে একদিকে নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় কৃষিতে সেচ সংকট, অন্যদিকে পলি জমে ভরাট ও নদীর মাঝখানে দখলকাণ্ডের কারণে মাছের নিরাপদ অভয়াশ্রম তথা জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে মাতামুহুরী নদী তীরের জনপদে বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও নদী ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি সেচ সুবিধা অনিশ্চয়তায় নদীর তীরে রকমারি সবজি চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে।
মূলত মাতামুহুরী নদী চকরিয়া উপজেলার বুক চিরে প্রবাহিত ৪০ কিলোমিটার অংশে শাসন সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির অভাবে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশ সচেতন মহল।
মাতামুহুরী নদীর এমন করুণ প্রেক্ষাপটেও চলছে দখলকাণ্ডের মহোৎসব। সর্বশেষ অতিসম্প্রতি নদীর মাঝখানে মাছ চাষের জন্য বাঁশের বেড়া ও জাল দিয়ে ঘের তৈরি করা হয়েছে বাটাখালী সেতু এলাকায়। এ অবস্থার ফলে ব্যাহত হচ্ছে মাছের বংশবিস্তার। অন্যদিকে নদীর মাঝখানে মাছ চাষের ঘের তৈরি করার কারণে সংকোচিত হয়ে পড়েছে পানি চলাচলের গতিপথ।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মায়ানমার সীমান্তের মাইভার পর্বত থেকে প্রমক্তা মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি। এরপর নদীটি বান্দরবানের আলীকদম, লামা ও কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যানুযায়ী নদীটির দৈর্ঘ্য ১৪৬ কিলোমিটার। চকরিয়া উপজেলা অংশে নদীর আয়তন ৪০ কিলোমিটার।
চকরিয়ার বাটাখালী জলদাশপাড়ার পেশাদার জেলেরা জানিয়েছে, মাছ চাষ করার জন্য নদীর মাঝখানে বাঁশের বেড়া দিয়ে নদী দখলে নিয়েছেন সাহারবিলের সাবেক ইউপি সদস্য রেজাউল করিম। তার সঙ্গে রয়েছেন আনোয়ারুল হাসান, আবু জাফর, জামাল উদ্দিন, আরিফুল ইসলাম বাবুল, মোহাম্মদ মানিকসহ ৩২ জনের একটি চক্র। স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, নদী দখলে জড়িত ৩২ জনের বেশিরভাগই বিএনপির রাজনীতি করে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চকরিয়া-বদরখালী সড়কের উপজেলার সাহারবিল এলাকায় মাতামুহুরী নদী দখল করে বাটাখালী সেতুর নিচে বাঁশের বেড়া দেয়া হয়েছে। এই বেড়ার মধ্যে তারা অবৈধভাবে মাছচাষ করবেন। বেড়া দিয়ে নদী দখলের কারণে স্বাভাবিক পানি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সেখানে একটি খুপরি ঘরও বানানো হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, নদীর তীরে চকরিয়া পৌরসভা ও সাহারবিল জলদাশপাড়ার প্রায় ৪০০ জেলে পরিবারের বসবাস। তারা মাতামুহুরী ও খাল থেকে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন রাজনৈতিক আশ্রয়ে নদীতে বেড়া দিয়ে দখল শুরু হয়েছে। তাই ভয়ে অনেকে নদীতে মাছ ধরতে যায় না। বাঁশের বেড়া দেয়ার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা নদীতে গোসল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কাজ করতে পারছে না।
স্থানীয় জেলে রবি জলদাশ বলেন, নদীর মাঝখানে বাঁশের তৈরি বেড়া দিয়ে মাছ চাষ করতে একটি প্রভাবশালী চক্র দখল করেছে। এভাবে নদীতে বেড়া দেয়া শুরু হলে মাতামুহুরীর কোনো অংশই বাদ যাবে না। আমরা জেলেরা মাছ আহরণ করতে পারবো না।’
তবে নদী দখলকাণ্ডে জড়িত একজন আবু জাফর বলেন, ‘আমরা এলাকার বেকার যুবকদের নিয়ে মাছ চাষ করতে নদীর একপাশে বাঁশের বেড়া দিয়েছি। এখানে নদীর কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, বাঁধও দিচ্ছি না। এ ব্যাপারে উপজেলার একজন কর্মচারী আমাদের মৌখিক অনুমতি দেন।’
আর দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে সাহারবিলের সাবেক ইউপি সদস্য রেজাউল করিম বলেন, ‘আগামী তিন মাসের জন্য মাতামুহুরী নদীতে রাবার ড্যাম ফোলানো হলে পানি বাড়বে। আমরা এলাকার মুরব্বিরাসহ মিলেমিশে ৩২ জন মাছ চাষ করতে নদীতে বেড়া দিয়েছি। আমরা নদীও দখল করছি না, ব্যবসাও করছি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ারুল আমিন বলেন, ‘নদীতে বাঁশের বেড়া দিয়ে দখল করা আইনতভাবে অপরাধ। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ বিষয়ে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহীন দেলোয়ার বলেন, মাতামুহুরী নদীর মাঝখানে বেড়া দিয়ে মাছ চাষের ঝাঁক তৈরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।