image

দুই ভাই ঢাকা থেকে ফিরে গ্রামেই দিল রশি তৈরির কারখানা

বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
জেলা বার্তা পরিবেশক, মুন্সিগঞ্জ

ঢাকার মুন্সিগঞ্জে দীর্ঘ ১৫ বছর রশি তৈরির কারখানার অভিজ্ঞতাকে পূঁজি করে দুই ভাই এবার নিজের গ্রামেই স্থাপন করলেন রশি তৈরির কারখানা। তাদের এই উদ্যোগ সারা ফেলেছে পুরো এলাকায়। আর্থিক সংকট এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সমস্যার পরও থেমে থাকেনি তাদের যুদ্ধ। প্রচন্ড জেদ আর সাহস তাদের এই কাজকে সহায়ক শক্তি হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটু পুঁজি পেলেই পাল্টে যেতে পারে তাদের কারখানার উৎপাদন ও চেহারা।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত রাজবল্লভ দক্ষিণপাড়া গ্রাম। উপজেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে তিস্তা নদী তীরবর্তী গ্রাম এটি। এই গ্রামের নুর মোহাম্মদের দুই ছেলে নজির হোসেন ও নুর আলম। কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে মুন্সিগঞ্জে একটি রশি তৈরির কারখানায় চাকরী নেন দুই ভাই। নজির হোসেন অপারেটর হিসেবে এবং নুর আলম ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে। সেখানেই কেটে যায় তাদের ১৫টি বছর। এক সময় তাদের মনে হয় নিজেরাই গ্রামের মধ্যে এই ধরণের কারখানা খুলে উদ্যোক্তা হতে পারেন। সেই মনোবল নিয়ে দুই ভাই নিজেদের জমানো টাকা এবং পিতার জমি বন্দকের টাকা দিয়ে ৫টি মেশিন ও কাচামাল কিনে শুরু করেন বিভিন্ন বাহারি রঙের রশি তৈরির কাজ। ইতিমধ্যে কেটে গেছে দুটি বছর। এখন ১৫টি মেশিন চলছে তাদের কারখানায়। কাজ করছে ৪ থেকে ৬জন নারী শ্রমিক। জেলায় এ ধরণের এটি প্রথম উদ্যোগ।

নারী শ্রমিক রোশনা জানান, এই কাজ নেয়ার ফলে সংসারে ফিরে এসেছে স্বস্থি। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করতে পারছে। স্বামীদেরও সাহায্য হচ্ছে। অপর নারী শ্রমিক হোসনা বেগম জানান, আমাদের এখানে কোন কাজ ছিল না। কারখানা হওয়াতে আমাদের ভীষণ উপকার হয়েছে। আগে বাড়িতে বসে ছিলাম, এখন কাজ করে টাকা পাচ্ছি, সেটা দিয়ে নিজের স্বাদ-আহ্লাদ মেটাতে পারছি। ভালো জিনিস কিনে খেতে পারছি। সন্তানদের পছন্দের খেলনা-কাপড় কিনে দিতে পারছি।

উদ্যোক্তা নজির হোসেন জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার মুন্সিগঞ্জে একটি রশি তৈরির কারখানায় কাজ করার ফলে রশি তৈরির খুটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে বিষদ ধারণা পাই। মেশিনগুলোতে কিভাবে কাচামাল সেটআপ করতে হবে, কিভাবে মেশিন চালু অবস্থায় সমস্যা হলে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করতে হবে সেই অভিজ্ঞতাগুলো অর্জন করি। এছাড়াও মেশিনে কি কি পার্টস লাগে, নষ্ট হলে কিভাবে ভালো করতে হয় সে সম্পর্কেও জানতে পারি। তাছাড়া কোথা থেকে কাচামাল কিনতে হবে, কিভাবে উৎপাদিত মালামাল প্যাকেটিং করে ডেলিভারী দিতে হবে; সব কাজ নিজেরাই করেছি। আমার ভাই ইলেকট্রিশিয়ান হওয়াতে কতটা মেশিনের জন্য কতটুকু পাওয়ার লাগবে এবং মেশিন নষ্ট হলে সেগুলো ভালো করার অভিজ্ঞতা আমাদের মধ্যে সাহস যুগিয়েছে। মনে হয়েছে আমরা দীর্ঘদিন ধরে একই ধরণের কাজ করলাম।এবার সময় এসেছে নিজেদের একটা ফ্যাক্টরী খোলার। সেই মানসে ঈদের ছুটি-ছাটায় বাড়িতে আসলে বাবার সাথে বসে আমাদের পরিকল্পনার কথা শেয়ার করি। এতে বাবাও উৎসাহি হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ আমরা বাবাসহ বসে কোথায় কারখানা দিবো, মেশিন ও কাচামালসহ কত খরচ হতে পারে সে বিষয়ে আর্থিক পরিকল্পনা করি। যখন আমরা দশ লক্ষ টাকা পূজি সংগ্রহ করি তখন আমরা কারখানার জন্য বাড়ির ভিতরে উত্তর দিকে বড় একটি ঘর নির্মাণ করি। এরপর আর্থিক সামর্থ বিবেচনা করে ৫টি মেশিন দিয়ে কারখানা চালু করি।

কিছুটা হতাশ নজির হোসেন আরও জানান, বর্তমানে আমাদের ১৫টি মেশিন চালু আছে। ৩৫ থেকে ৪০টি মেশিন হলে উৎপাদন বাড়বে, খরচ কমে যাবে আমাদেরও লাভ হবে। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে মেশিন ও মালামাল কিনতে পারছি না। বর্তমানে অনেক কষ্ট করে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ থেকে কাচামাল সংগ্রহ করছি। উৎপাদিত মালামাল স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা হচ্ছে। এখন বড় সমস্যা হল নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৬ ঘন্টা বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রমিকরা বসে থাকে, এতে কাজের ক্ষতি হয়। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ক্ষুদ্র ঋণের জন্য সহযোগিতা চাইলেও পাইনি। কিছুটা মুলধন পেলে এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি হলে বড় আকারে কারখানা বৃদ্ধি করার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সেটা পারছি না।

দুই উদ্যোক্তাদের পিতা নুর মোহাম্মদ জানান, আমার ছেলে দুটো খুবই বুদ্ধিমান। তারা যে কোন জিনিস দেখে সেটা তৈরি করার ক্ষমতাও রাখে। যেহেতু মেশিনারিজের কাজ তারা ভালো পারে, সেই সাহসে জমি বন্দক রেখে কারখানার কাজ শুরু করা হয়। এখনো যেভাবে লাভ না হচ্ছে না। আরো মেশিন হলে উৎপাদন বাড়বে, এতে লাভও বেশি হবে। আর্থিক কারণে আমরা এগুতে পারছি না।

উলিপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্মণ সেন গুপ্ত জানান, আমাদের উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় দুই ভাই যে উদ্যোগ নিয়েছেন এজন্য তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহে সহযোগিতা করলে এবং কিছুটা পুজি পেলে এমন উদ্যোক্তা আরো সৃষ্টি হবে। মিলবে কর্মসংস্থান।

এ ব্যাপারে উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, আমি নতুন এসেছি। আগে খোঁজখবর নেই, তারপর কি ধরণের সহযোগিতা করা যায়, দেখবো।

সম্প্রতি