আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের শর্ত বা পরামর্শের কোন সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে আইএমএফের তদারকি বা পরামর্শ ‘ভালো’ বলেই মনে করছেন অর্থমন্ত্রী।
মুস্তফা কামাল জানান এবারের বাজেট ‘গরিব ও ধনীদের জন্য উপহার’। আর তার অভিযোগ ‘মধ্যম আয়ের মানুষ ট্যাক্স দেয় না’। আর তিনি জানান মূল্যস্ফীতি নিয়ে ‘তারাও শঙ্কিত’।
জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব তোলার পরদিন শুক্রবার (২ জুন) সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি এসব কথা বলেন। প্রস্তাবিত বাজেটের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের জিজ্ঞাসার জবাব দিতে ছয়জন মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী।
গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন।
আইএমএফ এবং অর্থমন্ত্রীর ‘উপলব্ধি’
আইএমএফের শর্ত মেনে বাজেট হয়েছে কি না- এই প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি তাদের শর্ত বা পরামর্শ মোতাবেক আমরা আমাদের বাজেট করি নাই।’
তিনি বলেন, ‘তাদের (আইএমএফ) যে পরামর্শ আছে সেটা আমরা পুরোপুরি দেখি না। তাদের সার্বিক পরামর্শ যা তারা বলে, সেখান থেকে যেটুকু গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি সেটুকু আমরা গ্রহণ করব, বাকিটা আমরা নিজেদের মতো করে নেব। সেখানে তাদের কোন আপত্তি নাই।’
তিনি বলেন, ‘কেবল আইএমএফ না, সবাই দেখে ব্যালান্স শিট ঠিক আছে কি না, রেভিনিউ অ্যাকাউন্ট ঠিক আছে কি না, ট্রায়াল ব্যালান্স ঠিক আছে কি না, আয়-ব্যয়ের পার্থক্য ঠিক আছে কি না।
‘শুধু আমাদেরটা না, সবারটাই দেখে, আর এই দেখাটা ভালো। আইএমএফের সঙ্গে যারা কাজ করে, আমি মনে করি এটা ভালো দিক এজন্য যে, তারা শুধু অর্থ দিয়ে মানে লোন দিয়ে সাহায্য করে না, পাশাপাশি কিছু প্রকল্পের পরামর্শ দেয়। সেগুলো কীভাবে কম সময়ে বাস্তবায়ন করা যাবে, এগুলোও তারা পরমার্শ দেয়। তাই আমি মনে করি, এসব থেকে শেখার অনেক কিছু থাকে এবং আমরা সমৃদ্ধ হই।’
‘আমরা বিজয়ী হবই’
প্রতিবছরই বাজেট বাস্তবায়নে সরকার ‘ব্যর্থ’ এই প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রতিবারই প্রণীত বাজেট বাস্তবায়ন করে থাকে। এবারের বাজেট বাস্তবায়নেও সরকার ব্যর্থ হবে না। জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, ‘বিগত বাজেটে দেয়া সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ফেল করিনি, আগামীতেও ফেল করব না। এদেশের মানুষ আমাদের সবকিছু, ইনশাআল্লাহ আমরা বিজয়ী হবই হব।’
গরিব, ধনী আর মধ্যবিত্ত
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে অর্থমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, ‘এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জিত হবে। দেশে মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। তাদের অনেকেই ট্যাক্স দেন না।’ এ ধরনের মানুষকে ট্যাক্সের আওতায় নিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন মন্ত্রী।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘পুরো বাজেটটাই গরিব ও ধনী মানুষদের জন্য উপহার দিয়েছি। এ দেশে মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। তারা ট্যাক্স দেয় না। এখন সময় এসেছে ট্যাক্স দিতে হবে। আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, যাদের ট্যাক্স দেয়ার কথা, তাদের ট্যাক্স দিতে হবে।’
কর্মসংস্থানের নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আমার সমস্ত কমিটমেন্ট প্রয়োগ করেছি। আমি দুই কোটি মানুষের চাকরির ব্যবস্থার কথা বলেছিলাম। দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করেছি। কর্মসংস্থান তৈরির জন্য আমরা কাজ করি।’
মূল্যস্ফীতি : ‘আমরাও শঙ্কিত’
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। সারাবিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতিতে আছে। আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারব না। মানুষকে খাবার না দিয়ে রাখা যাবে না। আমরা একটা ফ্লেক্সিবল ওয়েতে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ছাড় দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করছি। পাশাপাশি যেসব পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয়, সেখানে নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে সাহায্য করছি। এভাবে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছি।’
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘যখন আমরা ক্ষমতায় আসি, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশ। পরের ১০ বছরে সেটি ৬ শতাংশে নেমে আসে। সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। এখন খুব খারাপ সময়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভালো আছি। এবারও যেসব প্রজেকশন আমাদের আছে, সবই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব বলে আশা করি।’
আর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘পণ্যের দাম বাড়লেও অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভালো।’
তিনি বলেন, ‘নিম্নআয়ের মানুষের কিছু কষ্ট হচ্ছে, এটা অর্থমন্ত্রীও বলেছেন। আমরা কিন্তু এটি মাথায় রেখে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ডাল-চিনি দিয়েছি। পেঁয়াজের দাম যখন বেড়েছে আমরা কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি।’
টিপু মুনশি বলেন, ‘আমরা আশা করছি সামনে আরও ভালো কিছু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যেসব পণ্য ইম্পোর্ট করি তার দাম যদি বাড়ে বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। কোথাও কোথাও সমস্যা আছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে সমস্যা তৈরি করে।’
করের যুক্তি ও কালো টাকা
করপোরেট ট্যাক্সের পরিমাণ না কমার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করপোরেট ট্যাক্সের পরিমাণ কমে এসেছে প্রয়োজনে আরও কমানো হবে।
এ সময় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জানান, ‘গত তিন বছরে (করপোরেট ট্যাক্স) ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৭ শতাংশে আনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কর দিতে চাই না, আমাদের এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
রিটার্ন দাখিল করলে দুই হাজার টাকা কর দেয়া বাধ্যতামূলক প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি অনুরোধ করব দেখে নিন কাদের টিআইএন আছে। টিআইএন বাধ্যতামূলক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য, গাড়িসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। গরিব মানুষের জন্য তো টিআইএন বাধ্যতামূলক নয়। তাই আমি মনে করি তাদের দুই হাজার টাকা সরকারের কোষাগারে দিয়ে উন্নয়নে শামিল হওয়া গর্বের ব্যাপার।’
কালো টাকা সাদা করার এবার বাজেটে সুযোগ কেন রাখা হয়নি এমন প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গত বছরের বাজেটে বলেছিলাম, কেউ যদি অপ্রত্যাশিত টাকা দেশে নিয়ে আসে, তাহলে সেই টাকার কোন কর দিতে হবে না। গত বাজেটে এ সুযোগটি দেয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোন অপ্রত্যাশিত টাকা বাংলাদেশে আসেনি। তাই এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি।’
গত অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন, তাহলে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে। আয়ের উৎস দেখাতে হবে না। আর বিদেশে থাকা স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে এর ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি মাসের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছরের জন্য এ সুবিধা বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছিল।
‘তারল্য সংকটে সরকারের ঋণ’
সরকারের ঋণ নেয়ার ব্যাপারে এক প্রশ্নে জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘সরকার এ ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে কোন সমস্যা হবে না। এছাড়া মূল্যস্ফীতিও বাড়বে না।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সংকট মোকাবিলায় প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। তার মানে ২ লাখ কোটি টাকা বাজেট থেকে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকে গেছে। এই টাকা যদি বাজারে থাকত তাহলে সরকারের এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়া কোন বিষয় হতো না। এখন যেহেতু বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে, সেজন্য সরকার বন্ডের মাধ্যমে নিচ্ছে।’
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়লে যে মূল্যস্ফীতি বাড়বে তার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ ২ লাখ কোটি টাকা তুলে এনে ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়লে টাকার সরবরাহ (ক্যাসেল আউট) কম থাকছে।’
পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টাকার সরবরাহ কম দাবি করে গভর্নর বলেন, ‘আমাদের মানি সাপ্লাই যদি দেখেন ওয়ান অব দ্য লোয়েস্ট এই রিজিওনের মধ্যে। জিডিপির মাত্র ৪০ শতাংশ মানি সাপ্লাই। যেটা ইন্ডিয়াতে ডাবল, ৭৬-৭৭ শতাংশ। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াতে প্রায় ১০০ শতাংশ। তাই সরকার ঋণ নিচ্ছে বলে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, এটা ঠিক না। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে।’
শেয়ারবাজার, কে বলবে
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজার নিয়ে কোন কিছু বলা হয়নি। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকে প্রশ্ন করা হয়। তিনি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি। পরে কে এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন তাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে অর্থ সচিবকে উত্তর দিতে বললে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে উত্তর দিতে বলা হয়। পরে এ বিষয়ে কথা বলেন গভর্নর।
গভর্নর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) ভেতর শেয়ার বাজার নিয়ে বেশ কিছু সমস্যা ছিল। আমরা চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে যে সমস্ত পলিসিতে সমস্যা ছিল, গত এক বছরের তিন থেকে চারটি সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে দুইটি অংশ, একটা ইকুইটি মার্কেট আরেকটা বন্ড মার্কেট। বন্ড মার্কেট কীভাবে ডেভেলপ করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে যে সমস্ত সাপোর্ট দেয়া দরকার আমরা সেগুলো দিচ্ছি।’
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর ডান পাশে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান। অর্থমন্ত্রীর বাম পাশে ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এবং পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিত কর্মকার।
শুক্রবার, ০২ জুন ২০২৩
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের শর্ত বা পরামর্শের কোন সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে আইএমএফের তদারকি বা পরামর্শ ‘ভালো’ বলেই মনে করছেন অর্থমন্ত্রী।
মুস্তফা কামাল জানান এবারের বাজেট ‘গরিব ও ধনীদের জন্য উপহার’। আর তার অভিযোগ ‘মধ্যম আয়ের মানুষ ট্যাক্স দেয় না’। আর তিনি জানান মূল্যস্ফীতি নিয়ে ‘তারাও শঙ্কিত’।
জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব তোলার পরদিন শুক্রবার (২ জুন) সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি এসব কথা বলেন। প্রস্তাবিত বাজেটের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের জিজ্ঞাসার জবাব দিতে ছয়জন মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী।
গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন।
আইএমএফ এবং অর্থমন্ত্রীর ‘উপলব্ধি’
আইএমএফের শর্ত মেনে বাজেট হয়েছে কি না- এই প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি তাদের শর্ত বা পরামর্শ মোতাবেক আমরা আমাদের বাজেট করি নাই।’
তিনি বলেন, ‘তাদের (আইএমএফ) যে পরামর্শ আছে সেটা আমরা পুরোপুরি দেখি না। তাদের সার্বিক পরামর্শ যা তারা বলে, সেখান থেকে যেটুকু গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি সেটুকু আমরা গ্রহণ করব, বাকিটা আমরা নিজেদের মতো করে নেব। সেখানে তাদের কোন আপত্তি নাই।’
তিনি বলেন, ‘কেবল আইএমএফ না, সবাই দেখে ব্যালান্স শিট ঠিক আছে কি না, রেভিনিউ অ্যাকাউন্ট ঠিক আছে কি না, ট্রায়াল ব্যালান্স ঠিক আছে কি না, আয়-ব্যয়ের পার্থক্য ঠিক আছে কি না।
‘শুধু আমাদেরটা না, সবারটাই দেখে, আর এই দেখাটা ভালো। আইএমএফের সঙ্গে যারা কাজ করে, আমি মনে করি এটা ভালো দিক এজন্য যে, তারা শুধু অর্থ দিয়ে মানে লোন দিয়ে সাহায্য করে না, পাশাপাশি কিছু প্রকল্পের পরামর্শ দেয়। সেগুলো কীভাবে কম সময়ে বাস্তবায়ন করা যাবে, এগুলোও তারা পরমার্শ দেয়। তাই আমি মনে করি, এসব থেকে শেখার অনেক কিছু থাকে এবং আমরা সমৃদ্ধ হই।’
‘আমরা বিজয়ী হবই’
প্রতিবছরই বাজেট বাস্তবায়নে সরকার ‘ব্যর্থ’ এই প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রতিবারই প্রণীত বাজেট বাস্তবায়ন করে থাকে। এবারের বাজেট বাস্তবায়নেও সরকার ব্যর্থ হবে না। জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, ‘বিগত বাজেটে দেয়া সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ফেল করিনি, আগামীতেও ফেল করব না। এদেশের মানুষ আমাদের সবকিছু, ইনশাআল্লাহ আমরা বিজয়ী হবই হব।’
গরিব, ধনী আর মধ্যবিত্ত
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে অর্থমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, ‘এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জিত হবে। দেশে মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। তাদের অনেকেই ট্যাক্স দেন না।’ এ ধরনের মানুষকে ট্যাক্সের আওতায় নিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন মন্ত্রী।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘পুরো বাজেটটাই গরিব ও ধনী মানুষদের জন্য উপহার দিয়েছি। এ দেশে মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। তারা ট্যাক্স দেয় না। এখন সময় এসেছে ট্যাক্স দিতে হবে। আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, যাদের ট্যাক্স দেয়ার কথা, তাদের ট্যাক্স দিতে হবে।’
কর্মসংস্থানের নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আমার সমস্ত কমিটমেন্ট প্রয়োগ করেছি। আমি দুই কোটি মানুষের চাকরির ব্যবস্থার কথা বলেছিলাম। দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করেছি। কর্মসংস্থান তৈরির জন্য আমরা কাজ করি।’
মূল্যস্ফীতি : ‘আমরাও শঙ্কিত’
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। সারাবিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতিতে আছে। আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারব না। মানুষকে খাবার না দিয়ে রাখা যাবে না। আমরা একটা ফ্লেক্সিবল ওয়েতে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ছাড় দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করছি। পাশাপাশি যেসব পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয়, সেখানে নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে সাহায্য করছি। এভাবে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছি।’
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘যখন আমরা ক্ষমতায় আসি, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশ। পরের ১০ বছরে সেটি ৬ শতাংশে নেমে আসে। সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। এখন খুব খারাপ সময়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভালো আছি। এবারও যেসব প্রজেকশন আমাদের আছে, সবই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব বলে আশা করি।’
আর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘পণ্যের দাম বাড়লেও অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভালো।’
তিনি বলেন, ‘নিম্নআয়ের মানুষের কিছু কষ্ট হচ্ছে, এটা অর্থমন্ত্রীও বলেছেন। আমরা কিন্তু এটি মাথায় রেখে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ডাল-চিনি দিয়েছি। পেঁয়াজের দাম যখন বেড়েছে আমরা কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি।’
টিপু মুনশি বলেন, ‘আমরা আশা করছি সামনে আরও ভালো কিছু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যেসব পণ্য ইম্পোর্ট করি তার দাম যদি বাড়ে বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। কোথাও কোথাও সমস্যা আছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে সমস্যা তৈরি করে।’
করের যুক্তি ও কালো টাকা
করপোরেট ট্যাক্সের পরিমাণ না কমার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করপোরেট ট্যাক্সের পরিমাণ কমে এসেছে প্রয়োজনে আরও কমানো হবে।
এ সময় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জানান, ‘গত তিন বছরে (করপোরেট ট্যাক্স) ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৭ শতাংশে আনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কর দিতে চাই না, আমাদের এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
রিটার্ন দাখিল করলে দুই হাজার টাকা কর দেয়া বাধ্যতামূলক প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি অনুরোধ করব দেখে নিন কাদের টিআইএন আছে। টিআইএন বাধ্যতামূলক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য, গাড়িসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। গরিব মানুষের জন্য তো টিআইএন বাধ্যতামূলক নয়। তাই আমি মনে করি তাদের দুই হাজার টাকা সরকারের কোষাগারে দিয়ে উন্নয়নে শামিল হওয়া গর্বের ব্যাপার।’
কালো টাকা সাদা করার এবার বাজেটে সুযোগ কেন রাখা হয়নি এমন প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গত বছরের বাজেটে বলেছিলাম, কেউ যদি অপ্রত্যাশিত টাকা দেশে নিয়ে আসে, তাহলে সেই টাকার কোন কর দিতে হবে না। গত বাজেটে এ সুযোগটি দেয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোন অপ্রত্যাশিত টাকা বাংলাদেশে আসেনি। তাই এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি।’
গত অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন, তাহলে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে। আয়ের উৎস দেখাতে হবে না। আর বিদেশে থাকা স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে এর ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি মাসের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছরের জন্য এ সুবিধা বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছিল।
‘তারল্য সংকটে সরকারের ঋণ’
সরকারের ঋণ নেয়ার ব্যাপারে এক প্রশ্নে জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘সরকার এ ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে কোন সমস্যা হবে না। এছাড়া মূল্যস্ফীতিও বাড়বে না।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সংকট মোকাবিলায় প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। তার মানে ২ লাখ কোটি টাকা বাজেট থেকে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকে গেছে। এই টাকা যদি বাজারে থাকত তাহলে সরকারের এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়া কোন বিষয় হতো না। এখন যেহেতু বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে, সেজন্য সরকার বন্ডের মাধ্যমে নিচ্ছে।’
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়লে যে মূল্যস্ফীতি বাড়বে তার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ ২ লাখ কোটি টাকা তুলে এনে ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়লে টাকার সরবরাহ (ক্যাসেল আউট) কম থাকছে।’
পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টাকার সরবরাহ কম দাবি করে গভর্নর বলেন, ‘আমাদের মানি সাপ্লাই যদি দেখেন ওয়ান অব দ্য লোয়েস্ট এই রিজিওনের মধ্যে। জিডিপির মাত্র ৪০ শতাংশ মানি সাপ্লাই। যেটা ইন্ডিয়াতে ডাবল, ৭৬-৭৭ শতাংশ। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াতে প্রায় ১০০ শতাংশ। তাই সরকার ঋণ নিচ্ছে বলে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, এটা ঠিক না। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে।’
শেয়ারবাজার, কে বলবে
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজার নিয়ে কোন কিছু বলা হয়নি। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকে প্রশ্ন করা হয়। তিনি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি। পরে কে এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন তাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে অর্থ সচিবকে উত্তর দিতে বললে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে উত্তর দিতে বলা হয়। পরে এ বিষয়ে কথা বলেন গভর্নর।
গভর্নর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) ভেতর শেয়ার বাজার নিয়ে বেশ কিছু সমস্যা ছিল। আমরা চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে যে সমস্ত পলিসিতে সমস্যা ছিল, গত এক বছরের তিন থেকে চারটি সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে দুইটি অংশ, একটা ইকুইটি মার্কেট আরেকটা বন্ড মার্কেট। বন্ড মার্কেট কীভাবে ডেভেলপ করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে যে সমস্ত সাপোর্ট দেয়া দরকার আমরা সেগুলো দিচ্ছি।’
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর ডান পাশে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান। অর্থমন্ত্রীর বাম পাশে ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এবং পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিত কর্মকার।