image

বড়দিনের উৎসব নেই, আনন্দ নেই রাজলক্ষ্মীর ঘরে

বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রতিনিধি, বোয়ালমারী (ফরিদপুর)

ক্রিসমাস ডে বা বড়দিনে উৎসব নেই, আনন্দ নেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী অশীতিপর বৃদ্ধা রাজলক্ষ্মী কর্মকারের পরিবারের মনে। শীতের আমেজ একটু একটু বাড়ার সাথে দরজায় কড়া নাড়ছে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ক্রিস্টমাস ডে বা বড়দিন। ধনী, গরিব সকলের দুয়ারে উষ্ণ আনন্দ নিয়ে বড়দিন হাজির হলেও ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার খরসূতি গ্রামে বসবাসরত একমাত্র খ্রিস্টান পরিবারটির মনে আনন্দ নেই, নেই উৎসবের আমেজ ।

প্রায় ৩৭ বছর আগে আদিবাসী সনাতনী ধর্ম থেকে দারিদ্রতা জয় করতে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও ভাগ্যের সিঁকে খুলেনি তাদের। এখনও দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস তাদের।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাজলক্ষ্মী কর্মকারের শ্বশুর অধর কর্মকারকে গৃহস্থালি কাজ দেখাশোনার জন্য ভারতের কোনো এক প্রদেশ থেকে নিয়ে আসেন খরসূতি গ্রামের জমিদার, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রায়বাহাদুর ঈশান চন্দ্র ঘোষ। জমিদার বাড়ির ফুটফরমাশের কাজ করা অধর কর্মকারকে কিছু জায়গা লেখে দেন রায় সাহেব ঈশান চন্দ্র, সেই থেকে তাদের বাস খরসূতি গ্রামে। অধর কর্মকারের ৫ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে কাঙ্গাল কর্মকার ছাড়া সবাই সম্পত্তি বিক্রি করে কেউ মাগুরা কেউ নড়াইল, সাতক্ষীরায় চলে যায়। ৮ সন্তান নিয়ে কাঙ্গাল কর্মকার পৈত্রিক বাড়িতে থেকে জান। বৃদ্ধ বয়সে দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত কাঙ্গাল কর্মকার খ্রিস্টধর্মাবলম্বী জ্যাকব বারিদারের উৎসাহে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে। তিনিও জায়গা বিক্রি করে অন্যত্রে চলে যেতে উদ্যত হলে ব্যাপ্টিস্টচার্চ জায়গাটি ক্রয় করে চার্চ নির্মাণসহ তাদের একটি অংশ থাকার জন্য ছেড়ে দেন। সে জমিতেই এখনো রাজলক্ষ্মীর পরিবারের বসবাস।

রাজলক্ষ্মী নিজস্বতা বলতে দুই সন্তানের দুটি কুড়ে ঘর। ঘর বললে বেশি বলা হয়। কয়েকখানা টিনের আচ্ছাদন থাকলেও পাটকাঠির জরাজীর্ণ বেড়া, তাতেও বাসা বেঁধেছে উইপোকা, অন্যপাশে পলিথিন দিয়ে বাতাস আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা, দরজা একটা থাকলেও কপাটের কাজ চলে ছেঁড়া একটুকরো লুঙ্গির কাপড় দিয়ে। তার মধ্যেই শীত, গরম, রোদ,বৃষ্টি, ঝড়ে রাজলক্ষ্মীর ছেলে, পুত্রবধূ ও ৩ নাতিপুতি নিয়ে বসবাস। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর গৃহকর্তা কাঙ্গাল কর্মকার সন্তানদের সুখের আশায় ধর্মান্তরিত হয়ে প্রোটেস্টেন্ট খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু দারিদ্রতা তাদের পিছু ছাড়েনি। অশীতিপর বৃদ্ধা রাজলক্ষ্মীর ৮ সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে নিয়ে বৈৎসদা ব্যাপ্টিস্ট চার্চের জায়গায় থাকেন। এক ছেলে ফিরে গেছেন হিন্দু ধর্মে থাকেন সাতক্ষীরায়, বড় ছেলে প্রদীপ কর্মকার বৈবাহিক সূত্রে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এখন তার নাম আব্দুর রহমান , সে এখন পার্শ্ববর্তী নগরকান্দা উপজেলার ছাগলদিতে শ্বশুর বাড়ি এলাকায় কৃষি কাজ করে জীবন ধারণ করেন। তিন কন্যা সুমি, অনক, মালা তাদেরও বিয়ে দিয়েছেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মধ্যে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও প্রতি বছর ছেলে মেয়ে নাতিপুতি আসে বড়দিন উপলক্ষে, ব্যাপ্টিস্ট আয়োজন করে উৎসবের, নাতিপুতি নিয়ে নিজেরাও মেতে উঠে আনন্দে। ছোট ছেলে নানা প্রতিকূলতা, আর শ্রমবিক্রি করে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে পরাস্ত তাদের মনে আনন্দ নেই। চারপাশে বড়দিনের আনন্দযজ্ঞের আবাহনে ভাসলেও রাজলক্ষ্মীর ঘরে যিশু নেই, সান্তা নেই, আশীর্বাদ, আনন্দ নেই। নেই প্রার্থনার উপকরণ ! মাথা গুজার একটুখানি ঠাঁয় থাকলেও এখন শরীরে বেঁধেছে নানা রোগ। খাবার আর ওষধ কিনতে হিমসিম খেতে হয় যাদের প্রতি নিয়ত তাদের বড়দিন আসে উপহাস হয়ে।একে আদিবাসী তারপর খ্রিস্টান পরিবারটি নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত, সরকারি ভাতা বা সুযোগ সুবিধাও পান না তারা।

অশীতিপর বৃদ্ধা রাজলক্ষ্মী কর্মকার বলেন- একসময় ভালোই ছিলাম, এখন শরীরে বেঁধেছে নানা রোগ-ব্যাধি, ছেলেরা পরের কাজ করে, কাজ জুটলে দুবেলা খাই না জুটলে অভুক্ত থাকতে হয়।

সাবেক ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন জানান, পরিবারটি সত্যিই মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের দেখে কষ্ট হয়, সরকার তাদের ভাতা বা অর্থিক সহায়তা করলে একটু মাথা গুজার ঠাঁই করতে পারবে।

দারিদ্রতা, সামাজিক বঞ্চনা, জীবনযাত্রায় নিরন্তর সংগ্রাম করে মানবেতর জীবনযাপন করা পরিবারটির পাশে সমাজের বৃত্তবান বা সরকারের সুদৃষ্টি পড়লে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেত পরিবারটি বলে মনে করেন এলাকাবাসী।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি