ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় ‘এমপ্লয়মেন্ট ইমারজেন্সি বা কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। চলমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। একই সঙ্গে শিক্ষা খাতের সংকট ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে দেশের দরিদ্র পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) আয়োজিত ‘দারিদ্র্য না কমে কেন বাড়ছে’ শীর্ষক অনলাইন সেমিনারে অংশ নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন অর্থনীতিবিদ এ কথা বলেন। গতকাল শনিবার রাতে অনলাইনে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান।
সম্প্রতি পিপিআরসির প্রকাশিত এক জরিপে দারিদ্র্যের হার নতুন করে দশ শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধির তথ্য উঠে আসে। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হয় সেমিনারে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গত তিন বছরে দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে ২৮ শতাংশ হয়েছে। দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। সুতরাং দারিদ্র্য ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামেই দরিদ্রতা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ৫১ শতাংশ পরিবারে কেউ না কেউ দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত। বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে। বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৩০ হাজারে। আর বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি মানুষের আর্থিক অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলেছে। তাই কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
সেমিনারের প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার নানা সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও দরিদ্রতা দূরীকরণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ক কোনো আলোচ্যসূচিও সরকারের ছিল না।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘২০২২ সালে বিবিএসের করা দারিদ্র্য জরিপে করোনার কোনো প্রভাব উঠে না আসাটা আমাকে বিস্মিত করেছিল। অতীতে আমরা দেখেছি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি বা দারিদ্র্য কমাতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি। বরং একদিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অন্যদিকে বৈষম্য বেড়েছে। এমনকি পোশাক খাতের অধিকাংশ শ্রমিকদের বেতন দরিদ্রদের আয়সীমার নিচে।’
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সেলিম রায়হান বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রাতারাতি হয়তো পরিবর্তন হবে না। ফলে দারিদ্র্য সমস্যা আরও ঘনীভূত হতে পারে। আর বর্তমানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ পরবর্তী সরকার চালিয়ে নেবে কি না—সেই প্রশ্নও রয়ে গেছে।’
সেমিনারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত কয়েক দশকে আমরা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি দেখেছি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ থমকে ছিল। গত ১৫ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও শিল্প খাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি।
তাই কাজের সুযোগ বাড়েনি। কিন্তু বিবিএসের হিসাবে সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করলে তাকে কর্মসংস্থানে যুক্ত ধরা হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, এই বেতনে চলা যায় না।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার ম-ল বলেন, ‘গ্রামের দরিদ্রতা বৃদ্ধির কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন এখন কৃষি উৎপাদনে সার, সেচ এসবের ব্যয় বেড়ে গেছে। খরার কারণে দীর্ঘ সময় সেচ দিতে হচ্ছে, ফলে ডিজেল ব্যয় বাড়ছে। এতে কৃষকের লাভের পরিমাণ কমে গেছে। সেই সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। কিন্তু প্রকৃত মজুরি সেভাবে বাড়েনি।’
সেমিনারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিক্ষা খাতেও সংকট তৈরি হয়েছে। আবার বর্তমান সামাজিক সুরক্ষা প্রচেষ্টাও যথেষ্ট নয়। এখানে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা দেখছি কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। তাই এসবের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রয়োজন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘মূলত বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের দারিদ্র্য অবস্থার চিত্র তুলে আনার জন্যই কিছুদিন আগে জরিপটি পরিচালনা করা হয় যাতে দেখা যায় দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ৫১ শতাংশ পরিবার। যাদের নিয়মিত ওষুধ কিনে খেতে হয়। তাই এই জনগোষ্ঠীকে নতুনভাবে সামাজিক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় ‘এমপ্লয়মেন্ট ইমারজেন্সি বা কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। চলমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। একই সঙ্গে শিক্ষা খাতের সংকট ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে দেশের দরিদ্র পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) আয়োজিত ‘দারিদ্র্য না কমে কেন বাড়ছে’ শীর্ষক অনলাইন সেমিনারে অংশ নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন অর্থনীতিবিদ এ কথা বলেন। গতকাল শনিবার রাতে অনলাইনে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান।
সম্প্রতি পিপিআরসির প্রকাশিত এক জরিপে দারিদ্র্যের হার নতুন করে দশ শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধির তথ্য উঠে আসে। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হয় সেমিনারে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গত তিন বছরে দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে ২৮ শতাংশ হয়েছে। দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। সুতরাং দারিদ্র্য ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামেই দরিদ্রতা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ৫১ শতাংশ পরিবারে কেউ না কেউ দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত। বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে। বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৩০ হাজারে। আর বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি মানুষের আর্থিক অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলেছে। তাই কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
সেমিনারের প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার নানা সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও দরিদ্রতা দূরীকরণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ক কোনো আলোচ্যসূচিও সরকারের ছিল না।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘২০২২ সালে বিবিএসের করা দারিদ্র্য জরিপে করোনার কোনো প্রভাব উঠে না আসাটা আমাকে বিস্মিত করেছিল। অতীতে আমরা দেখেছি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি বা দারিদ্র্য কমাতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি। বরং একদিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অন্যদিকে বৈষম্য বেড়েছে। এমনকি পোশাক খাতের অধিকাংশ শ্রমিকদের বেতন দরিদ্রদের আয়সীমার নিচে।’
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সেলিম রায়হান বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রাতারাতি হয়তো পরিবর্তন হবে না। ফলে দারিদ্র্য সমস্যা আরও ঘনীভূত হতে পারে। আর বর্তমানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ পরবর্তী সরকার চালিয়ে নেবে কি না—সেই প্রশ্নও রয়ে গেছে।’
সেমিনারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত কয়েক দশকে আমরা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি দেখেছি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ থমকে ছিল। গত ১৫ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও শিল্প খাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি।
তাই কাজের সুযোগ বাড়েনি। কিন্তু বিবিএসের হিসাবে সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করলে তাকে কর্মসংস্থানে যুক্ত ধরা হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, এই বেতনে চলা যায় না।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার ম-ল বলেন, ‘গ্রামের দরিদ্রতা বৃদ্ধির কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন এখন কৃষি উৎপাদনে সার, সেচ এসবের ব্যয় বেড়ে গেছে। খরার কারণে দীর্ঘ সময় সেচ দিতে হচ্ছে, ফলে ডিজেল ব্যয় বাড়ছে। এতে কৃষকের লাভের পরিমাণ কমে গেছে। সেই সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। কিন্তু প্রকৃত মজুরি সেভাবে বাড়েনি।’
সেমিনারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিক্ষা খাতেও সংকট তৈরি হয়েছে। আবার বর্তমান সামাজিক সুরক্ষা প্রচেষ্টাও যথেষ্ট নয়। এখানে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা দেখছি কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। তাই এসবের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রয়োজন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘মূলত বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের দারিদ্র্য অবস্থার চিত্র তুলে আনার জন্যই কিছুদিন আগে জরিপটি পরিচালনা করা হয় যাতে দেখা যায় দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ৫১ শতাংশ পরিবার। যাদের নিয়মিত ওষুধ কিনে খেতে হয়। তাই এই জনগোষ্ঠীকে নতুনভাবে সামাজিক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’