শীতের কুয়াশা আর ঠান্ডা হাওয়ার ভেতর দিয়েই রাজশাহীর আমবাগানে উঁকি দিচ্ছে নতুন জীবনের আভাস। ডালের আগায় আগায় ফুটে ওঠা কচি মুকুল যেন প্রকৃতির নীরব প্রতিশ্রুতি আসছে সুদিন। পদ্মাপাড়ের মাটিতে আবারও আশার বীজ বুনছেন আমচাষিরা। ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে পা রেখে, কাঁধে স্প্রে মেশিন ঝুলিয়ে তারা আগলে রাখছেন এই মুকুল, কারণ এই কচি ফুলের বুকেই লুকিয়ে আছে পুরো মৌসুমের স্বপ্ন, ঘাম আর সম্ভাবনার গল্প।
রাজশাহীর আম শুধু একটি ফল নয় এটি একটি অঞ্চলের অর্থনীতির হৃদস্পন্দন। শীতের কুয়াশা ভেদ করে গাছে গাছে যে আগাম মুকুল দেখা দিচ্ছে, তা কেবল মৌসুমের আগাম সংকেত নয়; এটি গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়ানোর পূর্বাভাস। এই মুকুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো চাষির পুঁজি, শ্রমিকের কর্মসংস্থান, পরিবহন-বাণিজ্য আর বাজারের বিশাল অর্থপ্রবাহ। পদ্মাপাড়ের প্রতিটি আমবাগান যেন এক একটি জীবন্ত শিল্পকারখানা যেখানে প্রকৃতি ও পরিশ্রম মিলেমিশে তৈরি করে বড় অর্থনীতির নীরব ভিত্তি।
রাজশাহী অঞ্চলে এবার নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই আম-মৌসুমের আভাস মিলতে শুরু করেছে। শীত ও কুয়াশার মধ্যেই দেশি ও নানা উন্নত জাতের আম গাছে মুকুল উঁকি দিতে শুরু করেছে। বিশেষ করে রাজশাহীর পবা উপজেলার বিভিন্ন আমবাগানে আগাম মুকুলের উপস্থিতি চোখে পড়ছে। চাষিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আশার আলো। এর ফলে আমচাষিদের মধ্যে যেমন উৎসাহ বেড়েছে, তেমনি মুকুল রক্ষায় পরিচর্যার ব্যস্ততাও লক্ষ করা যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনের ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডার কারণে মুকুলে ছত্রাক আক্রমণের আশঙ্কা থাকায় চাষিরা সকাল-দুপুর ধরে বাগানে সময় দিচ্ছেন। গাছের গোড়ায় সেচ, সার প্রয়োগ এবং কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করছেন তারা। দেশি আমের পাশাপাশি বারী-৪, বারী-১১, আমরুপালি, আশ্বিনা ও ল্যাংড়া জাতের গাছে আগাম মুকুল দেখা গেছে। যদিও এখনো পুরোপুরি মুকুলে ভরে ওঠেনি বাগান, তবুও গাছে গাছে ছোট ছোট মুকুলের উপস্থিতি এবারের মৌসুমকে ঘিরে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।
সরেজমিনে পবা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ও নগরীর পদ্মা নদীর পার্শ্ববর্তী শিমলা পার্ক সংলগ্ন আমবাগানে গিয়ে দেখা যায়, চাষিরা স্প্রে মেশিন কাঁধে নিয়ে সারি সারি গাছে পানি ও কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কেউ কেউ গাছের গোড়া পরিষ্কার করছেন, আবার কেউ আগাছা দমন ও মাটি আলগা করতে ব্যস্ত। চাষিদের ভাষ্য, আগাম প্রস্তুতি না নিলে মুকুল ঝরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই মুকুল আসার আগেই তারা পরিচর্যা জোরদার করেছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলায় আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯ হাজার ১৮৮ হেক্টর জমিতে। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৬ মেট্রিক টন আম। এর আগের অর্থবছরে রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন। সে হিসেবে এবছর সামান্য কম লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আগাম মুকুল ও চাষিদের প্রস্তুতি ভালো ফলনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, মাঠপর্যায়ে আমের ভালো উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। একটি আমগাছে বছরে অন্তত দুইবার কীটনাশক প্রয়োগ প্রয়োজন। আমাদের সহকারী ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। গত বছর হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ছিল ১২ দশমিক সাড়ে ৭ মেট্রিক টন। চলতি বছরে আমরা হেক্টর প্রতি ১২ দশমিক ৮ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। সে অনুযায়ী এবছর উৎপাদন ভালো হবে বলে আশা করছি, বলেন তিনি।
পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এম এ মান্নান বলেন, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৯২৫ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৪৮৭ মেট্রিক টন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। কৃষকরা আগে থেকেই সচেতন হয়ে বাগানের পরিচর্যা শুরু করেছেন। কিছু গাছে সবে মাত্র মুকুল দেখা দিতে শুরু করেছে। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব না পড়লে এবার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজশাহীর আমবাগানে ফুটে ওঠা এই আগাম মুকুল কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য নয় এটি গ্রামীণ অর্থনীতির নীরব প্রত্যাশা। প্রতিটি মুকুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চাষির পুঁজি, শ্রমের মূল্য আর বাজারের ভবিষ্যৎ হিসাব। যথাযথ পরিচর্যা, সময়মতো দমন আর অনুকুল আবহাওয়া মিললে এই কচি মুকুলই রূপ নিতে পারে সোনালি ফলনে। তখন রাজশাহীর আম শুধু স্বাদে নয়, জীবিকার শক্ত ভিত্তি হয়ে আবারও জাগিয়ে তুলবে হাজারো পরিবারের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: ২৯-৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ডিজিটাল ডিভাইস অ্যান্ড ইনোভেশন এক্সপো ২০২৬
সারাদেশ: বেদে সম্প্রদায়ের মানবেতর জীবনযাপন
আন্তর্জাতিক: উত্তর কোরিয়ায় বিরল পর্যটন, রাশিয়ার এক নারীর অভিজ্ঞতা