কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নটি দুই দশক আগে ফুলের গ্রাম হিসেবে বেশ পরিচিত পেয়েছে। এক সময় কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া এই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের দুইশ’ একর জমিতে গোলাপের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো দুই শতাধিক কৃষক পরিবার। বাগান ছিল দুইশ’র বেশি।
জাতীয় দিবসগুলোতে আগের মতো চাহিদা নেই কাঁচা গোলাপ ফুলের
বছরে নষ্ট হচ্ছে ৩০ লাখ গোলাপ
এখন প্লাস্টিক আর কাগজের ফুলের দাপটে সেই ফুলের গ্রাম বরইতলীতে কমে গেছে গোলাপ চাষ। বাগানের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৭২টিতে। কমেছে ফুল চাষের জমির পরিমাণও।
ফুল চাষিদের দাবি, আগেকার সময়ে জাতীয় দিবস বিশেষ করে পহেলা জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ ও বসন্ত, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বরইতলী বাগানের কাঁচা গোলাপের প্রচুর চাহিদা ছিল। এখানকার বাগানের গোলাপসহ রকমারি ফুল সরবরাহ হতো চট্টগ্রামের চেরাগীপাহাড় ছাড়াও কক্সবাজারের বিভিন্ন মোকামে।
কিন্তু বছর দেড়েক ধরে আর জাতীয় দিবসগুলোতে আগের মতো এখানে উৎপাদিত কাঁচা গোলাপসহ রকমারি ফুলের ব্যবহার হচ্ছে না। কালেভদ্রে যা ব্যবহার হচ্ছে, সবই প্লাস্টিক আর কাগজের ফুল। এমন পরিস্থিতিতে চাষ করেও ফুল বিক্রি করা যাচ্ছে না। তাতে গাছের গোলাপ নষ্ট হচ্ছে গাছেই। এভাবে প্রতিটি গোলাপ বাগানের মালিকই লোকসান গুনেছেন হরহামেশা।
বাগান মালিকরা জানান, গোলাপ ফুলের বাজার কয়েক বছর ধরে দখলে রেখেছে কাগজের ফুল ও চীনা গোলাপ। গোলাপ একবার ব্যবহারের পর নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কাগজের ফুল বা চীনা গোলাপ ৪-৫ বার ব্যবহার করা যায়। বিয়ে-শাদি, সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রশাসনিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের মঞ্চ সাজানো থেকে ঘরবাড়িজুড়ে এখন কাগজের ফুলের ব্যবহার বেড়েছে। তাছাড়া গাছে গোলাপ ফুটলে কেটে ফেলতে হয়। পরিপক্ক গোলাপ একদিনের বেশি রাখা যায় না। বাগান মালিকরা বলছেন, বিশেষ কিছু দিবসে ন্যায্যমূল্যে গোলাপ বিক্রি হলেও অধিকাংশ চাষি সারা বছর লোকসান দিয়ে ফুল বিক্রি করেন। ক্রেতার অভাবে শতাধিক বাগান থেকে নষ্ট হয় ৩০ লাখের বেশি গোলাপ।
গোলাপ চাষিরা জানিয়েছে, দুই বছর আগেও বরইতলী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় দুইশত একর জমিতে অন্তত ২১২টি গোলাপের বাগান ছিল। এখন জমির পরিমাণ কমেছে, বাগানও অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগের মতো বেচা-বিক্রি নেই বলে এসব বাগান থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার গোলাপ কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে। এখন অনেক চাষি লোকসান থেকে বাঁচতে গোলাপ ফুলের চাষ ছেড়ে তামাক চাষসহ অন্যান্য চাষে ঝুঁকছেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বরইতলী ইউনিয়নের একতাবাজারের দক্ষিণে দুই বছর আগে যেসব জমিতে গোলাপের চাষ হতো, সেখানকার বেশিরভাগ জমিতে সবজি ও ধান চাষ করা হয়েছে। একইভাবে উপরপাড়া, নামারপাড়া, খয়রাতিপাড়া, বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা, মাইজপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় তামাক চাষের বিস্তার ঘটেছে। অথচ আগে এসব জমিতে গোলাপের চাষ হতো।
বরইতলী গোলাপবাগান মালিক সমিতির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম বলেন, দুই বছর আগেও প্রায় ২০০ একর জমিতে গোলাপের চাষ হতো। এখন সেখানে প্রায় ৯০ একরে ৭২টি গোলাপের বাগান করা হয়েছে। বেচাবিক্রি না থাকায় প্রতিদিন এসব বাগান থেকে ফুটন্ত গোলাপ কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে। এভাবে বছরে ৩০-৩৫ লাখ গোলাপ ফুল বাগান থেকে ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা।
মঈনুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, এখন কাঁচা গোলাপ ফুলের বাজার দখল করেছে কাগজের ফুল ও চায়না প্লাস্টিকের ফুল। কাঁচা গোলাপ একবার ব্যবহারের পর আর ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু কাগজের ফুল অন্তত ৪-৫ বার ব্যবহার করতে পারে। বিয়ে-শাদি, সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন কাগজের ফুল ব্যবহার হচ্ছে বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে ধারণা করা হচ্ছে, গোলাপ বাগানের মালিকরা এভাবে লোকসান দিতে দিতে একদিন বরইতলীতে তামাক চাষ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তাতে বিলুপ্ত ঘটবে ফুলের গ্রাম উপাধি পাওয়া সেই খ্যাতি।