সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার কোনো উপায় দেখছেন না অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে ঘৃণা না করলে দুর্নীতি কোনোদিন যাবে না। কিন্তু বর্তমানে দুর্নীতিবাজরা পুরস্কৃত হচ্ছে।’
রাজনৈতিক এলিটরা কোটি টাকার বিনিময়ে দুর্নীতিবাজদের সীমান্ত পার করেছেন
আগামী নির্বাচন পরবর্তী দুঃশাসক, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী রাখলে উন্নত দেশ পাওয়া কঠিন
একই সঙ্গে দুর্নীতি দূর করা খুব কঠিন বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। তিনি বলেছেন, ‘ভোট হলে শতভাগ লোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট দেবে, তারপরও দুর্নীতি দূর করা কঠিন। আগামী নির্বাচন পরবর্তী শাসন করার জন্য দুঃশাসক, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী রাখলে উন্নত দেশ পাওয়া কঠিন।’
মঙ্গলবার, (০৯ ডিসেম্বর ২০২৫) ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে দুর্নীতি দমন কমিশন আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন উপদেষ্টা।
অতীতের সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির তুলনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন খুব কমই দুর্নীতির কথা শুনতাম। যারা দুর্নীতি করতো, আমাদের বাবারাও তাদের এড়িয়ে চলতেন। এমনকি সেই পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে দিতেও দ্বিধা করতেন। কিন্তু এখন তো আমরা লাফ দেই ছেলে মেয়ের বিয়ে দিতে... দুর্নীতি কোনো ব্যাপারই না, টাকা পয়সা আছে...।’
অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বর্তমানে দুর্নীতিবাজ পুরস্কৃত হচ্ছে। সমাজের সব ব্যক্তির পক্ষ থেকে দুর্নীতির তথ্য আসতে হবে। এনফোর্সমেন্ট একটি কঠিন বিষয়। বর্তমানে দুদক দৃশ্যমান আগের চেয়ে বেশি। রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা থাকলে সমাজে পচন ধরবে না, কমে আসবে দুর্নীতি। আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বড় বিষয়। হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে শাস্তি কী দেবেন? সারা জীবন কারাগারে থাকলেও সাজা হয় না। কারণ দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। শুধু শাস্তি দিয়েই নয়, সামাজিকভাবে দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধ করলে দুর্নীতি কমে আসবে।’
সভাপতির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আমাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে গেছে, সেখানে আজ আমাদের কার্যকর যোগাযোগ নেই; এমনকি যোগাযোগের পথও খুঁজে পাচ্ছি না। বিদেশে আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ ‘ডার্টি মানি’ হিসেবে পড়ে আছে, আর সেসব দেশে এই অর্থ উদ্ধার বা ব্যবস্থাপনার মতো লোকবলও আমাদের নেই।’
মোমেন আরও বলেন, ‘আগে মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে টাকা আসতো। এখন বাস্তবতা উল্টো, বাংলাদেশ থেকে অর্থ আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে যায় এবং পরে কোনো না কোনোভাবে আবার দেশে ফিরে আসে। এসব লেনদেনে বিভিন্ন ধরনের ‘ইনসেন্টিভও’ থাকে। এতো বড় কাঠামো একদিনে, একমাসে বা একবছরে বদলানো সম্ভব নয়। গত ১৫ বছর ধরে যারা অপরাধ করেছেন, তাদেরকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক এলিটরা কোটি টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করে দিয়েছেন। এসব লোককে আপনারা নির্বাচিত করবেন কিনা তা চিন্তা করতে হবে। এখন সময় এসেছে, এমন লোকদের আমরা নির্বাচিত করবো কিনা এটা ভাবার।’
ভোট হলে শতভাগ লোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট দেবে, তারপরও দুর্নীতি দূর করা কঠিন বলে মন্তব্য করেন দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন পরবর্তী শাসন করার জন্য দুঃশাসক, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী রাখলে উন্নত দেশ পাওয়া কঠিন।’
গত ১৫ বছরে যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে দুদকের যোগাযোগ নেই জানিয়ে টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য সেসব দেশ ফার্স্ট সেক্রেটারি পদ মর্যাদার কর্মকর্তা পাঠাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে অনেকেই দেশ ছেড়েছেন, পালিয়ে গেছেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে বায়তুল মোকাররমের খতিব, এটাই দেখায় দুর্নীতি কত গভীরে পৌঁছেছে। যদি শুরুতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া যেত, তাহলে আমাদের ১৫-১৬ বছরের ভোগান্তি হতো না। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছিলেন, সেখানে কৃষিজমি পরিমাণ দেখানো হয়েছিল ৫ দশমিক ২১ একর।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন যাচাই করেও তাতে সমস্যা পাওয়া যায়নি। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, জমি রয়েছে ২৯ একর। গাড়ির বিবরণীতেও অসঙ্গতি পাওয়া যায়; অতিরিক্ত দুটি গাড়ি যুক্ত ছিল, যার একটি তৎকালীন এক এমপি এবং অন্যটি সাবেক যুব প্রতিমন্ত্রীর নামে, যা কিনা ‘পাঁচ নম্বর সুধা সদন’-এর নামে কেনা হয়েছিল এবং সরকারের প্রদেয় ট্যাক্সও দেয়া হয়নি। যদি তখনই এসব অসঙ্গতি ধরা হতো, সেক্ষেত্রে তার নমিনেশন বাতিল হতো। নমিনেশন বাতিল হলে তিনি এমপি বা প্রধানমন্ত্রী কিছুই হতে পারতেন না। এমনকি তার দল ক্ষমতায় আসতো কিনা সেটাও প্রশ্ন ছিল।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৪-১৫ ধরনের দুর্নীতি রয়েছে। আমরা শুধু ঘুষ নিয়ে কাজ করছি, দুর্নীতির অনেকগুলো ধরনের মধ্যে ঘুষ মাত্র একটি ধরন।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (অনুসন্ধান) অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহসান ফরিদ বলেন, ‘দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে সরকারি সব প্রকল্পের ডিটেইলস অনলাইনে পাবলিশ করতে হবে। এমনকি কোনো তথ্য আপডেট হলেও তা জনগণকে জানাতে হবে। টাকা একবার চুরি হয়ে গেলে তা উদ্ধার করা কঠিন। বাংলাদেশে দুর্নীতি পদ্ধতি ভিন্ন, এখানে বিদেশি পদ্ধতি কাজ করবে না। আমাদের নিজস্ব মডেল তৈরি করতে হবে।’
অন্যদের মধ্যে দুদকের কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী, দুদক সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীম, দুদক মহাপরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী, আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, আক্তার হোসেন, আবু হেনা মুস্তফা জামান, মোকাম্মেল হকসহ দুদকের পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, উপ-সহকারী পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অপরাধ ও দুর্নীতি: দেশে ও লন্ডনে আনোয়ারুজ্জামানের বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক
অপরাধ ও দুর্নীতি: ৪৩ বছর ধরে প্লট দখলে আমলা-রাজনীতিকরা, বঞ্চিত স্থানীয় চাষিরা