শিল্প বর্জের অব্যবস্থাপনায় চির সবুজ ভালুকার বুক চিরে বয়ে চলা খীরু নদীর মিঠা পানি বছরের পর বছর বিষাক্ত ক্যামিকেলের দহনে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রে নেমে এসেছে নিরব স্থবিরতা। যার প্রভাবে কৃষকের ক্ষেতের ফসল, জেলের জীবিকার উৎস্য মৎস্য সম্পদ,পশু পাখী ও বিভিন্ন প্রাণী কুলের জীবন হুমকির সম্মুখীন। প্রকৃতি হতে সম্পুর্ণ বিলুপ্ত হচ্ছে জল ও ডাঙ্গায় জীবন নির্ভর নানা প্রজাতির মিঠা পানির মৎস্য সম্পদ ও পশু পাখি। অপর দিকে খীরু নদীর দুই পাড়ের শত শত একর ফসলী জমিতে বর্জ মিশ্রিত বিষাক্ত কালো পানি সেচ দেওয়ার কারনে জমির উর্বতা শক্তি নষ্ট হয়ে ফসল উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন ডাইং ফ্যাক্টরী হতে বছরের পর বছর অবিারম কেমিক্যাল মিশ্রিত গরম বর্জ পানি লাউতি, বেতিয়াহাঙ্গুন, বিলাইজুরি,বাঘ সাতরা, রুপির খাল দিয়ে খীরু নদীতে নামায় নদীর পানি কালো হয়ে বিষাক্ত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এসব বর্জ মিশ্রিত পানি খাল বিলে প্রবাহিত হওয়ায় মৎস্য সম্পদ ও জলজ প্রাণীর বিনাশ,পশুপাখির ক্ষতি সাধন,পানি বাহিত পেটের পীড়া, চর্মরোগ বিস্তার ও ফসলের ক্ষেতে সেচ ব্যবস্থার চরম অবনতি সহ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। বিষাক্ত পানির কারনে প্রতি বছর বোরো আবাদ করে কাংখিত ফসল উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছেন এলাকার কৃষকরা। উপজেলার ভালুকা, ভরাডোবা, মেদুয়ারী ও হবিরবাড়ী ইউনিয়নের জামিরদিয়া ও কাশর এলাকার অসংখ্য ডাইং মিল থেকে বিরামহীন দুর্গন্ধযুক্ত ঘন কালোপানি লাউতি সহ বিভিন্ন খাল দিয়ে খীরু নদীতে নামায় পানি বিষাক্ত হয়ে মাছ সহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর বিলুপ্তি সহ নষ্ট হচ্ছে কৃষকের ক্ষেতের ফসল। খীরু নদীর মিঠা পানিতে এক সময় গ্রামের দুরন্ত ছেলে মেয়েরা সাঁতার কাটতো। জেলে সম্প্রদায় দলবেঁধে জীবিকার উৎস হিসেবে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকতেন। পানি দূষনে খীরু নদীর মাছ সম্পুর্ণ বিলুপ্ত হওয়ায় জেলেরা এখন পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। পানি দুর্গন্ধযুক্ত ও বিষাক্ত হওয়ার কারনে কৃষকরা গবাদি পশু নিয়ে এখন আর পানি খাওয়াতে কিংবা গোসল করতে নদীতে নামছেন না।
দীর্ঘদিন শিল্প বর্জের কারনে খীরু নদীতে বিলুপ্ত হয়েছে রুই, কাতল, বোয়াল, কাচকি, চাপিলা, পাবদা, বাইলা, চিংড়ি, মলা, ঢলা, টেংরা, গুলসা, বাছা, ইংলা ইত্যাদি। প্রাণীর মধ্যে শুসক, গুইসাপ, কচ্ছপ, উদ প্রভৃতি জলজ প্রাণী। নদীর বুকে ভাসমান হিজল গাছে বসে থাকা গাংচিল, কানিবক, সাদা বক, ডুব দিয়ে মাছ ধরা পানকৌরি, জলের উপর ভেসে চলা বালিহাঁসের ঝাক,হট্রিটি, উপর হতে নিশানা করে জলে পড়ে মাছ ধরা শিকারী পাখি মাছরাঙা সবই হারিয়ে গেছে নদীতে মাছ না থাকার কারনে। এক সময় বর্ষা এলে নদীর বুকে পালতোলা নৌকার মাঝিদের দাঁড় টানা আর যাত্রীবাহী লঞ্চের ভেঁপুর শব্দ শোনে ছোট ছেলে মেয়েরা পাড়ে এসে ভীড় করতো। এ ঘাট ও ঘাট ভেসে বেড়াতো ছোট ছোট বেদে নৌকার সাড়ি। ৮০,র দশক হতে শিল্প বর্জ নদী দূষন ও নাব্যতা হ্রাসের কারনে খীরু নদীর গভীরতা কমতে শুরু করায় নৌযান ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়রা জানায় বর্তমানে নদীর কিনার সহ খাল বিলের ধানি জমির মাটি আলকাতরার মত কিচকিচে কালো হয়ে গেছে। এসব কালো পানির জমিতে নামলে হাঁটু পর্যন্ত কাদার নীচে গেড়ে যায়। কিছুক্ষনের মধ্যে হাত পা ও শরীরে চুলকানি ও ফুসকার মত পরে। এর ফলে নানা রকম চর্ম রোগের সৃষ্টি হয়। এসব কারনে সময়মত জমি চাষ ও ধান রোপন করার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায়না।
ভালুকার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খীরু নদীর উভয় পাড়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার জুরে বিভিন্ন গ্রামে বোরো ধান সহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে নদী হতে বহু বছর যাবৎ দমকলের সাহায্যে পানি সেচ দিয়ে প্রচুর ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব এলাকার কৃষকদের অভিযোগ গত কয়েক বছর ধরে খীরু নদীতে বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরী হতে দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত কালো পানি নামায় ব্যবহারের অনোপযোগী হয়ে পরেছে। বাধ্য হয়ে ফসলের জমিতে নদীর বিষাক্ত পানি সেচ দিতে হয়। কিন্তু তাতে ধানের গোছা ভাল হলেও থোর বের হওয়ার পর ধান চিটা হয়ে যায়। অপরদিকে দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ পানি খেয়ে প্রায়ই হাঁস, গরু ছাগল মারা যায়। হবিরবাড়ী এলাকার বিলাইজুড়ি ও লাউতি খাল দিয়ে বিভিন্ন ডাউং ফ্যাক্টরী হতে দুর্গন্ধযুক্ত কালো রংয়ের গরম পানি দিন রাত প্রবাহিত হয়। খালের আশ পাশের বাড়ী ঘরের মানুষ দুর্গন্ধে অতিষ্ট। এসব এলাকার শিশুরা নানা রকম পেটের পীড়া সহ প্রায়ই বিভিন্ন জটিল রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
অধিকাংশ ডাইং ফ্যাক্টরীতে ইটিপি থাকলেও সেগুলি সচল না রেখে অপরিশোধিত বর্জপানি সরাসরি কারখানার পাইপ দিয়ে খাল বিলে ছেড়ে পরিবেশ ধংস করছে। আর পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ নিজেদের কালো চশমার আড়ালে রাখায় ফ্যাক্টরী কর্তৃপক্ষ খাল বিল নদী নালা সহ সারা এলাকা নিজের মনে করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে মাঝে মধ্যে পরিবেশ কর্তৃপক্ষ অভিযানে আসলে ইটিপি চালু করে তাদেরকে দেখানো হলেও পরবর্তীতে ইটিপি বন্ধ রেখে অপরিশোধিত বর্জ পানি খাল বিল নদী নালায় ফেলা হয় সারা বছর।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার সদস্য সচিব কামরুল হাসান পাঠান কামাল(সাংবাদিক) জানান “ হবিরবাড়ীর লউতি, বিলাইজুড়ি, ভালুকা কাঠালীর বেতিয়া হাঙ্গুন সহ অসংখ্য সংযোগ খাল দিয়ে খীরু নদীতে বিভিন্ন ডাইং মিল হতে দূষিত বর্জ ফেলা হচ্ছে যেটিকে তিনি পরিবেশে নৈরাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন, তার মতে পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে এসব ডাইং ফ্যাক্টরী গুলি ইটিপি সচল না রেখে সরাসরি কারখানার বর্জ নদীতে ফেলে পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে। তিনি আরও জানান পরিবেশ রক্ষায় মিল ফ্যাক্টরীর দূষিত বর্জ পানি বন্ধের দাবীতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপার) উদ্যোগে একাধিকবার ভালুকায় মানব বন্ধন কর্মসূচী পালন ও স্বারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেননি।
মিল কারখানা হতে ইটিপির মাধ্যমে বর্জ পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেললে যেমন কৃষিকাজে সেচ উপযোগী হবে তেমনি দেশীয় প্রজাতির মাছ গুলির বংশ বিস্তার সহ জীব বৈচিত্র রক্ষা পাবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি সচেতন মহলের দাবী মিল কারখানার বর্জপানি নদীখালে ফেলা বন্ধ হলে সবুজ শ্যামল ভালুকার পরিবেশে পুনরায় প্রাণ ফিরে আসবে। ক্ষেতের ফসলে কৃষকের গোলা আর দেশীয় মাছে ভরে উঠবে নদী নালা খাল বিল।