‘ব্যাংক খাতের সংকট, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক আলোচনা
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
এস আলম একাই পুরো ব্যাংক খাত ধ্বংস করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, ‘একজন মাত্র ব্যক্তি যেমন একটি ব্যাংক ধ্বংস করে দিতে পারে। উল্টোভাবে এক-দুজন সৎ পরিচালকও একটি ব্যাংকের সফলতার জন্য যথেষ্ট।’ রোববার,(২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) ‘ব্যাংক খাতের সংকট, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় এসব মন্তব্য করেন মাসরুর আরেফিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
‘দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাপূর্ণ (ডিট্রেসড)’
‘বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি। বিদেশি ব্যাংক বাদ দিয়ে স্থানীয় ব্যাংক রয়েছে ৫০টি। এরমধ্যে কমবেশি ৪০টি ব্যাংক মানসম্মত নয়’
অনুষ্ঠানে মাসরুর আরেফিন আরও বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাপূর্ণ (ডিট্রেসড) অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি। বিদেশি ব্যাংক বাদ দিয়ে স্থানীয় ব্যাংক রয়েছে ৫০টি। এরমধ্যে কমবেশি ৪০টি ব্যাংক মানসম্মত নয়। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১৫টি ব্যাংককে বলা হচ্ছে একেবারে ‘জম্বি ব্যাংক’। এসব ব্যাংকের অর্ধেকেই সরাসরি লুটপাট হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএপি) ও জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ-ওয়েইডেন যৌথভাবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। এ সময় আলোচনার মূল প্রবন্ধে এক খসড়া গবেষণাপত্র উপস্থাপনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ও ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বক্তব্য দেন। উপস্থিত ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, ‘আর্থিক খাত সংস্কার জটিল ও ব্যয়বহুল। দেশে যেমন কয়েকটি ভালো ব্যাংক আছে, আবার জম্বি ব্যাংক আছে। এসব জম্বি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার মোট বিতরণ করা ঋণের ৯০ শতাংশের ওপরে। দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর স্বাধীনতা দিতে হবে।’
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে মাহমুদ ওসমান ইমাম আরও বলেন, ‘এক পরিবারের সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক বোর্ডে থাকতে পারবেন। বোর্ড সদস্যদের মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যান ও নির্বাহী চেয়ারম্যানও মালিকপক্ষের বাইরের কেউ থাকা উচিত। এতে ব্যাংক পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে।’
প্যানেল আলোচনায় সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার কথা বলা হয়েছে। ভালো ব্যাংকেও কেন এ নিয়ম মানতে হবে? নতুন খসড়ায় আরও বলা হয়, একটি পরিবার একটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার রাখতে পারবে। তবে পরিবারের সংজ্ঞায় বিভিন্ন ধরনের আত্মীয়-স্বজনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাস্তবে দেশের ব্যাংক খাতে বড় লুটপাট হয়েছে বেনামি নামে, বৈধ শেয়ার মালিকানার কারণে নয়।’
ব্যাংক খাতে সংকট এখনও কাটেনি বলে মন্তব্য করেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২ ট্রিলিয়নে। ২০২৫ জুনের হিসেবে খেলাপি ঋণ আরও দেড় ট্রিলিয়ন বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণ বিতরণ করা মোট ঋণের ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে; ফলে অনেক আমানতকারী প্রয়োজনের সময় টাকা তুলতে পারছেন না যা ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় সংকট।’
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বলেন, ‘স্বতন্ত্র পরিচালক ও ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘হুইসেলব্লোয়িং’ নীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। একইভাবে রেটিং এজেন্সিগুলোর জবাবদিহি বাড়াতে হবে। বর্তমানে ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া, তারা আমানত ফেরত দিতে পারছে না। প্রশ্ন হলো- রেটিং এজেন্সিগুলো কী বলেছিল? দুর্নীতি দমন কমিশন কী করেছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো কী বলছে? প্রায়ই শোনা যায়, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা চাকরি হারানোর ভয়ে বাধ্য হয়ে অনিয়মে সায় দিয়েছেন।’
সোহেল আর কে হোসেন আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবেও তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো, যেগুলো বড় অনিয়মের জন্য দায়ী, সেগুলোর ওপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। শুধু পরিদর্শন নয়, অনিয়ম হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তাৎক্ষণিক ও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।’
‘ব্যাংক খাতের সংকট, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক আলোচনা
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
রোববার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
এস আলম একাই পুরো ব্যাংক খাত ধ্বংস করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, ‘একজন মাত্র ব্যক্তি যেমন একটি ব্যাংক ধ্বংস করে দিতে পারে। উল্টোভাবে এক-দুজন সৎ পরিচালকও একটি ব্যাংকের সফলতার জন্য যথেষ্ট।’ রোববার,(২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) ‘ব্যাংক খাতের সংকট, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় এসব মন্তব্য করেন মাসরুর আরেফিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
‘দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাপূর্ণ (ডিট্রেসড)’
‘বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি। বিদেশি ব্যাংক বাদ দিয়ে স্থানীয় ব্যাংক রয়েছে ৫০টি। এরমধ্যে কমবেশি ৪০টি ব্যাংক মানসম্মত নয়’
অনুষ্ঠানে মাসরুর আরেফিন আরও বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাপূর্ণ (ডিট্রেসড) অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি। বিদেশি ব্যাংক বাদ দিয়ে স্থানীয় ব্যাংক রয়েছে ৫০টি। এরমধ্যে কমবেশি ৪০টি ব্যাংক মানসম্মত নয়। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১৫টি ব্যাংককে বলা হচ্ছে একেবারে ‘জম্বি ব্যাংক’। এসব ব্যাংকের অর্ধেকেই সরাসরি লুটপাট হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএপি) ও জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ-ওয়েইডেন যৌথভাবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। এ সময় আলোচনার মূল প্রবন্ধে এক খসড়া গবেষণাপত্র উপস্থাপনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ও ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বক্তব্য দেন। উপস্থিত ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, ‘আর্থিক খাত সংস্কার জটিল ও ব্যয়বহুল। দেশে যেমন কয়েকটি ভালো ব্যাংক আছে, আবার জম্বি ব্যাংক আছে। এসব জম্বি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার মোট বিতরণ করা ঋণের ৯০ শতাংশের ওপরে। দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর স্বাধীনতা দিতে হবে।’
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে মাহমুদ ওসমান ইমাম আরও বলেন, ‘এক পরিবারের সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক বোর্ডে থাকতে পারবেন। বোর্ড সদস্যদের মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যান ও নির্বাহী চেয়ারম্যানও মালিকপক্ষের বাইরের কেউ থাকা উচিত। এতে ব্যাংক পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে।’
প্যানেল আলোচনায় সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার কথা বলা হয়েছে। ভালো ব্যাংকেও কেন এ নিয়ম মানতে হবে? নতুন খসড়ায় আরও বলা হয়, একটি পরিবার একটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার রাখতে পারবে। তবে পরিবারের সংজ্ঞায় বিভিন্ন ধরনের আত্মীয়-স্বজনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাস্তবে দেশের ব্যাংক খাতে বড় লুটপাট হয়েছে বেনামি নামে, বৈধ শেয়ার মালিকানার কারণে নয়।’
ব্যাংক খাতে সংকট এখনও কাটেনি বলে মন্তব্য করেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২ ট্রিলিয়নে। ২০২৫ জুনের হিসেবে খেলাপি ঋণ আরও দেড় ট্রিলিয়ন বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণ বিতরণ করা মোট ঋণের ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে; ফলে অনেক আমানতকারী প্রয়োজনের সময় টাকা তুলতে পারছেন না যা ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় সংকট।’
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বলেন, ‘স্বতন্ত্র পরিচালক ও ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘হুইসেলব্লোয়িং’ নীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। একইভাবে রেটিং এজেন্সিগুলোর জবাবদিহি বাড়াতে হবে। বর্তমানে ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া, তারা আমানত ফেরত দিতে পারছে না। প্রশ্ন হলো- রেটিং এজেন্সিগুলো কী বলেছিল? দুর্নীতি দমন কমিশন কী করেছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো কী বলছে? প্রায়ই শোনা যায়, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা চাকরি হারানোর ভয়ে বাধ্য হয়ে অনিয়মে সায় দিয়েছেন।’
সোহেল আর কে হোসেন আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবেও তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো, যেগুলো বড় অনিয়মের জন্য দায়ী, সেগুলোর ওপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। শুধু পরিদর্শন নয়, অনিয়ম হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তাৎক্ষণিক ও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।’