image

ঘন কুয়াশা ও সূর্যের লুকোচুরিতে থমকে গেছে জনজীবন

বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫
জেলা বার্তা পরিবেশক, নীলফামারী, প্রতিনিধি, শেরপুর (বগুড়া) ও বেতাগী (বরগুনা)

পৌষের শুরুতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্নস্থানের মতো নীলফামারী, শেরপুর ও বেতাগীতেও জেঁকে বসেছে শীত। শিরশিরে হিমেল হাওয়া, ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। কমে এসেছে দিনের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ব্যবধানও।

নীলফামারীতে শীতের তীব্রতা প্রতিদিনই নতুন মাত্রা পাচ্ছে। ভোর নামলেই পুরো জেলা ঢেকে যাচ্ছে ঘন কুয়াশার সাদা আস্তরণে। সড়ক-মহাসড়ক, হাটবাজার, মাঠ ও খোলা প্রান্তর সবকিছুই চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। সকাল গড়ালেও সূর্যের দেখা মিলছে না। তার ওপর উত্তরাঞ্চলজুড়ে বয়ে যাচ্ছে হিমশীতল বাতাস। এতে জেলার স্বাভাবিক জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। রাত যত গভীর হয়, কুয়াশার ঘনত্ব তত বাড়তে থাকে। অনেকটা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরে পড়ে চারপাশে। ভোরের নীলফামারী যেন নীরবতার চাদরে ঢাকা এক জনপদ। কনকনে ঠান্ডায় বাইরে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক ও কৃষিশ্রমিকদের জীবন পড়েছে চরম অনিশ্চয়তার মুখে। কর্মসংস্থানে ভাটা, আয়ে ধসশীতের প্রকোপে নির্মাণকাজ, সড়ক সংস্কার ও খোলা জায়গার শ্রম কার্যক্রম অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমজীবীদের কাজ কমে এসেছে। এতে তাদের আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

নীলফামারী শহরের রিকশাচালক আব্দুল কাদের বলেন, ভোরে বের হই, কিন্তু এত ঠান্ডা আর কুয়াশায় যাত্রীই থাকে না। আগে যেখানে দিনে হাজার টাকা হতো, এখন পাঁচ-ছয়শ টাকাও কষ্টে হয়।

একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ভ্যানচালক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, হিমেল বাতাসে গাড়ি চালানো খুব কষ্টের। গায়ে গরম কাপড় না থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয় থাকে। কিন্তু কাজ না করলে ঘরে খাবার জোটে না। শিশু ও বয়স্কদের দুর্ভোগ চরমেশীতের তীব্রতায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও বয়স্করা। ঠান্ডাজনিত কারণে অনেক শিশুই সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। স্কুলগামী শিশুদের উপস্থিতিও কমে গেছে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে স্কুলে পাঠাতে অনিচ্ছুক। বয়স্কদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট, বাতের ব্যথা ও জ্বরের সমস্যা বেড়েছে। পর্যাপ্ত গরম কাপড়ের অভাবে অনেক প্রবীণ রাত কাটাচ্ছেন চরম কষ্টে। শীতজনিত রোগে হাসপাতালগুলোতে বাড়তি চাপ, শীত যত বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতেও তত বাড়ছে রোগীর চাপ। জেলা সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিনই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন। শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যাই বেশি। চিকিৎসকদের মতে, এই সময়ে সামান্য অবহেলাও বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে। উষ্ণ পোশাক ব্যবহার, ঠান্ডা এড়িয়ে চলা এবং শ্বাসকষ্ট বা জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। শীতার্তদের পাশে প্রশাসন, তবে চাহিদা আরও বেশিশীতের এই দুর্ভোগ লাঘবে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকায় শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু হয়েছে। ছিন্নমূল, ভাসমান ও দুস্থ মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হলেও স্থানীয়দের অভিযোগ, চাহিদার তুলনায় তা এখনও অপ্রতুল।

নীলফামারী সদর উপজেলার হাড়োয়া এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক অসহায় মানুষ এখনও শীতবস্ত্র পায়নি। ঠান্ডা যত বাড়ছে, মানুষের কষ্টও তত বাড়ছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান জানান, প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে প্রাপ্ত সাড়ে সাত হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ছয় উপজেলায় শীতার্তদের কথা চিন্তা করে ৩৬লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। আরও ৪০হাজার শীতবস্ত্রের চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। দিন দিন শীতের প্রকোপ বাড়ছে। সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবণ যাপন করতে মানুষ যাতে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাহিরে বের না হয় সে বিষয়ে পরামর্শ থাকবে। প্রকৃত শীতার্তদের তালিকা করে পর্যায়ক্রমে আরও শীতবস্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সামনে আরও বাড়তে পারে শীত।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী কয়েক দিন নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। তাপমাত্রা আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে শীতজনিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ঘন কুয়াশা, হিমশীতল বাতাস আর সূর্যের লুকোচুরির মধ্যেই নীলফামারীর মানুষ প্রতিদিন জীবনযুদ্ধে লড়ছে। শীতের এই কঠিন সময়ে সমাজের নিম্ন আয়ের ও অসহায় মানুষের দিকে আরও সহানুভূতিশীল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন সচেতন মহল।

শেরপুরে হাড় কাঁপানো শীত

বগুড়ার শেরপুর সহ উত্তরাঞ্চলে এবার পৌষের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শীত জেঁকে বসেছে। কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহে কাহিল মানুষ। জনজীবনের স্বাভাবিক যাত্রায় পড়েছে ভাটা। কাজে কর্মে নেমে এসেছে স্থবিরতা। এতে পৌষের শীতে শেরপুরবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছে। হিম বাতাস আর কনকনে ঠান্ডার দাপট কখনো তীব্র ঠান্ডা, ঘন কুয়াশা আর মৃদু শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে দৃষ্টিসীমা কমেছে। শেরপুরে ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটছে, হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কুয়াশা না সরায় অনেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। কৃষকরা মাঠে কাজ করতে পারছেন না, দিনমজুররা কাজের সন্ধানে বেরিয়ে হিমেল বাতাসে কাবু হয়ে পড়ছেন। গত দুই তিন দিন থেকে এই অঞ্চলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। সময় যত গড়িয়ে যায় প্রকৃতির চারপাশ যেন ততই হিম বাতাস আর ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত হতে থাকে। এমন বৈরী আবহাওয়ার কারণে গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে নিউমোনিয়া, সর্দি, জ্বর ও কাশিসহ ঠান্ডাজনিত রোগ। এই জনপদের শীতার্ত মানুষের চাহিদার বিপরীতে মিলছে না শীতবস্ত্র।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিন শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় দুস্থদের পাশে দ্রুত সাহায্যের হাত বাড়ানোর দাবি উঠেছে স্থানীয়দের। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার বলেন, এবার শেরপুরে ২২৫০ পিস কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা দু’একদিনের মধ্যেই বিতরণ শুরু করা হবে।

বেতাগীতে কনকনে শীতে কাঁপছে জনজীবন : বরগুনার বেতাগী উপজেলায় কনকনে শীতের তীব্রতায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সকাল থেকেই ঘনকুয়াশা ও হিমেল হাওয়া। কুয়াশার চাঁদরভেদ করে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কয়েকদিন ধরে ভোর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশা আর হিমেল বাতাসে কাঁপছে পুরো এলাকা। শীতের প্রকোপে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু ও বয়স্করা। নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরে শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট যেন আরও বেড়েছে।

বরিশাল আবহাওয়া অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বাতাসের আদ্রতা ছিল ৮১ শতাংশ। তবে হিমেল হাওয়া এবং সেই সাথে ঘনকুয়াশা বলবদ থাকবে আরো কয়েকদিন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোরের দিকে তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। কৃষকরা মাঠে কাজে যেতে দেরি করছেন, শ্রমজীবী মানুষ কাজে বের হলেও শরীর ঢাকার পর্যাপ্ত কাপড় না থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। বিশেষ করে খোলা জায়গায় কাজ করা শ্রমিক ও নদীপাড়ের জেলেরা শীতের কারণে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

ঘনকুয়াশা ও তীব্র শীতে শ্রমিক এবং রিকশা চালকদের উপস্থিতি কম দেখা যাচ্ছে। এবিষয় বেতাগী পৌর শহরের রিকশাচালক বিমল পরামানিক বলেন,’ সংসারের ছেলেমেয়েদের বাজার করতে হবে, এছাড়া কিস্তির টাকার সংগ্রহ করতে হবে। একারণে কনকনে শীতেও রিকশা নিয়ে বের হতে হচ্ছে।

শীতের প্রভাবে বেতাগীর সড়ক ও নদীপথে চলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে। ঘন কুয়াশার কারণে সকালবেলায় যানবাহন চলাচল ধীর হয়ে পড়েছে। অনেক সময় দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে। স্কুলগামী শিশুরাও কুয়াশা আর ঠান্ডার কারণে সময়মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে পারছে না। কিছু অভিভাবক নিরাপত্তার কথা ভেবে শিশুদের স্কুলে পাঠাতে অনীহা প্রকাশ করছেন।

শীতজনিত রোগও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ঠান্ডাজনিত সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক রোগীর চাপ তুলনামূলক বেশি। চিকিৎসকরা প্রয়োজন ছাড়া ভোরে বা রাতে বাইরে বের না হতে এবং গরম কাপড় ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন।

এদিকে শীতের তীব্রতায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরাও। বোরো ধানের বীজতলা ও শীতকালীন সবজি ক্ষেত কুয়াশা ও ঠান্ডায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক সংগঠনগুলো শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিছু এলাকায় কম্বল বিতরণ শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে অভিযোগ রয়েছে। শীতের এই দাপটে দ্রুত আরও বেশি শীতবস্ত্র বিতরণ ও সরকারি সহায়তা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

বেতাগীতে কনকনে শীত এখন জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন সচেতন মহল।

বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: সৈয়্যাদ আমারুল ইসলাম বলেন, প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে ঠান্ডাজনিত সর্দি, কাশি, বুকের ইনফ্লুয়েঞ্জা, জ্বর হতে পারে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় শিশু ও বয়স্কদের গরম খাবার খেতে হবে এবং সবসময় শুকনো কাপড় পড়তে হবে। আক্রান্ত হলে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি