ঋণখেলাপিদের একে একে চারবার পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। তিনি বলেছেন, ‘খেলাপিদের চারবার পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া ঠিক নয়। চারবার এই সুযোগ দেয়া হলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই চারবারে প্রায় ১০-১২ বছর লেগে যায়। এতে দেশের অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন আসে।’ শনিবার (৮ জুন) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
সম্প্রতি খেলাপি ঋণ বেড়ে রেকর্ড ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, এই বিষয়ে সরকার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘দুই ধরনের খেলাপি রয়েছে। আগে আমাদের সেই দুই ধরনের খেলাপি আলাদা করতে হবে। এক ধরনের খেলাপি হলো, প্রকৃত খেলাপি। যে কোনো একটা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন এবং লস করেছেন। তিনি আসলে বুঝতে পারেননি যে ব্যবসাটা তার জন্য নয়। তিনি এই ভুল দ্বিতীয়বার করবেন না। অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে যারা প্রথম ব্যবসায় লোকসান করেছিলেন। তারপর পরের ব্যবসায় লাভবান হয়েছেন। তিনি হলেন প্রকৃত খেলাপি। তাকে সুযোগ দেয়া উচিত।’
আরেক ধরনের খেলাপির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আরেক ধরনের খেলাপি আছে যাদেরকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি বলা হয়। এই ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শক্ত হাতে ধরতে হবে। এজন্য আগে কারা প্রকৃত খেলাপি আর কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি সেটা আলাদা করতে হবে।’
ব্যাংক কমিশন বা কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা বলে আসছি। সেটা হলে এই খাতের অনিয়ম কিছুটা হলেও দূর হবে।’
কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে ট্যাক্স রেট বেঁধে দেয়া আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এই রেট অবশ্যই গ্রাহকের সম্পদের পরিমাণের ওপর হওয়া উচিত। ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া ‘ট্যাক্স ইকুইটি’র (কর ন্যায্যতা) খেলাপ বলে মনে করি।’
বিনায়ক সেন বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে গ্রাহকের বৈধ আয়ও অপ্রদর্শিত আয় হতে পারে। এক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত আয়কে প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া দরকার। তবে অপ্রদর্শিত আয়কে প্রদর্শনের সুযোগে একেবারে ট্যাক্স মওকুফ করা কিংবা একটি নির্দিষ্ট রেট বেঁধে দেয়ার পক্ষে নই আমরা। আমাদের অবস্থান মধ্যবর্তী।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রাহকের কাছে যে পরিমাণ অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ থাকবে সেই সম্পদের পরিমাণ অনুযায়ী ট্যাক্স নির্ধারণ করা উচিত। সেটা হতে পারে ১৫ শতাংশ, আবার হতে পারে ২০, ৩০ বা ৩৫ শতাংশ। ১৫ শতাংশ ট্যাক্স বেঁধে দেয়া ট্যাক্স ইকুইটির খেলাপ বলে মনে করি।’
বিআইডিএস এর গবেষণা পরিচালক ড. মনজুর হোসাইন মূল্যস্ফীতির বিষয়ে বলেন, ‘সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা একটি অন্যতম কৌশল। বিভিন্ন দেশের এমনটা করা হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়িয়ে দিলে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটা হচ্ছে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক ঋণের মধ্যে বেশি অংশ হলো ভোক্তাঋণ। আর খুব কম অংশ হলো শিল্পঋণ। বাংলাদেশে এটা উল্টা। বাংলাদেশের মোট ঋণের অধিকাংশই হলো শিল্পঋণ। ভোক্তাঋণ খুব সামান্য। তাই সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।’
বিআইডিএস এর আরেকজন গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল দেশের শিল্পনীতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘একটা দেশের দীর্ঘমেয়াদে শিল্প কোন দিকে যাবে সেটার একটা দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। সেটা ৫ বছরের পরিকল্পনা হতে পারে, ১০ বছরের পরিকল্পনা হতে পারে বা ৫০ বছরের পরিকল্পনা হতে পারে। সেটা ছাড়া টেকসই শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে যেটা হচ্ছে, আগে যেকোনো ভাবে একটা খাত আলোচনায় আসছে। তারপর সেটা নিয়ে নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। সেটা চলতে থাকলে বাজার ব্যবস্থা যেদিকে যাবে আমাদের শিল্পও সেদিকে যাবে। তখন সেটাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে না। অর্থাৎ বাজার যেটা ভালো মনে করবে সেভাবে এগিয়ে যাবে। সেটা ঠিক নয়।’
বিভিন্ন দেশের অটোমোবাইল শিল্পের উদারহণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্রাজিল, চীন, ভারত অনেক আগে থেকে গাড়ি বানানো শুরু করেছে। তারা যখন শুরু করেছে তখন সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি সত্যি কিন্তু অনেক আগে থেকে শুরু করার কারণে ধীরে ধীরে তারা শিখেছে কিভাবে মানসম্মত গাড়ি বানাতে হয়। এরপর যখন নিজেরা যোগ্য হয়েছে তখন তারা এই খাতে ভালো উৎপদন দিতে পেরেছে। এমনটা হলে সংকটে দেশ আটকে যায় না। যেমন এখন রিজার্ভ সংকট রয়েছে। এখন যদি বিলাসপণ্য আমদানি বন্ধ করে ডলার সাশ্রয় করা হয় তাহলে রিজার্ভ বাড়বে। কিন্তু দেশে এসব পণ্য তৈরি না করলে তো সেটার আমদানি বন্ধ করা যাবে না।’
আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন গবেষণা পরিচালক ড. এসএম জুলফিকার আলি, ড, মোহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ।
শনিবার, ০৮ জুন ২০২৪
ঋণখেলাপিদের একে একে চারবার পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। তিনি বলেছেন, ‘খেলাপিদের চারবার পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া ঠিক নয়। চারবার এই সুযোগ দেয়া হলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই চারবারে প্রায় ১০-১২ বছর লেগে যায়। এতে দেশের অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন আসে।’ শনিবার (৮ জুন) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
সম্প্রতি খেলাপি ঋণ বেড়ে রেকর্ড ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, এই বিষয়ে সরকার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘দুই ধরনের খেলাপি রয়েছে। আগে আমাদের সেই দুই ধরনের খেলাপি আলাদা করতে হবে। এক ধরনের খেলাপি হলো, প্রকৃত খেলাপি। যে কোনো একটা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন এবং লস করেছেন। তিনি আসলে বুঝতে পারেননি যে ব্যবসাটা তার জন্য নয়। তিনি এই ভুল দ্বিতীয়বার করবেন না। অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে যারা প্রথম ব্যবসায় লোকসান করেছিলেন। তারপর পরের ব্যবসায় লাভবান হয়েছেন। তিনি হলেন প্রকৃত খেলাপি। তাকে সুযোগ দেয়া উচিত।’
আরেক ধরনের খেলাপির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আরেক ধরনের খেলাপি আছে যাদেরকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি বলা হয়। এই ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শক্ত হাতে ধরতে হবে। এজন্য আগে কারা প্রকৃত খেলাপি আর কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি সেটা আলাদা করতে হবে।’
ব্যাংক কমিশন বা কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা বলে আসছি। সেটা হলে এই খাতের অনিয়ম কিছুটা হলেও দূর হবে।’
কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে ট্যাক্স রেট বেঁধে দেয়া আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এই রেট অবশ্যই গ্রাহকের সম্পদের পরিমাণের ওপর হওয়া উচিত। ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া ‘ট্যাক্স ইকুইটি’র (কর ন্যায্যতা) খেলাপ বলে মনে করি।’
বিনায়ক সেন বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে গ্রাহকের বৈধ আয়ও অপ্রদর্শিত আয় হতে পারে। এক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত আয়কে প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া দরকার। তবে অপ্রদর্শিত আয়কে প্রদর্শনের সুযোগে একেবারে ট্যাক্স মওকুফ করা কিংবা একটি নির্দিষ্ট রেট বেঁধে দেয়ার পক্ষে নই আমরা। আমাদের অবস্থান মধ্যবর্তী।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রাহকের কাছে যে পরিমাণ অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ থাকবে সেই সম্পদের পরিমাণ অনুযায়ী ট্যাক্স নির্ধারণ করা উচিত। সেটা হতে পারে ১৫ শতাংশ, আবার হতে পারে ২০, ৩০ বা ৩৫ শতাংশ। ১৫ শতাংশ ট্যাক্স বেঁধে দেয়া ট্যাক্স ইকুইটির খেলাপ বলে মনে করি।’
বিআইডিএস এর গবেষণা পরিচালক ড. মনজুর হোসাইন মূল্যস্ফীতির বিষয়ে বলেন, ‘সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা একটি অন্যতম কৌশল। বিভিন্ন দেশের এমনটা করা হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়িয়ে দিলে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটা হচ্ছে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক ঋণের মধ্যে বেশি অংশ হলো ভোক্তাঋণ। আর খুব কম অংশ হলো শিল্পঋণ। বাংলাদেশে এটা উল্টা। বাংলাদেশের মোট ঋণের অধিকাংশই হলো শিল্পঋণ। ভোক্তাঋণ খুব সামান্য। তাই সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।’
বিআইডিএস এর আরেকজন গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল দেশের শিল্পনীতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘একটা দেশের দীর্ঘমেয়াদে শিল্প কোন দিকে যাবে সেটার একটা দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। সেটা ৫ বছরের পরিকল্পনা হতে পারে, ১০ বছরের পরিকল্পনা হতে পারে বা ৫০ বছরের পরিকল্পনা হতে পারে। সেটা ছাড়া টেকসই শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে যেটা হচ্ছে, আগে যেকোনো ভাবে একটা খাত আলোচনায় আসছে। তারপর সেটা নিয়ে নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। সেটা চলতে থাকলে বাজার ব্যবস্থা যেদিকে যাবে আমাদের শিল্পও সেদিকে যাবে। তখন সেটাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে না। অর্থাৎ বাজার যেটা ভালো মনে করবে সেভাবে এগিয়ে যাবে। সেটা ঠিক নয়।’
বিভিন্ন দেশের অটোমোবাইল শিল্পের উদারহণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্রাজিল, চীন, ভারত অনেক আগে থেকে গাড়ি বানানো শুরু করেছে। তারা যখন শুরু করেছে তখন সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি সত্যি কিন্তু অনেক আগে থেকে শুরু করার কারণে ধীরে ধীরে তারা শিখেছে কিভাবে মানসম্মত গাড়ি বানাতে হয়। এরপর যখন নিজেরা যোগ্য হয়েছে তখন তারা এই খাতে ভালো উৎপদন দিতে পেরেছে। এমনটা হলে সংকটে দেশ আটকে যায় না। যেমন এখন রিজার্ভ সংকট রয়েছে। এখন যদি বিলাসপণ্য আমদানি বন্ধ করে ডলার সাশ্রয় করা হয় তাহলে রিজার্ভ বাড়বে। কিন্তু দেশে এসব পণ্য তৈরি না করলে তো সেটার আমদানি বন্ধ করা যাবে না।’
আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন গবেষণা পরিচালক ড. এসএম জুলফিকার আলি, ড, মোহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ।