image

বর্ণাঢ্য জীবন: গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ, দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী একটি নাম খালেদা জিয়া। তার রাজনৈতিক জীবন, সংগ্রাম ও শাসনকাল ছিল বর্ণাঢ্য। তিনি তার সমর্থকদের কাছে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্ম অবিভক্ত দিনাজপুরের জলপাইগুড়িতে, ১৯৪৫ সালে। তার পারিবারিক নাম খালেদা খানম, ডাক নাম পুতুল। বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের আদি নিবাস ছিল ফেনী জেলায়, মা তৈয়বা বেগমের (তৈয়বা মজুমদার) জন্ম পঞ্চগড় জেলায়।

ইস্কান্দার মজুমদার ১৯১৯ সালে ফেনী থেকে জলপাইগুড়িতে যান। ১৯৩৭ সালে জলপাইগুড়িতে তিনি তৈয়বা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন পর তারা দিনাজপুর শহরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে মিশনারি স্কুলে প্রাথমিকের গ-ি পেরানোর পর দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন খালেদা জিয়া।

দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে খালেদা জিয়া তৃতীয়। ভাইবোনদের মধ্যে খুরশীদ জাহান হক এবং সাঈদ ইস্কান্দার মারা গেছেন। সেলিনা ইসলাম ও শামীম ইস্কান্দার এখনও জীবিত।

দাম্পত্য জীবন

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি হন খালেদা জিয়া, ছিলেন গৃহবধূ। স্বামীর সংসার সামলাতেন। পরে পরিচিত হলেন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে যখন জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি হলেন।

জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। মাত্র ২১ বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে ৩৬ বছর বয়সে খালেদা জিয়া বিধবা হন।

এই দম্পতির দুই ছেলে। বড় ছেলে তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালে। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম ১৯৭০ সালে। কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়াতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

রাজনৈতিক জীবন

খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সরাসরি সক্রিয় হন বিএনপি নেতাদের একাংশের প্রচেষ্টায়, ১৯৮১ সালে স্বামী নিহত হওয়ার পর। দলে ঢুকে কয়েক ধাপ পেরিয়ে তিনি ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। নেতৃত্ব দেন সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে। আশির দশক পুরোটাই তার সময় গেছে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে টানা আন্দোলনে নেতৃত্বের সময় একাধিকবার গৃহবন্দী, সভা-সমাবেশে বাধা, মামলা ও নিপীড়নের শিকার হন খালেদা জিয়া। আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন সেই সরকারে সময়ই সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী শাসিত বা ‘সংসদীয় পদ্ধতির’ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়।

তার শাসনকালেই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত হয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের বর্জনের মুখে নির্বাচন করে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন খালেদা জিয়া।

পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিরোধী দলের আসনে বসেন। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন নানা ইস্যুতে। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন হলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চার দলীয় জোট জয়ী হয়। যে জোটে শরিক ছিল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্য জোট।

২০০১-২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে কিছু অগ্রগতি হয়েছিল। তবে জঙ্গিবাদের উত্থান ও রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে সমালোচনা হয়। রাজনৈতিক তীব্র সংকটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে খালেদা জিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্যে রাষ্ট্রপতিই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন।

মুক্তি পেয়ে ২০০৮-এর নির্বাচনে তার দল অংশ নিলে কম আসনে জয়ী হয়ে আবার বিরোধী দলের আসনে বসেন।

অপরাজিত নেত্রী

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়া সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো হারেননি। ১৯৯১-২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট ২৩টি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করে সবকটিতেই জয়লাভ করেছেন। চার দশকের বেশি সময় তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিন দফায় দশ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।

মঈনুল রোডের বাড়ি

১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হওয়ার পর ঢাকা সেনানিবাসের মঈনুল রোডের বাড়িটিতে বসবাস শুরু করেন। এরপর সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালেও তিনি এ বাড়িতেই ছিলেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সে সময়ের জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্তে বার্ষিক এক টাকা খাজনার শর্তে বাড়িটি খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেয়া হয়। সেই থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই বাড়িই ছিল খালেদা জিয়ার হাসি-কান্না ও সংগ্রামের সাক্ষী।

জীবনের ৩৯ বছর এই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বাড়িতে জড়িয়ে ছিল স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতি। আর সন্তানদের বেড়ে ওঠার গল্প।

নবম সংসদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বহুকালের অনেক স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের সেই বাড়ি থেকে তাকে উচ্ছেদ করা হয় ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর। গণমাধ্যমের সামনে সেদিন তাকে অশ্রুসজল অবস্থায় দেখেছিল দেশবাসী।

গ্রেপ্তার

সেনাশাসক এরশাদের সময় খালেদা জিয়াকে একাধিকবার নজরবন্দী ও গৃহবন্দী করা হয়েছিল। ১/১১ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংসদ ভবনের পাশে একটি ভবনকে সাব-জেল ঘোষণা করে সেখানে রাখা হয় খালেদা জিয়াকে। এক বছর পর ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পান তিনি। ওই সময় তারেক রহমান মুক্তি পেয়ে লন্ডনে চলে যান।

নির্বাচন বর্জন

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি সংসদের বাইরে চলে যায়, রাজপথই হয় দলটির ঠিকানা। তবে বছরের পর বছর আন্দোলন চালিয়েও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হঠাতে পারেনি খালেদা জিয়ার দল।

২০১৫ সালের শুরুতে টানা তিন মাসের হরতাল অবরোধে পেট্রোল বোমার আগুন সন্ত্রাসের জন্য বিএনপিকে দায়ী করে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার।

ওই বছরই খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যু হয়, যা ছিল তার জন্য বড় ধাক্কা। সেই বৈরী সময়ে বড় ছেলে তারেক রহমানও দেশে ফিরতে পারেননি। দেশে একাকী সেই কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে।

রাজনৈতিকভাবে সেই চাপের সময়ে খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় একের পর এক মামলা। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে কারাগারে পাঠায় আদালত। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাতেও তার সাজার রায় হয়।

বন্দী জীবন

কারাবন্দী খালেদা জিয়া, সাজা খাঠছিলেন। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় ২০২০ সালের ২৫ মার্চ অনেকটা আকস্মিকভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়। শর্তানুযায়ী তাকে থাকতে হয় গুলশানের বাসায়, বিদেশে যাওয়ার অনুমতিও তার ছিল না।

ফলে মুক্তি পেয়েও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রকার বন্দী জীবন কাটতে থাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের। এর মধ্যে কয়েকবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

মুক্তি ও চিরবিদায়

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। মুক্তি পেয়ে দেশবাসীর প্রতি শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। পরে উচ্চ আদালত খালেদা জিয়াকে দুই মামলা থেকেও খালাস দেয়। উচ্চ আদলতের রায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে যে সাজা দেয়া হয়েছিল তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।

খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, পশ্চিমা বিশ্বে তা ‘দুই নারীর লড়াই’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। গত সাত বছর- প্রথমে কারাগারে থাকার কারণে ও পরে অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়া সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হয়েছিল। তার স্বাস্থ্য অনেকটা উন্নত হয়েছিল। তবে নানাবিধ রোগের জটিলতা ও শরীর-মনে অনেক ধকল সহ্য করে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। প্রায়ই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন। হাসপাতালে ভর্তিও করানো হতো।

সর্বশেষ গত ২১ নভেম্বর ঢাকায় সেনা সদরের সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল খালেদা জিয়াকে। তার দুই দিনের মাথায় ২৩ নভেম্বর তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হলেও শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।

এরমধ্যে তারেক রহমান দীর্ঘ নির্বাসন ভেঙে গত ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন; হাসপাতালে যান মাকে দেখতে। এর পাঁচ দিনের মাথায় মঙ্গলবার, (৩০ ডিসেম্বর ২০২৫) ভোরে খালেদা জিয়া চিরবিদায় নেন। আজ বাদ জোহর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় জানাজা শেষে জিয়া উদ্যানে স্বামীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

» অপহরণ মামলার সূত্র ধরে মাথাবিহীন লাশের রহস্য উদ্ঘাটন

» চান্দিনায় হাত-পা-মুখ বেঁধে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণ

» পটুয়াখালীর বাউফলে শ্রমিকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

» ট্রেনে নাশকতার দুই মামলায় গ্রেপ্তার ৩ জন

» বুধবার অতিরিক্ত ট্রেন চলাচল করবে: মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ

» নিকলী হাওড়: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মৎসসম্পদের সুরক্ষা জরুরি

সম্প্রতি