image

দেশি মাছের সংকটে স্থবির ভাঙ্গুড়ার ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি শিল্প

শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রতিনিধি, ভাঙ্গুড়া (পাবনা)

প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়া এবং নির্বিচারে মাছ নিধনের ফলে ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে দেশি মাছ। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি শিল্পে। একসময় বর্ষা শেষে যে শুঁটকি চাতালগুলো কর্মচাঞ্চল্যে মুখর থাকত, এখন সেখানে নেমে এসেছে নীরবতা। দেশি মাছের তীব্র সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ শুঁটকি চাতাল।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নদী ও খাল-বিলের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হওয়ায় জলাশয়ের পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। অপরিকল্পিত বাঁধ, সড়ক ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে অনেক বিল বর্ষা মৌসুমেও পুরোপুরি পানিতে ভরে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চায়না দুয়ারি, বাদাই জালসহ নিষিদ্ধ জাল দিয়ে অবাধ মাছ শিকার। এতে মা মাছের পাশাপাশি রেণু ও পোনা মাছও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ফলে প্রাকৃতিকভাবে মাছের বংশবিস্তার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মৎস্য সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ভাঙ্গুড়ার মুক্ত জলাশয় ও চলনবিল এলাকায় একসময় মাগুর, শিং, পাবদা, টাকি, চিতল, আইড়, বোয়াল, কৈ, গজার, বাইম, শোল, বাঘাইড়, গুলশা, টেংরাসহ ৩০ থেকে ৪০ প্রজাতির দেশি মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে এসব মাছ বিলুপ্তির পথে। বাজারে এখন চাষের মাছ ছাড়া দেশি মাছ প্রায় নেই বললেই চলে।

নদী ও বিলপাড়ের বাসিন্দা আব্দুল জলিল ও দিলবার হোসেন জানান, একসময় বর্ষা মৌসুমে চলনবিলসহ ভাঙ্গুড়ার সব বিল পানিতে থইথই করত। তখন উঁচু জমিতে ফসল আবাদ হতো, আর নদী-খালে চলত মাছ শিকার। সেই মাছ দিয়েই সচল থাকত শুঁটকি চাতালগুলো। ভাঙ্গুড়ার শুঁটকি একসময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের অন্তত ২০টি দেশে রপ্তানি হতো। এখন জলাশয়ে পানি ও মাছ কমে যাওয়ায় সেই রপ্তানি কার্যক্রমেও ভাটা পড়েছে।

সম্প্রতি ভাঙ্গুড়া উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ শুঁটকি চাতাল বন্ধ। মাত্র একটি চাতাল চালু থাকলেও উৎপাদন অত্যন্ত সীমিত। ফলে আয় হারাচ্ছেন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা।

শুঁটকি চাতালের শ্রমিক আলিয়া খাতুন বলেন, “আগে নিয়মিত কাজ ছিল, প্রতিদিন ৩০০–৪০০ টাকা আয় হতো। এখন মাছ না থাকায় বেশিরভাগ দিন কাজই থাকে না। সংসার চালানো খুব কষ্ট হয়ে গেছে।” শুঁটকি ব্যবসায়ী আনছার আলী জানান, আগে নিয়মিত মাছ পাওয়া গেলেও এ মৌসুমে অনেকেই টানা দুই সপ্তাহেও মাছ পাননি। বাধ্য হয়ে অনেক ব্যবসায়ী চাতাল বন্ধ রেখেছেন। তাদের অভিযোগ, চলনবিল এলাকায় অপরিকল্পিত পুকুর খনন ও অবৈধ জাল ব্যবহার পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।

ভাঙ্গুড়ার কলকতি শুঁটকি চাতালের মালিক মো. দুলাল হোসেন বলেন, দিলপাশার, পুইবিল, আদাবাড়িয়া, বাশবাড়িয়া ও দত্তখারুয়া বিলে একসময় প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। এখন চায়না দুয়ারি জালে মা মাছসহ সব ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে শুঁটকি উৎপাদন টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে ভাঙ্গুড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলী আজম বলেন, নিষিদ্ধ জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ নিধন এবং বৃষ্টি কম হওয়ায় জলাশয়ে পানি ও মাছ দুটোই কমেছে। অন্যান্য বছর যেখানে তিনটি শুঁটকি চাতাল ছিল, সেখানে এবার রয়েছে মাত্র একটি। গত বছর ১৩ টন শুঁটকি উৎপাদন হলেও এ বছর ৫ থেকে ৭ টনের বেশি উৎপাদন হওয়া কঠিন।

তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধ জাল বন্ধ, জলাশয়ের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা এবং মৎস্যজীবীদের সচেতন করতে নিয়মিত অভিযান ও আইন প্রয়োগ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি