alt

উচ্চ সুদহার, জ্বালানি সংকট : কেউ স্বস্তিতে নেই, বললেন ব্যবসায়ীরা

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক : রোববার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

উচ্চ সুদহার ও জ্বালানি সংকটে ব্যবসা ও শিল্প চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, একদিকে ‘গ্যাসের সংকট’, অন্যদিকে ‘বাড়ছে উৎপাদন খরচ’। এই অবস্থায় ‘জীবন কঠিন’ হয়ে যাচ্ছে। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়ার নীতি কতটা সফল হবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তারা।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) ঢাকায় ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’ বিষয়ে সংলাপে এসব কথা বলা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সম্মেলন কক্ষে এই সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএস।

ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ-বিসিআই-এর সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘বর্তমানে কেউ স্বস্তিতে নাই। যেখানে আছি, সেখান থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। মূল্যস্ফীতি একটা কারণ। উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। গ্যাসের সরবরাহ নাই, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্টারেস্ট রেট। প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই অনিশ্চয়তা থাকলে কেউ ব্যবসায় আসবে না। আস্থা বাড়ানো উচিত। সবার সুরক্ষা লাগবে।’

ব্যবসায়ীরা আগের সরকারের সুবিধাভোগী, এমন প্রচার নাকচ করে পারভেজ বলেন, ‘গণহারে সবাই বেনিফিট নিয়েছে বলা হচ্ছে, আমি তো বেনিফিট নেই নাই। ৯৯ শতাংশই নেয় নাই।’

সুদের চাপে ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়েছে, এই ধারণায় একমত এফবিসিসিআইয়ের সাবেক অন্য সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। বেনিফিট কোন ব্যবসায়ী পাবে? এগুলোকে অ্যাড্রেস করতে হবে। কোনো ইন্ডাস্ট্রি এত পারসেন্ট ইন্টারেস্ট দিয়ে টিকে থাকতে পারে?’

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিরোধিতা করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, ‘আমি যখন দেখি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে, তখন অবাক হই। এটি একটি টুল। কিন্তু আমরা শুনি কারওয়ান বাজারে এক কোটি টাকার চাঁদা ওঠে। যাত্রাবাড়ী ও গাবতলীতেও তাই। এসব বিবেচনায় না নিয়ে মূল্যস্ফীতি কমবে না।’

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘শ্বেতপত্রের প্রথম অধ্যায় তথ্য-উপাত্ত নিয়ে। আমরা দেখেছি, জাতীয় আয় নিয়ে কীভাবে ‘খেলাধুলা’ করা হয়েছে। ওখানে কীভাবে আমাদের মূল্যস্ফীতির তথ্য বিকৃতি করা হয়েছে, কীভাবে খানা জরিপের বিভিন্ন বিষয়ে ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে রপ্তানি এবং রপ্তানি আয়ের সঙ্গে পার্থক্য করে কীভাবে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সমস্যা করা হয়েছে। আমরা ওগুলো যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে দেখেছি। সরকারি লোকজনকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের ‘অসহায়ত্ব’ শুনলে পরে আপনাদের আরও (খারাপ) লাগবে।’

বর্ধিত দাম দিয়েও বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে মীর নাসির বলেন, ‘আমি বলি ৬-৯ সুদের হার যৌক্তিক ছিল না। কিন্তু সব খাতের সহনীয় ক্ষমতা এক না। এখন এত চাপ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে না। বর্তমান বিনিয়োগই চালানো যাচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগ তাহলে কীভাবে করবে?’

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু সংস্কার প্রশ্নে বলেন, ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাজাবে কে? এখানে তো নাইই, সরকারেও কেউ আছে, দেখছি না।’

সব সংস্কার যদি উনারা সরকার করতে যায় তাহলে ‘একটাও করতে পারবে না’ মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘অগ্রাধিকার ঠিক করে ‘কিছু’ সংস্কার করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের দাবি করেন।’

ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু এরাই (ব্যবসায়ী) সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত। বিনিয়োগের জন্য প্রথম দরকার সামাজিক মূলধন। সামাজিক শৃঙ্খলা। সামাজিক ঐক্য। সব সরকারই ‘বিভক্তি’ই তৈরি করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শত্রু হয়ে যায়। ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ নাই।’

বছরের পর বছর মূল্যস্ফীতি মজুরির ওপর থাকে তাহলে সঞ্চয় হবে কীভাবে?- এই প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘সঞ্চয় কমে গেলে বিনিয়োগ আসবে কোত্থেকে? সঞ্চয় বাড়াতে হবে এবং সামাজিক মূলধনের ঘাটতি কমাতে হবে। তাহলে বিনিয়োগ এমনই আসবে।’

বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চাকরি না বাড়াতে পারলে বৈষম্য বাড়তে থাকবে। চুরি, মারামারি বেড়ে যাবে। গ্যাং সংস্কৃতি বেড়ে যাবে। রাজনীতি যতক্ষণ ঠিক না হবে ততক্ষণ কিছুই হবে না।’

অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলকে যদি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয় তাহলে সঞ্চয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার ক্ষমতাগুলোকেও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।’

দেবপ্রিয় মনে করেন অর্থনীতির পরিস্থিতিই নির্ধারণ করবে কত দ্রুত বা দেরিতে নির্বাচন করা যাবে। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি মনে করেন আমরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বা নির্বাচনী সংস্কারের কথা বলব, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো তার মতে চলবে, তাহলে আমরা ভুল বুঝতে পারছি।’

সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন নতুন সুযোগ, আমরা যে সমস্যার কথা বলেছি এগুলো সমস্যা সমাধান করতে হবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশিদের সহায়তায় সবগুলো সমস্যা সমাধান করে দেবে ভাবি, তাহলে আমরা ভ্রান্ত জগতে বসবাস করি।’

অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ এম আবু ইউসুফ বলেন, ‘এখনকার সবচেয়ে প্রয়োজন ম্যাক্রোইকোনমিক স্ট্যাবিলিটি করা।’

সরকারি তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি যেভাবে বেড়ে গেছে সেটার রিফ্লেকশন রাস্তায় নামলে দেখি না। যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইনফ্লেশন এবং ডিমান্ড এর এস্টিমেট করছি, সেই তথ্য সত্য কিনা, দেখা উচিত। চাল বা অন্যান্য পণ্যের চাহিদা, জিডিপির সাইজ এবং পপুলেশন এর তথ্য রিচেক করা উচিত।’

শ্বেতপত্রের কাজ করতে গিয়ে যেসব অসঙ্গতি পেয়েছেন তাও তুলে ধরে বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সিপিআই ইনফ্লেশনের যে তথ্য দেয় বিবিএস, বাজারে গিয়ে সেই তথ্য মেলে না। তথ্যের এই অসামঞ্জস্যের সুরাহা দরকার। বাংলাদেশের পুরো পরিসংখ্যানের ভিত্তিই রং এবং মিথ্যা।’

আয়োজক সংগঠন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এর চেয়ার মুনিরা খানের সভাপতিত্বে এবং নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, সায়মা হক বিদিশা, আবু আহমেদ, শাহিদুল ইসলাম জাহিদ, এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বিসিআই-এর সাবেক সভাপতি শাহেদুল ইসলাম হেলাল, এনবিআর এর সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, অর্থনীতিবিদ জামাল উদ্দিন আহমেদ, এফবিসিসিআই-এর স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর সংগঠন বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান সবুর খান, ইষ্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসীও।

ছবি

২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ

ছবি

অধিকাংশ শেয়ারের দরপতন, সামান্য বেড়েছে লেনদেন

ছবি

অক্টোবরে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতি জাতিসংঘকে জানাতে হবে

ছবি

শ্রমিকের পাওনা পরিশোধে নাসা গ্রুপের সম্পত্তি বিক্রির সিদ্ধান্ত

ছবি

একনেকে ৮৩৩৩ কোটি টাকার ১৩ প্রকল্প অনুমোদন

ছবি

ঢাকায় নিরাপত্তা প্রযুক্তির সর্বশেষ উদ্ভাবন নিয়ে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী

ছবি

পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র মেজবাউল

ছবি

প্রথম চালানে ভারতে গেল সাড়ে ৩৭ টন ইলিশ

ছবি

তাপমাত্রা বাড়ায় বাংলাদেশের ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকা: বিশ্বব্যাংক

ছবি

পাঁচ বেসরকারি শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার প্রথম ধাপে প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ পেছানোর বিরোধিতা করছে

ছবি

শেয়ারবাজারে লেনদেন নামলো ৬শ’ কোটি টাকার ঘরে

ছবি

ব্যবসা মাঝে মন্থর ছিল, এখন একটু ভালো: অর্থ উপদেষ্টা.

ছবি

অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরে আশাবাদী জাপানি রাষ্ট্রদূত

ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকে সভা: একীভূত হচ্ছে পাঁচ ব্যাংক, বসছে প্রশাসক

ছবি

বিজিএমইএ–মার্কিন প্রতিনিধিদল বৈঠক: শুল্ক কমাতে আহ্বান

ছবি

জুলাই-আগস্টে এডিপি বাস্তবায়ন ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ

ছবি

বিবিএসের নাম পরিবর্তন ও তদারক পরিষদ রাখার সুপারিশ

ছবি

শ্রম আইন সংশোধন দ্রুত শেষ করার তাগিদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের

ছবি

নগদ অর্থের ব্যবহার কমাতে আসছে একীভূত পেমেন্ট সিস্টেম: গভর্নর

ছবি

আড়াই মাসে ১৩৯ কোটি ডলার কিনলো বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

ডিজিটাল ব্যাংক খুলতে আবেদনের সময় বাড়লো ২ নভেম্বর পর্যন্ত

ছবি

পুঁজিবাজারে সূচকের নামমাত্র উত্থান, লেনদেন আরও তলানিতে

ছবি

চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে খরচ বাড়লো ৪১ শতাংশ

ছবি

বাংলাদেশের বাজারে লেনোভো ভি সিরিজের নতুন ল্যাপটপ

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরও কমতে পারে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ছবি

বাজারে গিগাবাইট এআই টপ ১০০ জেড৮৯০ পিসি

ছবি

কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা

ছবি

শেয়ারবাজারে বড় পতন, এক মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন

ছবি

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমার সফটওয়্যার চালু করলো এনবিআর

ছবি

ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম ও ডেবিট কার্ডসেবা সাময়িক বন্ধ থাকবে

ছবি

বেপজার ইপিজেডগুলোতে শ্রমিকদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ প্রদান শুরু

ছবি

বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিসে আরও ৫ সেবা যুক্ত

ছবি

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পেছাতে ব্যবসায়ীদের সক্রিয় হওয়ার আহ্বান

ছবি

আড়াইগুণ প্রতিষ্ঠানের দরপতনে বাজার মূলধন কমলো ৩ হাজার কোটি টাকা

ছবি

পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনা করতে পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনা করতে রোববার ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল

tab

উচ্চ সুদহার, জ্বালানি সংকট : কেউ স্বস্তিতে নেই, বললেন ব্যবসায়ীরা

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

রোববার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

উচ্চ সুদহার ও জ্বালানি সংকটে ব্যবসা ও শিল্প চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, একদিকে ‘গ্যাসের সংকট’, অন্যদিকে ‘বাড়ছে উৎপাদন খরচ’। এই অবস্থায় ‘জীবন কঠিন’ হয়ে যাচ্ছে। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়ার নীতি কতটা সফল হবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তারা।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) ঢাকায় ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’ বিষয়ে সংলাপে এসব কথা বলা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সম্মেলন কক্ষে এই সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএস।

ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ-বিসিআই-এর সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘বর্তমানে কেউ স্বস্তিতে নাই। যেখানে আছি, সেখান থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। মূল্যস্ফীতি একটা কারণ। উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। গ্যাসের সরবরাহ নাই, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্টারেস্ট রেট। প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই অনিশ্চয়তা থাকলে কেউ ব্যবসায় আসবে না। আস্থা বাড়ানো উচিত। সবার সুরক্ষা লাগবে।’

ব্যবসায়ীরা আগের সরকারের সুবিধাভোগী, এমন প্রচার নাকচ করে পারভেজ বলেন, ‘গণহারে সবাই বেনিফিট নিয়েছে বলা হচ্ছে, আমি তো বেনিফিট নেই নাই। ৯৯ শতাংশই নেয় নাই।’

সুদের চাপে ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়েছে, এই ধারণায় একমত এফবিসিসিআইয়ের সাবেক অন্য সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। বেনিফিট কোন ব্যবসায়ী পাবে? এগুলোকে অ্যাড্রেস করতে হবে। কোনো ইন্ডাস্ট্রি এত পারসেন্ট ইন্টারেস্ট দিয়ে টিকে থাকতে পারে?’

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিরোধিতা করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, ‘আমি যখন দেখি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে, তখন অবাক হই। এটি একটি টুল। কিন্তু আমরা শুনি কারওয়ান বাজারে এক কোটি টাকার চাঁদা ওঠে। যাত্রাবাড়ী ও গাবতলীতেও তাই। এসব বিবেচনায় না নিয়ে মূল্যস্ফীতি কমবে না।’

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘শ্বেতপত্রের প্রথম অধ্যায় তথ্য-উপাত্ত নিয়ে। আমরা দেখেছি, জাতীয় আয় নিয়ে কীভাবে ‘খেলাধুলা’ করা হয়েছে। ওখানে কীভাবে আমাদের মূল্যস্ফীতির তথ্য বিকৃতি করা হয়েছে, কীভাবে খানা জরিপের বিভিন্ন বিষয়ে ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে রপ্তানি এবং রপ্তানি আয়ের সঙ্গে পার্থক্য করে কীভাবে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সমস্যা করা হয়েছে। আমরা ওগুলো যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে দেখেছি। সরকারি লোকজনকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের ‘অসহায়ত্ব’ শুনলে পরে আপনাদের আরও (খারাপ) লাগবে।’

বর্ধিত দাম দিয়েও বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে মীর নাসির বলেন, ‘আমি বলি ৬-৯ সুদের হার যৌক্তিক ছিল না। কিন্তু সব খাতের সহনীয় ক্ষমতা এক না। এখন এত চাপ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে না। বর্তমান বিনিয়োগই চালানো যাচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগ তাহলে কীভাবে করবে?’

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু সংস্কার প্রশ্নে বলেন, ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাজাবে কে? এখানে তো নাইই, সরকারেও কেউ আছে, দেখছি না।’

সব সংস্কার যদি উনারা সরকার করতে যায় তাহলে ‘একটাও করতে পারবে না’ মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘অগ্রাধিকার ঠিক করে ‘কিছু’ সংস্কার করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের দাবি করেন।’

ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু এরাই (ব্যবসায়ী) সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত। বিনিয়োগের জন্য প্রথম দরকার সামাজিক মূলধন। সামাজিক শৃঙ্খলা। সামাজিক ঐক্য। সব সরকারই ‘বিভক্তি’ই তৈরি করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শত্রু হয়ে যায়। ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ নাই।’

বছরের পর বছর মূল্যস্ফীতি মজুরির ওপর থাকে তাহলে সঞ্চয় হবে কীভাবে?- এই প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘সঞ্চয় কমে গেলে বিনিয়োগ আসবে কোত্থেকে? সঞ্চয় বাড়াতে হবে এবং সামাজিক মূলধনের ঘাটতি কমাতে হবে। তাহলে বিনিয়োগ এমনই আসবে।’

বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চাকরি না বাড়াতে পারলে বৈষম্য বাড়তে থাকবে। চুরি, মারামারি বেড়ে যাবে। গ্যাং সংস্কৃতি বেড়ে যাবে। রাজনীতি যতক্ষণ ঠিক না হবে ততক্ষণ কিছুই হবে না।’

অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলকে যদি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয় তাহলে সঞ্চয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার ক্ষমতাগুলোকেও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।’

দেবপ্রিয় মনে করেন অর্থনীতির পরিস্থিতিই নির্ধারণ করবে কত দ্রুত বা দেরিতে নির্বাচন করা যাবে। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি মনে করেন আমরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বা নির্বাচনী সংস্কারের কথা বলব, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো তার মতে চলবে, তাহলে আমরা ভুল বুঝতে পারছি।’

সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন নতুন সুযোগ, আমরা যে সমস্যার কথা বলেছি এগুলো সমস্যা সমাধান করতে হবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশিদের সহায়তায় সবগুলো সমস্যা সমাধান করে দেবে ভাবি, তাহলে আমরা ভ্রান্ত জগতে বসবাস করি।’

অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ এম আবু ইউসুফ বলেন, ‘এখনকার সবচেয়ে প্রয়োজন ম্যাক্রোইকোনমিক স্ট্যাবিলিটি করা।’

সরকারি তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি যেভাবে বেড়ে গেছে সেটার রিফ্লেকশন রাস্তায় নামলে দেখি না। যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইনফ্লেশন এবং ডিমান্ড এর এস্টিমেট করছি, সেই তথ্য সত্য কিনা, দেখা উচিত। চাল বা অন্যান্য পণ্যের চাহিদা, জিডিপির সাইজ এবং পপুলেশন এর তথ্য রিচেক করা উচিত।’

শ্বেতপত্রের কাজ করতে গিয়ে যেসব অসঙ্গতি পেয়েছেন তাও তুলে ধরে বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সিপিআই ইনফ্লেশনের যে তথ্য দেয় বিবিএস, বাজারে গিয়ে সেই তথ্য মেলে না। তথ্যের এই অসামঞ্জস্যের সুরাহা দরকার। বাংলাদেশের পুরো পরিসংখ্যানের ভিত্তিই রং এবং মিথ্যা।’

আয়োজক সংগঠন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এর চেয়ার মুনিরা খানের সভাপতিত্বে এবং নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, সায়মা হক বিদিশা, আবু আহমেদ, শাহিদুল ইসলাম জাহিদ, এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বিসিআই-এর সাবেক সভাপতি শাহেদুল ইসলাম হেলাল, এনবিআর এর সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, অর্থনীতিবিদ জামাল উদ্দিন আহমেদ, এফবিসিসিআই-এর স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর সংগঠন বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান সবুর খান, ইষ্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসীও।

back to top