ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
অবশেষে রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নয় বছর আগে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির মামলায় ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকের (আরসিবিসি) ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ‘আদালতের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত’ করা হয়েছে। রোববার,(২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডিপ্রধান মো. ছিবগাত উল্লাহ এ তথ্য জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ফিলিপিন্সের আরসিবিসির ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ‘বাজেয়াপ্ত’ করেছে
এর মাধ্যমে রিজার্ভ চুরির মোট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ফেরত আসতে যাচ্ছে বাংলাদেশ
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশি-বিদেশি যে চক্রই জড়িত থাকুক কেউ রেহাই পাবে না: সিআইডিপ্রধান
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশি-বিদেশি যে চক্রই থাকুক কেউ রেহাই পাবে না। বাজেয়াপ্ত হওয়া অর্থ উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে ফেরত পাঠানো হবে।’
এদিন রিজার্ভ চুরির মামলার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন সিআইডির আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। তিনি বলেন, ‘আলোচিত এ মামলায় সিআইডির দায়িত্ব ছিল শুধু তদন্ত করা।’ তদন্ত প্রতিবেদনে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে এ রায় দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
যা ঘটেছিল
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন (দুই কোটি) ডলার সরিয়ে নেয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।
বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেয়া হয় ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজল কমার্সিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে। অল্প সময়ের মধ্যে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়, ফিলরেম মানি রেমিট্যান্স কোম্পানির মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে সেই অর্থ চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোর কাছে।
এরমধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দেয়া হলেও বাকি অর্থ উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয়ে ওই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে, তারও কোনো হদিস মিলছিল না।
ওই অবস্থায় রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় আরসিবিসির বিরুদ্ধে নিউইয়র্কের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২০ সালের ২৭ মে ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা ওই মামলায় অর্থ রূপান্তর, চুরি, আত্মসাৎ-এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সহায়তা বা প্ররোচনা, জালিয়াতি, জালিয়াতিতে সহায়তা বা প্ররোচনাসহ বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ওই মামলা চালিয়ে নেয়ার অনুমতি দেয় নিউইয়র্কের আদালত। তবে ব্যক্তিগত এখতিয়ার না থাকায় চারজন বিবাদীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রিজার্ভের অর্থ চুরির কাজে ‘অজ্ঞাতনামা উত্তর কোরীয় হ্যাকারদের’ সহায়তা নেয় আসামিরা। ‘নেস্টেগ’ ও ‘ম্যাকট্র্যাক’ এর মতো ম্যালওয়্যার পাঠিয়ে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট নেটওয়ার্কে ঢোকার জন্য পথ বের করে। পরে নিউইয়র্ক ফেড থেকে টাকা সরিয়ে নেয়া হয় নিউইয়র্ক ও ফিলিপিন্সে আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে করা মামলায় বলা হয়, ‘ওই অ্যাকাউন্টগুলোর ওপর আরসিবিসি এবং এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। কী ধরনের অপরাধ হচ্ছে জেনেও অ্যাকাউন্ট খোলা, বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর এবং পরে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়ার বিষয়গুলো ঘটতে দিয়েছেন।’
ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ এ সাইবার জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হলে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের মানুষ বিষয়টি জানতে পারে ঘটনার এক মাস পর, ফিলিপিন্সের একটি পত্রিকার খবরের মাধ্যমে। বিষয়টি চেপে রাখায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ে আনা হয় বড় ধরনের রদবদল।
বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপিন্সে ঢোকার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে দেশটির সিনেট কমিটি তদন্ত শুরু করে। ওই ঘটনায় সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পর আরসিবিসি তাদের শাখা ম্যানেজারকে বরখাস্ত করে। আর ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা পাচার ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় ১ কোটি ৯১ লাখ ডলার জরিমানা করে আরসিবিসিকে।
ওই সময় করা এক মামলায় ফিলিপিন্সের আদালত ২০১৯ সালে আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগিতোকে মুদ্রাপাচারের আট দফা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলাতেও তাকে আসামি করা হয়।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশেও একটি মামলা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা ওই মামলায় সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি। তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ গত নয় বছরেও আদালতে প্রতিবেদন দিতে পারেনি।
যে প্রক্রিয়ায় অর্থ ফেরত পাবে বাংলাদেশ
প্রথম ধাপ: আদালতের রায় কার্যকর হওয়া: ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এ রায়ের অর্থ হলো- ওই অর্থকে আর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে নিজেদের বলে দাবি করতে পারবে না। এখন মার্কিন বিচার বিভাগ বা ‘ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস’-এর অধীনে থাকা ‘অ্যাসেট রিকভারি ইউনিট’ আনুষ্ঠানিকভাবে সেই অর্থ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবে। এ ধাপটি শেষ হওয়ার পর টাকা আর কোনো বিতর্কে থাকবে না বরং এটি সম্পূর্ণভাবে অপরাধজনিত সম্পদ হিসেবে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে।
দ্বিতীয় ধাপ: ভুক্তভোগী দেশকে স্বীকৃতি দেয়া: পরবর্তী ধাপে আদালত কিংবা মার্কিন সরকার স্পষ্টভাবে জানাবে কারা এ অর্থের বৈধ মালিক। যেহেতু এ অর্থ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে চুরি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সরাসরি পাচার হয়েছিল, তাই প্রকৃত ভুক্তভোগী হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হবে- এ টাকা ফিলিপাইন্স বা অন্য কোনো পক্ষের নয় বরং বাংলাদেশের। এ ধাপ সম্পন্ন হওয়ার পর অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া আইনি দিক থেকে আর কোনো বাধা থাকবে না।
তৃতীয় ধাপ: কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক চুক্তি: আদালতের স্বীকৃতির পর শুরু হবে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা। বাংলাদেশ সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটি আনুষ্ঠানিক সমঝোতা চুক্তি বা ‘রিপ্যাট্রিয়েশন এগ্রিমেন্ট’-এ পৌঁছাবে। এ চুক্তির মধ্যেই নির্ধারিত হবে অর্থ ফেরতের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি- টাকা এককালীন ফেরত দেয়া হবে নাকি কয়েক দফায় দেয়া হবে, কোন ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হবে এবং কীভাবে পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর কারণে এ ধাপটিই সাধারণত সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ। তবে এখানেই বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা দেয়া হবে।
চতুর্থ ধাপ: বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে অর্থ স্থানান্তর: সর্বশেষ ধাপে মার্কিন সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্থ সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবে স্থানান্তর করবে। অর্থ স্থানান্তরের পর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেবে যে রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া টাকা দেশে ফেরত এসেছে। এ ঘোষণার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলা এবং অর্থ উদ্ধারের লড়াইয়ের একটি বড় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
রোববার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
অবশেষে রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নয় বছর আগে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির মামলায় ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকের (আরসিবিসি) ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ‘আদালতের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত’ করা হয়েছে। রোববার,(২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডিপ্রধান মো. ছিবগাত উল্লাহ এ তথ্য জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ফিলিপিন্সের আরসিবিসির ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ‘বাজেয়াপ্ত’ করেছে
এর মাধ্যমে রিজার্ভ চুরির মোট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ফেরত আসতে যাচ্ছে বাংলাদেশ
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশি-বিদেশি যে চক্রই জড়িত থাকুক কেউ রেহাই পাবে না: সিআইডিপ্রধান
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশি-বিদেশি যে চক্রই থাকুক কেউ রেহাই পাবে না। বাজেয়াপ্ত হওয়া অর্থ উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে ফেরত পাঠানো হবে।’
এদিন রিজার্ভ চুরির মামলার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন সিআইডির আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। তিনি বলেন, ‘আলোচিত এ মামলায় সিআইডির দায়িত্ব ছিল শুধু তদন্ত করা।’ তদন্ত প্রতিবেদনে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে এ রায় দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
যা ঘটেছিল
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন (দুই কোটি) ডলার সরিয়ে নেয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।
বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেয়া হয় ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজল কমার্সিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে। অল্প সময়ের মধ্যে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়, ফিলরেম মানি রেমিট্যান্স কোম্পানির মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে সেই অর্থ চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোর কাছে।
এরমধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দেয়া হলেও বাকি অর্থ উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয়ে ওই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে, তারও কোনো হদিস মিলছিল না।
ওই অবস্থায় রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় আরসিবিসির বিরুদ্ধে নিউইয়র্কের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২০ সালের ২৭ মে ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা ওই মামলায় অর্থ রূপান্তর, চুরি, আত্মসাৎ-এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সহায়তা বা প্ররোচনা, জালিয়াতি, জালিয়াতিতে সহায়তা বা প্ররোচনাসহ বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ওই মামলা চালিয়ে নেয়ার অনুমতি দেয় নিউইয়র্কের আদালত। তবে ব্যক্তিগত এখতিয়ার না থাকায় চারজন বিবাদীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রিজার্ভের অর্থ চুরির কাজে ‘অজ্ঞাতনামা উত্তর কোরীয় হ্যাকারদের’ সহায়তা নেয় আসামিরা। ‘নেস্টেগ’ ও ‘ম্যাকট্র্যাক’ এর মতো ম্যালওয়্যার পাঠিয়ে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট নেটওয়ার্কে ঢোকার জন্য পথ বের করে। পরে নিউইয়র্ক ফেড থেকে টাকা সরিয়ে নেয়া হয় নিউইয়র্ক ও ফিলিপিন্সে আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে করা মামলায় বলা হয়, ‘ওই অ্যাকাউন্টগুলোর ওপর আরসিবিসি এবং এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। কী ধরনের অপরাধ হচ্ছে জেনেও অ্যাকাউন্ট খোলা, বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর এবং পরে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়ার বিষয়গুলো ঘটতে দিয়েছেন।’
ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ এ সাইবার জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হলে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের মানুষ বিষয়টি জানতে পারে ঘটনার এক মাস পর, ফিলিপিন্সের একটি পত্রিকার খবরের মাধ্যমে। বিষয়টি চেপে রাখায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ে আনা হয় বড় ধরনের রদবদল।
বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপিন্সে ঢোকার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে দেশটির সিনেট কমিটি তদন্ত শুরু করে। ওই ঘটনায় সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পর আরসিবিসি তাদের শাখা ম্যানেজারকে বরখাস্ত করে। আর ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা পাচার ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় ১ কোটি ৯১ লাখ ডলার জরিমানা করে আরসিবিসিকে।
ওই সময় করা এক মামলায় ফিলিপিন্সের আদালত ২০১৯ সালে আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগিতোকে মুদ্রাপাচারের আট দফা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলাতেও তাকে আসামি করা হয়।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশেও একটি মামলা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা ওই মামলায় সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি। তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ গত নয় বছরেও আদালতে প্রতিবেদন দিতে পারেনি।
যে প্রক্রিয়ায় অর্থ ফেরত পাবে বাংলাদেশ
প্রথম ধাপ: আদালতের রায় কার্যকর হওয়া: ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এ রায়ের অর্থ হলো- ওই অর্থকে আর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে নিজেদের বলে দাবি করতে পারবে না। এখন মার্কিন বিচার বিভাগ বা ‘ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস’-এর অধীনে থাকা ‘অ্যাসেট রিকভারি ইউনিট’ আনুষ্ঠানিকভাবে সেই অর্থ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবে। এ ধাপটি শেষ হওয়ার পর টাকা আর কোনো বিতর্কে থাকবে না বরং এটি সম্পূর্ণভাবে অপরাধজনিত সম্পদ হিসেবে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে।
দ্বিতীয় ধাপ: ভুক্তভোগী দেশকে স্বীকৃতি দেয়া: পরবর্তী ধাপে আদালত কিংবা মার্কিন সরকার স্পষ্টভাবে জানাবে কারা এ অর্থের বৈধ মালিক। যেহেতু এ অর্থ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে চুরি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সরাসরি পাচার হয়েছিল, তাই প্রকৃত ভুক্তভোগী হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হবে- এ টাকা ফিলিপাইন্স বা অন্য কোনো পক্ষের নয় বরং বাংলাদেশের। এ ধাপ সম্পন্ন হওয়ার পর অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া আইনি দিক থেকে আর কোনো বাধা থাকবে না।
তৃতীয় ধাপ: কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক চুক্তি: আদালতের স্বীকৃতির পর শুরু হবে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা। বাংলাদেশ সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটি আনুষ্ঠানিক সমঝোতা চুক্তি বা ‘রিপ্যাট্রিয়েশন এগ্রিমেন্ট’-এ পৌঁছাবে। এ চুক্তির মধ্যেই নির্ধারিত হবে অর্থ ফেরতের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি- টাকা এককালীন ফেরত দেয়া হবে নাকি কয়েক দফায় দেয়া হবে, কোন ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হবে এবং কীভাবে পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর কারণে এ ধাপটিই সাধারণত সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ। তবে এখানেই বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা দেয়া হবে।
চতুর্থ ধাপ: বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে অর্থ স্থানান্তর: সর্বশেষ ধাপে মার্কিন সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্থ সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবে স্থানান্তর করবে। অর্থ স্থানান্তরের পর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেবে যে রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া টাকা দেশে ফেরত এসেছে। এ ঘোষণার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলা এবং অর্থ উদ্ধারের লড়াইয়ের একটি বড় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে।