image

কঠিন সময় পার করে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাত: গভর্নর

বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাত একটি কঠিন সময় পার করে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আস্থা ধরে রাখতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক দৃঢ়ভাবে কাজ করছে।

বৃহস্পতিবার, (১৮ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘ব্যাংকিং খাত সংস্কার : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আহসান এইচ মনসুর এ কথা বলেন।

গভর্নর বলেন, ব্যাংকিং খাতে জনআস্থা ধরে রাখা, সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং খাতটির কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অগ্রাধিকার।

তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে আস্থা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হলেও তা অনেকাংশে ধরে রাখা গেছে। এই কঠিন সময়ে আস্থা ধরে রাখতে পারাটাই একটি বড় অর্জন।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অনেকে আশঙ্কা করছেন সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই-এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।’

তিনি জানান, বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট অবস্থান শক্তিশালী, বৈদেশিক লেনদেন হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত রয়েছে এবং রিজার্ভ গত এক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারভিত্তিক ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে ডলার ক্রয় করছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে কোনো চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য হলো নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা দিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো, ঋণ নিয়ে নয়।

গভর্নর জানান, বছরের শেষ নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪ থেকে ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে আইএমএফের অর্থ ছাড় হোক বা না হোক, তা বিবেচ্য নয়। তিনি বলেন, ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট স্থিতিশীল রাখতে আইএমএফের অর্থ অপরিহার্য নয়।’

ব্যাংকিং খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে গভর্নর তিনটি স্থায়ী চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন- কিছু ব্যাংকে দুর্বল গভর্ন্যান্স, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এবং উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ (এনপিএল)। প্রকৃত এনপিএল হার প্রায় ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তথ্য গোপন না করে বাস্তব চিত্র প্রকাশ করাই সংস্কারের প্রথম ধাপ।

তিনি জানান, ইতোমধ্যে ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং দুর্বল ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর হস্তক্ষেপ করবে। তবে যেসব ব্যাংক নিজেদের কর্মদক্ষতা ও আমানত সংগ্রহে সক্ষমতা দেখাতে পারছে, সেগুলোর ওপর বিধিনিষেধ ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে।

পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, সব আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং শিগগিরই নতুন কাঠামোতে ব্যাংকগুলো কার্যক্রম শুরু করবে। আমানতকারীদের সুরক্ষায় ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স স্কিমের আওতায় সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা দ্রুত পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে লভ্যাংশ ও বোনাস প্রদানে কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে এবং বড় অঙ্কের ঋণ তৃতীয় পক্ষ দিয়ে যাচাই করা হবে। অপব্যবহার প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও পরিচালকদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।

ভবিষ্যৎ সংস্কার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যাংক রেজুলেশন আইন, ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স, ইনসলভেন্সি আইন এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি) গঠনের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়ে ড. মনসুর বলেন, কার্যকর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য আইনি সুরক্ষা ও নেতৃত্বের স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি। ‘চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই প্রকৃত সংস্কার সম্ভব।’

বন্ড মার্কেট উন্নয়নের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, কেবল ব্যাংকনির্ভর অর্থায়ন টেকসই নয়। করপোরেট বন্ড মার্কেট সম্প্রসারণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে।

গভর্নর বলেন, ‘আমরা এখনো পুরোপুরি সংকটমুক্ত নই। তবে সঠিক সংস্কার ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’

সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচন একটি সন্ধিক্ষণ। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যাংকিং খাতকে কীভাবে সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী করা হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ও সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।’

ফাহমিদা খাতুন আরো বলেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরিষ্কার করতে হবে যে তারা কি আগের মতো ক্ষমতাশালী পুঁজিপতিদের হাতে ব্যাংকিং খাতকে ব্যবহার করতে দেবেন, নাকি জনগণের কল্যাণে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পুঁজি জোগানের জন্য এই খাতকে ব্যবহার করবেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলের মাধ্যমে ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এ জন্য এখন খেলাপি ঋণ ৩৬ শতাংশ পৌঁছে গেছে। এখন যে সংস্কার হচ্ছে, তা রাজনৈতিক সরকার কতটা এগিয়ে নেবে-তা গুরুত্বপূর্ণ।’

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার মালা ও সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

‘অর্থ-বাণিজ্য’ : আরও খবর

সম্প্রতি