কৈশোর থেকেই তিনি স্বপ্নচারী। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি নিজ উদ্যোগে বাড়ি ছাড়েন, যোগ দেন রয়েল ইন্ডিয়ান নেভিতে। তার উদ্যোক্তা জীবন শুরু ছোট ফার্মেসি থেকে। আর তা থেকে গড়ে তুলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বহুমুখী শিল্পগোষ্ঠী- স্কয়ার গ্রুপ।
তিনি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র স্যামসন এইচ চৌধুরী। আজ সেই স্বপ্নচারী মানুষের ১০০তম জন্মবার্ষিকী। সংবাদের পক্ষ থেকে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
জন্ম ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার আরুয়াকান্দিতে। বাবা চিকিৎসক ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী ও মা লতিকা চৌধুরী। তার শৈশব কেটেছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে। বাবার চাকরির কারণে চাঁদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ এবং পশ্চিমবঙ্গ- বিভিন্ন শহরে কাটান শিক্ষাজীবন। এই চলাচল তার চরিত্রে অভিযোজন এবং দৃঢ়তা গড়ে তোলে। ১৯৪৩ সালে আতাইকুলা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন নিয়ে ছিল তার গভীর আগ্রহ। রয়েল ইন্ডিয়ান নেভিতে তিনি সিগন্যাল বিভাগের বদলে রাডার অপারেটর হওয়ার জন্য জেদ করেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একেবারে নতুন ও রহস্যময় একটি বিভাগ ছিল। নেভিতে তিন বছরের চাকরি তার নেতৃত্ব ও দক্ষতা আরও বিকশিত করে। আত্মনির্ভরশীল হতেও সহায়তা করে।
যুদ্ধশেষে তিনি ও নৌবাহিনীতে তার সহকর্মীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেন। পরে সরকারি সুপারিশে ডাক বিভাগে যোগ দেন। ডাক বিভাগের চাকরির পাশাপাশি তিনি ট্রেড ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলেন। একবার বিরোধের কারণে বদলি হলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
১৯৪৭ সালে বিয়ে করেন অনীতা চৌধুরীকে। সংসার জীবনে তাদের তিন ছেলে- অঞ্জন চৌধুরী, তপন চৌধুরী ও স্যামুয়েল চৌধুরী এবং এক মেয়ে রত্না চৌধুরী।
চাকরি জীবনের ইতি ঘটিয়ে বাবার ফার্মেসিতে বসেন তিনি। তার বাবা ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী ছিলেন খ্যাতনামা চিকিৎসক। তবে বাবার প্রতিষ্ঠিত ফার্মেসিতে সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি স্যামসন চৌধুরী।
নতুন স্বপ্ন দেখলেন ওষুধ কোম্পানি গড়ার। ১৯৫৬ সালে বাবার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়াকুব হোসেন অ্যান্ড সন্স। সিরাপ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার ব্যবসায়িক যাত্রা। প্রথমে সেখানে তিনি একাই সব মালিক, শ্রমিক, বাজারজাতকারী। একমাত্র সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী অনীতা চৌধুরী।
ধৈর্য, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং নেতৃত্ব তার ব্যবসাকে ধীরে ধীরে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত করেন। ছোট্ট ফার্মেসি থেকে শুরু করে আজকের স্কয়ার গ্রুপ। আর ধএই সাফল্য- স্বপ্ন, অধ্যবসায় ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক জীবন্ত প্রমাণ।
১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশে ফার্মেসি খাতের প্রাথমিক ধাপেই একজন হিন্দু ফার্মাসিস্ট ছিলেন, যিনি ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক তৈরি করতেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ভারতে চলে গেলে তার ফার্মেসি একজন লোক কিনে নেন এবং নাম দেন ‘এডরুক’। মূলত এ কোম্পানিই স্যামসন চৌধুরীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছিল। তিনি মনে করেছিলেন, ‘যদি তারা এমন কোম্পানি তৈরি করতে পারে, আমি কেন পারবো না?’
তার বন্ধু ডা. কাজী হারুনার রশিদ তার ফার্মেসিতে সপ্তাহে দুই দিন রোগী দেখতেন। একদিন স্যামসন চৌধুরী তার নতুন পরিকল্পনার কথা হারুনার রশিদের সঙ্গে ভাগ করে নেন এবং তাকে অংশীদার হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ডা. রশিদ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আরও দুজন বন্ধু- ডা. পিকে সাহা ও রাধা বিনোদ রায় যোগ দেন। চারজন বন্ধু মিলে সেই ওষুধ কোম্পানির নাম রাখেন ‘স্কয়ার’। স্যামসন চৌধুরী পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘স্কয়ার’ নামের পেছনে চতুর্দিকে সমান এবং ‘সঠিকতা ও পরিপূর্ণতা’ সে অর্থই মাথায় ছিল।
১৯৫৮ সালে মাত্র ১৭ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল স্কয়ার। প্রথম তিন বছর কোনো লাভ করতে পারেনি। তবে চার বন্ধু তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়ে কোম্পানিকে স্থিতিশীল রাখেন। চতুর্থ বছরে কোম্পানিটি লাভের মুখ দেখে। ১৯৬২ সালে ঢাকায় স্কয়ারের প্রথম শাখা অফিস খোলা হয়। ধীরে ধীরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগোতে থাকে স্কয়ার।
স্বাধীনতার পর স্কয়ারের জন্য মোড় পরিবর্তনের সময় ছিল ১৯৭৪ সাল। কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে স্যামসন চৌধুরী প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ আধুনিক রূপ দেন। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদন শুরু হয়। আশির দশকে নতুন ড্রাগ পলিসি স্কয়ারকে দেশের শীর্ষস্থান দখলে সাহায্য করে। ১৯৮৭ সালে প্রথমবারের মতো স্কয়ারের তৈরি ওষুধ বিদেশে রপ্তানি হয়। ১৯৯০ দশকের শুরুতে স্কয়ার বাজারে শেয়ার ছাড়ে, পরিণত হয় পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে। পরে ন্যাশনাল এক্সপোর্ট ট্রফি অর্জন করে। ১৯৯৮ সালে স্কয়ার আইএসও-৯০০১ সনদ লাভ করে।
তবে শুধু ওষুধেই থেমে থাকেননি। স্যামসন চৌধুরীর দূরদর্শিতা ও ব্যবসায়িক দক্ষতায় বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়- স্কয়ার টয়লেট্রিস (১৯৮৮), স্কয়ার টেক্সটাইল লিমিটেড (১৯৯৪), এগ্রো কেমিক্যালস ভ্যাটেরিনারি, স্কয়ার স্পিনিং, স্কয়ার নিট ফেব্রিকস, স্কয়ার ফ্যাশন, স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্টস, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, স্কয়ার ইনফরমেটিক্স ও স্কয়ার হাসপাতাল। উত্তরসূরি ছেলেরাও ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও প্রতিষ্ঠান যেমন সান কমিউনিকেশন, মিডিয়া কম, রেডিও দিন রাত, ওরাকল ট্রাভেলস, মাছরাঙা কমিউনিকেশনস ও স্কয়ার সিকিউরিটিস ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলেছেন।
স্যামসন চৌধুরীর সফলতার মূল চাবিকাঠি ছিল দূরদর্শিতা, সততা ও নিয়মানুবর্তিতা। দ্রুত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, সহকর্মী ও শ্রমিকদের প্রতি আন্তরিকতা এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজ রাখা- এসব মিলিয়ে তিনি সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
ব্যক্তি জীবনে স্যামসনের সবচেয়ে বড় সহচর ছিলেন স্ত্রী অনীতা চৌধুরী। মাত্র ২২ বছর বয়সে যুবক স্যামসন যখন ডাক বিভাগে চাকরি শুরু করেছিলেন, তখনই অনীতা তার জীবনসঙ্গী হন। তিনি শুধু স্ত্রী নয়, স্যামসন চৌধুরীর জীবনের চরাই-উতরাই, ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জে তার অনুপ্রেরণার উৎসও ছিলেন।
স্যামসন চৌধুরী সমাজসেবাতেও অনন্য অবদান রেখেছেন। নীরবে-নিভৃতে মানুষের সাহায্য করতেন। পরিবারের অনেক সদস্যও পরে এ কার্যকলাপের খবর জানতে পেরেছিলেন।
ব্যবসায়িক কৃতিত্ব ও মানবিক গুণাবলীর জন্য তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ তাকে ‘বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দি ইয়ার’ ঘোষণা করে। ধর্মানুরাগী হিসেবে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যেও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি, ৮৬ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তার জীবন, উদ্যোগ, অধ্যবসায় ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি- তার পুরো জীবনযাত্রা অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণার।
বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
কৈশোর থেকেই তিনি স্বপ্নচারী। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি নিজ উদ্যোগে বাড়ি ছাড়েন, যোগ দেন রয়েল ইন্ডিয়ান নেভিতে। তার উদ্যোক্তা জীবন শুরু ছোট ফার্মেসি থেকে। আর তা থেকে গড়ে তুলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বহুমুখী শিল্পগোষ্ঠী- স্কয়ার গ্রুপ।
তিনি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র স্যামসন এইচ চৌধুরী। আজ সেই স্বপ্নচারী মানুষের ১০০তম জন্মবার্ষিকী। সংবাদের পক্ষ থেকে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
জন্ম ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার আরুয়াকান্দিতে। বাবা চিকিৎসক ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী ও মা লতিকা চৌধুরী। তার শৈশব কেটেছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে। বাবার চাকরির কারণে চাঁদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ এবং পশ্চিমবঙ্গ- বিভিন্ন শহরে কাটান শিক্ষাজীবন। এই চলাচল তার চরিত্রে অভিযোজন এবং দৃঢ়তা গড়ে তোলে। ১৯৪৩ সালে আতাইকুলা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন নিয়ে ছিল তার গভীর আগ্রহ। রয়েল ইন্ডিয়ান নেভিতে তিনি সিগন্যাল বিভাগের বদলে রাডার অপারেটর হওয়ার জন্য জেদ করেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একেবারে নতুন ও রহস্যময় একটি বিভাগ ছিল। নেভিতে তিন বছরের চাকরি তার নেতৃত্ব ও দক্ষতা আরও বিকশিত করে। আত্মনির্ভরশীল হতেও সহায়তা করে।
যুদ্ধশেষে তিনি ও নৌবাহিনীতে তার সহকর্মীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেন। পরে সরকারি সুপারিশে ডাক বিভাগে যোগ দেন। ডাক বিভাগের চাকরির পাশাপাশি তিনি ট্রেড ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলেন। একবার বিরোধের কারণে বদলি হলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
১৯৪৭ সালে বিয়ে করেন অনীতা চৌধুরীকে। সংসার জীবনে তাদের তিন ছেলে- অঞ্জন চৌধুরী, তপন চৌধুরী ও স্যামুয়েল চৌধুরী এবং এক মেয়ে রত্না চৌধুরী।
চাকরি জীবনের ইতি ঘটিয়ে বাবার ফার্মেসিতে বসেন তিনি। তার বাবা ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী ছিলেন খ্যাতনামা চিকিৎসক। তবে বাবার প্রতিষ্ঠিত ফার্মেসিতে সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি স্যামসন চৌধুরী।
নতুন স্বপ্ন দেখলেন ওষুধ কোম্পানি গড়ার। ১৯৫৬ সালে বাবার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়াকুব হোসেন অ্যান্ড সন্স। সিরাপ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার ব্যবসায়িক যাত্রা। প্রথমে সেখানে তিনি একাই সব মালিক, শ্রমিক, বাজারজাতকারী। একমাত্র সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী অনীতা চৌধুরী।
ধৈর্য, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং নেতৃত্ব তার ব্যবসাকে ধীরে ধীরে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত করেন। ছোট্ট ফার্মেসি থেকে শুরু করে আজকের স্কয়ার গ্রুপ। আর ধএই সাফল্য- স্বপ্ন, অধ্যবসায় ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক জীবন্ত প্রমাণ।
১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশে ফার্মেসি খাতের প্রাথমিক ধাপেই একজন হিন্দু ফার্মাসিস্ট ছিলেন, যিনি ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক তৈরি করতেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ভারতে চলে গেলে তার ফার্মেসি একজন লোক কিনে নেন এবং নাম দেন ‘এডরুক’। মূলত এ কোম্পানিই স্যামসন চৌধুরীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছিল। তিনি মনে করেছিলেন, ‘যদি তারা এমন কোম্পানি তৈরি করতে পারে, আমি কেন পারবো না?’
তার বন্ধু ডা. কাজী হারুনার রশিদ তার ফার্মেসিতে সপ্তাহে দুই দিন রোগী দেখতেন। একদিন স্যামসন চৌধুরী তার নতুন পরিকল্পনার কথা হারুনার রশিদের সঙ্গে ভাগ করে নেন এবং তাকে অংশীদার হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ডা. রশিদ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আরও দুজন বন্ধু- ডা. পিকে সাহা ও রাধা বিনোদ রায় যোগ দেন। চারজন বন্ধু মিলে সেই ওষুধ কোম্পানির নাম রাখেন ‘স্কয়ার’। স্যামসন চৌধুরী পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘স্কয়ার’ নামের পেছনে চতুর্দিকে সমান এবং ‘সঠিকতা ও পরিপূর্ণতা’ সে অর্থই মাথায় ছিল।
১৯৫৮ সালে মাত্র ১৭ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল স্কয়ার। প্রথম তিন বছর কোনো লাভ করতে পারেনি। তবে চার বন্ধু তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়ে কোম্পানিকে স্থিতিশীল রাখেন। চতুর্থ বছরে কোম্পানিটি লাভের মুখ দেখে। ১৯৬২ সালে ঢাকায় স্কয়ারের প্রথম শাখা অফিস খোলা হয়। ধীরে ধীরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগোতে থাকে স্কয়ার।
স্বাধীনতার পর স্কয়ারের জন্য মোড় পরিবর্তনের সময় ছিল ১৯৭৪ সাল। কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে স্যামসন চৌধুরী প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ আধুনিক রূপ দেন। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদন শুরু হয়। আশির দশকে নতুন ড্রাগ পলিসি স্কয়ারকে দেশের শীর্ষস্থান দখলে সাহায্য করে। ১৯৮৭ সালে প্রথমবারের মতো স্কয়ারের তৈরি ওষুধ বিদেশে রপ্তানি হয়। ১৯৯০ দশকের শুরুতে স্কয়ার বাজারে শেয়ার ছাড়ে, পরিণত হয় পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে। পরে ন্যাশনাল এক্সপোর্ট ট্রফি অর্জন করে। ১৯৯৮ সালে স্কয়ার আইএসও-৯০০১ সনদ লাভ করে।
তবে শুধু ওষুধেই থেমে থাকেননি। স্যামসন চৌধুরীর দূরদর্শিতা ও ব্যবসায়িক দক্ষতায় বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়- স্কয়ার টয়লেট্রিস (১৯৮৮), স্কয়ার টেক্সটাইল লিমিটেড (১৯৯৪), এগ্রো কেমিক্যালস ভ্যাটেরিনারি, স্কয়ার স্পিনিং, স্কয়ার নিট ফেব্রিকস, স্কয়ার ফ্যাশন, স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্টস, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, স্কয়ার ইনফরমেটিক্স ও স্কয়ার হাসপাতাল। উত্তরসূরি ছেলেরাও ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও প্রতিষ্ঠান যেমন সান কমিউনিকেশন, মিডিয়া কম, রেডিও দিন রাত, ওরাকল ট্রাভেলস, মাছরাঙা কমিউনিকেশনস ও স্কয়ার সিকিউরিটিস ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলেছেন।
স্যামসন চৌধুরীর সফলতার মূল চাবিকাঠি ছিল দূরদর্শিতা, সততা ও নিয়মানুবর্তিতা। দ্রুত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, সহকর্মী ও শ্রমিকদের প্রতি আন্তরিকতা এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজ রাখা- এসব মিলিয়ে তিনি সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
ব্যক্তি জীবনে স্যামসনের সবচেয়ে বড় সহচর ছিলেন স্ত্রী অনীতা চৌধুরী। মাত্র ২২ বছর বয়সে যুবক স্যামসন যখন ডাক বিভাগে চাকরি শুরু করেছিলেন, তখনই অনীতা তার জীবনসঙ্গী হন। তিনি শুধু স্ত্রী নয়, স্যামসন চৌধুরীর জীবনের চরাই-উতরাই, ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জে তার অনুপ্রেরণার উৎসও ছিলেন।
স্যামসন চৌধুরী সমাজসেবাতেও অনন্য অবদান রেখেছেন। নীরবে-নিভৃতে মানুষের সাহায্য করতেন। পরিবারের অনেক সদস্যও পরে এ কার্যকলাপের খবর জানতে পেরেছিলেন।
ব্যবসায়িক কৃতিত্ব ও মানবিক গুণাবলীর জন্য তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ তাকে ‘বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দি ইয়ার’ ঘোষণা করে। ধর্মানুরাগী হিসেবে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যেও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি, ৮৬ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তার জীবন, উদ্যোগ, অধ্যবসায় ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি- তার পুরো জীবনযাত্রা অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণার।